২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু : যেভাবে শোকপালন করে রাজপরিবার

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু : যেভাবে শোকপালন করে রাজপরিবার - ছবি : সংগৃহীত

আর সব রাজপরিবারের মতন বৃটিশ রাজপরিবারের রাজা বা রানির মৃত্যুর মতো ঘটনায় শোক পালনের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য এবং নিয়মাবলী রয়েছে।

আট সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর রাজকীয় শোক পালনের জন্য সময় ঘোষণা করা হয়েছে। রানির শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার সাতদিন পর্যন্ত এই শোক পালন চলবে।

ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় রাজত্বে থাকা রানির মৃত্যুতে এমন কিছু রীতিনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, যার পেছনে ইতিহাস রয়েছে। তার কিছু এখন সারা বিশ্বজুড়েও অনুসরণ করা হয়। এখানে সেরকম কিছু ইতিহাস উল্লেখ করা হলো।

পতাকা অর্ধনমিত করে রাখা
শোক প্রকাশের সময় সেটার আনুষ্ঠানিক প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো সরকারি ভবন এবং রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত সব ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে রাখা।

যখন 'অর্ধনমিত' শব্দটি যখন ব্যবহার করা হয়, তখন আসলে খুঁটির দুই-তৃতীয়াংশ উপরে পতাকা ওড়ানো হয়।

ধারণা করা হয়, সতেরো শতক থেকে এই ঐতিহ্য চলে আসছে। পতাকা অর্ধনমিত করার প্রতীকী মানে হলো, যেখানে পতাকা রয়েছে, তার ঠিক ওপরে ‘মৃত্যুর অদৃশ্য পতাকা’ ঝোলাতে জায়গা করে দেয়া।

এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল মূলত জাহাজে ক্যাপ্টেন বা জ্যেষ্ঠ কোন কর্মকর্তার মৃত্যু হলে পতাকা অর্ধনমিত করে রাখার মাধ্যমে। এটি করে জাহাজের বাকি সদস্যরা তাদের হারানোর ক্ষতি বোঝানোর চেষ্টা করতেন।

তবে অদ্ভুত হলো, রাজা বা রানির অবস্থানের প্রতীক হিসাবে যে রাজ পতাকা ওড়ানো হয়, এই নিয়ম সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। এটি কখনোই অর্ধনমিত হয় না, কারণ রাজতন্ত্র অব্যাহত থাকে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সাথে সাথে তার জ্যেষ্ঠপুত্র, প্রিন্স চার্লস স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজা তৃতীয় চার্লস হয়ে যান।

রানির রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের অন্যান্য পতাকাও অর্ধনমিত থাকবে। তবে এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল যখন ১০ই সেপ্টেম্বর অ্যাকসেশন কাউন্সিল সভা বসে, যার মাধ্যমে হিজ ম্যাজেস্টি দ্যা কিং আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষিত হন।

সেদিন রাজার অভিষেক বোঝাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য পতাকা পুরোপুরি তুলে রাখা হয়। তবে কয়েক ঘণ্টা পরে আবার অর্ধনমিত করা হয়।

তোপধ্বনি
রাজকীয় শোক জানানোর আরেকটি অনুষঙ্গ হচ্ছে তোপধ্বনি বা বন্দুকের গুলির মাধ্যমে স্যালুট জানানো।

ব্রিটিশ আর্মির ঐতিহাসিকদের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রথা শুরু হয়েছিল পনেরো শতকে। তখন যুদ্ধজাহাজগুলো কোনো বিদেশি বন্দরে নোঙর করার সময় সাগরের দিকে মুখ করে কয়েকবার বন্দুক বা কামানের গুলি ছুঁড়তো। এরা মাধ্যমে বোঝানো হতো যে, তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে আসছে, তাদের বন্দুক খালি করা হয়েছে।

১৭৩০ সাল নাগাদ রাজকীয় নৌবাহিনী বিশেষ কিছু ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে গান স্যালুট বা তোপধ্বনির ব্যবহার শুরু করে। যদিও ১৮০৮ সালের আগ পর্যন্ত রাজপরিবারের সদস্য এবং অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের ক্ষেত্রে এ ধরনের রীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা ছিল না।

তবে কতবার তোপধ্বনি করা হবে বা কতগুলো গুলি ছোঁড়া হবে, সেসব নিয়ম নিয়ে অনেক জটিলতা রয়েছে। এটা নির্ভর করবে কোন ঘটনায় এবং কোথায় এটা করা হচ্ছে তার ওপরে।

১৮২৭ সালে বোর্ড অব অর্ডিন্যান্স আদেশ দেয় যে, রাজপরিবারের সদস্যদের সম্মান জানাতে ৪১টি বন্দুকের গুলি করা আদর্শ হবে, যদি সেটা লন্ডনের রয়্যাল পার্কস অথবা টাওয়ার অফ লন্ডন থেকে ছোঁড়া হয়। তবে কিছু ঘটনায় এবং কোনো কোনো স্থানে আশা করা হয় যে, ৬২টি বন্দুকের গুলি ছোঁড়া হবে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু এবং রাজা তৃতীয় চার্লসের ক্ষমতায় আরোহণ- উভয় ঘটনাতেই তোপধ্বনি করা হয়েছে। রানির মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় দিনে, নয় সেপ্টেম্বর, লন্ডনের হাইড পার্ক থেকে ৯৬ বছরের রানির জীবিতকালের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, প্রতি বছরের জন্য একটি করে তোপধ্বনি করা হয়।

ঘণ্টা বাজানো
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরের দিন চার্চ অব ইল্যাণ্ডের সব চার্চ, চ্যাপেল এবং ক্যাথেড্রালগুলো তাদের ঘণ্টা বাজিয়েছিল।

কোন রাজা বা রানির মৃত্যু হচ্ছে সেসব বিরল ঘটনাগুলোর একটি যখন সবগুলো ঘণ্টা এমন একটি কৌশলে বাজানো হয়, যাতে প্রতিধ্বনি তৈরি হয়। কিন্তু পরে নতুন রাজাকে স্বাগত জানাতে প্রতিধ্বনি ছাড়াই ঘণ্টাগুলো স্বাভাবিকভাবে বাজানো হয়।

ইংল্যান্ডে এই রীতি অন্তত সপ্তম শতাব্দী থেকে চলে আসছে বলে মনে করা হয়। কারণ সেই সময়কার খ্রিস্টান সাধক হিল্ডা অব হুইটবির মৃত্যুতে এভাবে ঘণ্টা বাজানো হয়েছিল বলে সাধু ভেনারেবল বেডের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে।

রাজপরিবারের জন্য অনন্য একটি ঐতিহ্য হলো উইন্ডসর ক্যাসেলে সেবাস্টোপল ঘণ্টা বাজানো। ১৮৫৬ সালের ক্রাইমিয়ান যুদ্ধের সময় রাশিয়ানদের কাছ থেকে এই ঘণ্টাটি ছিনিয়ে আনা হয়েছিল এবং সেবাস্টোপলের চার্চ অব দ্যা টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস থেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

রানির মৃত্যুর পরদিন তার আয়ুষ্কালের প্রতিটি বছরের জন্য একবার করে ঘণ্টাটি বাজানো হয়েছে। রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র এই রীতি অনুসরণ করা হয়। সর্বশেষ ২০০২ সালে রানির মায়ের মৃত্যুর স্মরণে এই ঘণ্টাটি বাজানো হয়েছিল।

বাকিংহাম প্যালেসের বিজ্ঞপ্তি
একটি ছোট ও গাঢ় কাঠের ফ্রেমে সাঁটানো কাগজে লেখা একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় বাকিংহাম প্যালেসে রাজপরিবারের সদস্যদের জন্ম এবং মৃত্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় ঘটনাগুলি জনসাধারণকে অবহিত করা হয়।

কারো জন্মের ক্ষেত্রে ফ্রেমটি রাজপ্রাসাদের সামনের দিকে রেলিংয়ের ভেতরে একটি অলঙ্কৃত সোনার চিত্রফলকের ওপর স্থাপন করা হয়। তবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটি সাধারণত লোহার রেলিংয়ের বাইরের দিকে স্থাপন করা হয়।

১৯৫২ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং ১৯৩৬ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের ক্ষেত্রে একই ভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement