১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প - ফাইল ছবি

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিউ ইয়র্কের এক আদালত বৃহস্পতিবার (৩০ মে) ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছে। তিনি প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট যাকে ফৌজদারি মামলায় বিচার এবং দোষী সাব্যস্ত করা হল।

১২ সদস্যর জুরি ট্রাম্পকে ২০১৬ সালের নির্বাচন বেআইনিভাবে প্রভাবিত করার লক্ষে তার ব্যবসায়িক রেকর্ড জালিয়াতি করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেন। এই প্রক্রিয়ায় একজন পর্ন তারকার মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দেয়া হয়েছিল।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তার ব্যবসায়িক কোম্পানির রেকর্ড জালিয়াতি করার ৩৪টি অভিযোগ গঠন করা হয় এবং জুরি তাকে ৩৪টি অভিযোগেই দোষী সাব্যস্ত করে।

জুরির রায়ে বৃহস্পতিবার এমন এক বিচারের সমাপ্তি টানা হলো, যেটার কেন্দ্রে ছিল সেক্স এবং আর্থিক বিষয় ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস। এই রায় ট্রাম্পকে কারাগারে যাবার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এই রায় ট্রাম্পের জন্য একটি অসাধারণ আইনগত হিসেব-নিকেশের মুখোমুখি করেছে।

তার বিরুদ্ধে আরো তিনটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোটাতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।

রায়টি এলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ছয় মাস আগে, যেখানে ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের পদপ্রার্থী। একজন পর্ণ তারকার মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দেয়া একজন অপরাধীকে ভোট দিতে ভোটাররা কতটুক ইচ্ছুক হবেন, এই রায় সেটা পরীক্ষা করবে।

ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প শিগগিরই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। তিনি এখন একটি জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন, কারণ তাকে এখন একজন অপরাধী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো নির্বাচনী জনসভার পরিকল্পনা নেই, তবে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহে তিনি নির্বাচনী প্রচারের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।

ট্রাম্পকে কারা ভোগের সাজা দেয়া হবে কি না, ওই সিদ্ধান্ত নিতে মামলার বিচারক হুয়ান মেরশানের সম্ভবত কয়েক মাস লেগে যাবে।

ব্যবসায়িক রেকর্ড জালিয়াতি করার অভিযোগে চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হতে পারে। তবে বাদি পক্ষের কৌসুলিরা বলেননি, তারা কারাদণ্ড চাইবেন কি না। তারা যদি কারাদণ্ড চানও, এটা পরিষ্কার না যে বিচারক মেরশান ওই শাস্তি প্রদান করবেন।

তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় এবং কারাদণ্ড প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা হবে না।

'ট্রাম্প টাওয়ার ষড়যন্ত্র'

দিনের আগে ভিওএ-র কেন ব্রেডেমায়ার জানান, বুধবার (২৯ মে) ১২ সদস্যের জুরি প্রায় চার ঘন্টা ধরে বৈঠক করার পর, তারা ডেভিড পেকার ও মাইকেল কোহেনের কাছ থেকে প্রাপ্ত মূল সাক্ষ্যের বয়ান শোনার জন্য এই মামলার দায়িত্বে থাকা বিচারপতিকে অনুরোধ করেন।

পেকার ন্যাশনাল এনকোয়ারার নামে একটি ট্যাবলয়েডের সাবেক প্রকাশক। কোহেন ছিলেন ট্রাম্পের এক সময়ের রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারী। জুরিরা ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে নিউ ইয়র্কে ট্রাম্প টাওয়ার দফতরে ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের বৈঠকের বিষয়ে জানতে আগ্রহী।

প্রসিকিউটররা ওই বৈঠককে 'ট্রাম্প টাওয়ার ষড়যন্ত্র' আখ্যা দিয়েছেন। কারণ পেকার সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেখানেই তিনি তার দীর্ঘদিনের বন্ধু ট্রাম্পকে বলেছিলেন যে তার সম্পর্কে নেতিবাচক খবরের দিকে নজর রাখতে তিনিই হবেন ট্রাম্পের 'চক্ষু-কর্ণ।'

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি হোয়াইট হাউসে পদার্পণ করেছিলেন।

মাইকেল কোহেনের সাক্ষ্য

বিচার প্রক্রিয়ার সময় মাইকেল কোহেন সাক্ষ্য দেন যে, ট্রাম্প তাকে ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে পর্ণ ফিল্ম নায়িকা স্টরমি ড্যানিয়েলসকে তার মুখ বন্ধ রাখার জন্য ১৩০,০০০ ডলার দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, 'ব্যস, করে ফেলো।'

ড্যানিয়েলস দাবি করেছেন যে এক দশক আগে ট্রাম্পের সাথে তার এক রাতের জন্য যৌন সম্পর্ক হয়েছিল। ট্রাম্প ড্যানিয়েলসের সাথে কোনো সম্পর্ক করার কথা অস্বীকার করেছেন।

মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দেয়া বেআইনি নয়। কিন্তু ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তার কোম্পানির ব্যবসায়িক কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৭ সালে এই ঘুষের অর্থ কোহেনকে পরিশোধ করার ৩৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে।

ট্রাম্প দাবি করেন, কোহেনকে তার আইন-সংক্রান্ত কাজের জন্য টাকা দেয়া হয়েছিল। ট্রাম্পের আইনজীবীরা দাবি করেন, কোহেন নিজের ইচ্ছায় এবং ট্রাম্পের অজানায়, এই ঘুষের অর্থ ড্যানিয়েলসের আইনজীবীকে পাঠিয়ে দেন।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

প্লেবয় ম্যাগাজিনের ম্যাকডুগাল

ট্রাম্প টাওয়ারে ২০১৫ সালের বৈঠকে পেকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ট্রাম্পের সম্পর্কে বিব্রতকর খবরগুলোর স্বত্ব তিনি কিনে নেবেন, তবে ওই সব তথ্যের কোনোটা প্রকাশ করার অভিপ্রায় তার নেই।

ওই বৈঠকের পর পেকার নিউ ইয়র্কে ট্রাম্প ভবনের এক দ্বাররক্ষীকে ৩০ হাজার ডলার দিয়েছিলেন তার মিথ্যা দাবিকে চাপা দিতে। সেই ব্যক্তির দাবি ছিল, ট্রাম্প এক জারজ সন্তানের বাবা।

প্লেবয় ম্যাগাজিনের মডেল ক্যারেন ম্যাকডুগাল দাবি করেছিলেন, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে তার সঙ্গে ট্রাম্পের কয়েক মাসব্যাপী সম্পর্ক ছিল। তাকে চুপ করাতে দেড় লক্ষ ডলার দেওয়া হয়েছিল। যদিও ক্যারেনের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কের বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ট্রাম্প।

পেকারের সাক্ষ্যের পাশাপাশি জুরিরা ট্রাম্প টাওয়ারের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের বিষয়ে কোহেনের সাক্ষ্য পুনরায় শুনতে চেয়েছিলেন। বিচারপ্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনে ট্রাম্প সাক্ষ্য না দেওয়ায় ওই বৈঠকে ট্রাম্পের ভূমিকা কী ছিল তা বুঝতেই সম্ভবত জুরিদের এই উদ্যোগ।

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় জুরিদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ৭৭ বছর বয়সী ট্রাম্পকে বেকসুর খালাস দেওয়া হবে নাকি তাকে অপরাধী সাব্যস্থ করা হবে। যদি তারা সহমত হতে না পারেন এবং বিষয়টি ঝুলে থাকে তাহলে প্রসিকিউটরা সিদ্ধান্ত নেবেন এই মামলার পুনরায় বিচার হবে কিনা।

ট্রাম্পের আইনজীবীর বক্তব্য

ভোটার রেজিস্ট্রেশন তালিকা থেকে নেয়া নাম থেকে বাছাই করা জুরিরা সবাই নিউ ইয়র্কবাসী। ফৌজদারি অভিযোগে প্রথমবারের মতো একজন প্রেসিডেন্টের বিচারে তারা পাঁচ সপ্তাহ ধরে ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শোনেন।

মঙ্গলবার ( ২৮ মে) তারা ট্রাম্পের আইনজীবী টড ব্লাঞ্চ এবং বাদি পক্ষের কৌঁসুলি জশুয়া স্টাইনগ্লাস-এর কাছ থেকে মামলা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বক্তব্য শোনেন।

ব্লাঞ্চ তার তিন ঘণ্টাব্যাপী সমাপনি বক্তব্যে বাদীপক্ষের প্রধান সাক্ষী মাইকেল কোহেনকে নিশানা করেন। কোহেন এক সময় ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন, পরে তার তিক্ত সমালোচকে পরিণত হন এবং মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে বলেন তিনি চান ট্রাম্প যেন দোষী সাব্যস্ত হন।

বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলি কোহেনকে 'সর্বকালের সবচেয়ে বড় মিথ্যুক' বলে বর্ণনা করেন। কোহেন এর আগে আদালতে মিথ্যা বলার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং আইন পেশা থেকে তিনি নিষিদ্ধ। ব্লাঞ্চ বলেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চার্জগুলো নিয়ে যত 'যুক্তিযুক্ত সন্দেহ আছে, তাঁর শারীরিক প্রমাণ' হচ্ছেন কোহেন।

ব্লাঞ্চ বলেন, কোহেনের সন্দেহভাজন সাক্ষ্য, ট্রাম্পের কোম্পানি থেকে ৬০ হাজার ডলার চুরি এবং বছরের পর বছর মিথ্যা বলার ইতিহাস ট্রাম্পকে বেকসুর খালাস করার জন্য জুরিকে যথেষ্ট কারণ দিয়েছে।

ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে, জুরিদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তিনি তার কোম্পানির খাতায় জালিয়াতি করেছেন বা অন্য কাওকে করতে বলেছেন, এবং তিনি সেটা করেছেন অন্য এক অপরাধ করার বা ধামাচাপা দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে।

বাদীপক্ষের কৌঁসুলির যুক্তিতর্ক

বাদীপক্ষের কৌঁসুলি স্টাইনগ্লাস তার পাঁচ ঘণ্টা-ব্যাপী সমাপনি বক্তব্যে কোহেনের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেন, কিন্তু সেটাকে তিনি একটা 'সাইড শো' হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ট্রাম্প '২০১৬ সালের নির্বাচনকে কলঙ্কিত' করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

তিনি যুক্তি দেখান যে ২০১৫ সালের অগাস্ট মাসে ট্রাম্প সম্পর্কে নেতিবাচক খবর কিনে নিয়ে তা ধামাচাপা দেয়া এবং তার রাজনৈতিক শত্রুদের সম্পর্কে অতিরঞ্জিত নেতিবাচক খবর লেখার জন্য ট্রাম্প এবং কোহেন ট্যাবলয়েড পত্রিকা ন্যাশনাল এনকোয়েরার-এর তৎকালীন সম্পাদক ডেভিড পেকার-এর সাথে চুক্তি করেন।

স্টাইনগ্লাস বলেন এই কাজ ছিল 'গণতন্ত্র ধ্বংস করার' সামিল, এবং এর সূত্র ধরেই ড্যানিয়েলসের মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দেয়া হয়।

স্টাইনগ্লাস বলেন, এই পত্রিকা কার্যত ট্রাম্পের ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার 'গোপন হাতিয়ার', কারণ তারা ট্রাম্প ভবনের একজন দারোয়ানকে ৩০,০০০ ডলার দেয়। দারোয়ান দাবি করছিলেন যে ট্রাম্পের একটি অবৈধ সন্তান আছে– তবে সেই দাবি পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

ট্রাম্পের জন্য মামলার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য না, তার রাজনৈতিক ভাগ্যের জন্যও। তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের পদপ্রার্থী এবং নভেম্বরে তিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে লড়বেন। ডেমোক্র্যাট দলের বাইডেন ২০২০ সালে ট্রাম্পকে পরাজিত করেছিলেন।

ট্রাম্পকে আরো তিনটি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে দুটিতে ২০২০ সালের নির্বাচনে তার পরাজয়কে বেআইনিভাবে উল্টে দেবার অভিযোগ রয়েছে।

তবে এই তিনটি মামলাই তার আইনজীবী এবং বাদি পক্ষের কৌঁসুলিদের জটিলতায় আটকে আছে। ফলে, নিউ ইয়র্কের মামলাই একমাত্র যেটা নভেম্বরের নির্বাচনের আগে সম্পন্ন হবে।

সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা


আরো সংবাদ



premium cement