২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে ফাটল : বাসিন্দারা আতঙ্কে

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে ফাটল : বাসিন্দারা আতঙ্কে - ছবি : নয়া দিগন্ত

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় উপহারের ঘরে ছয় মাস না যেতেই ফাটল দেখা দিয়েছে। উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়নের নওয়পাড়া ও কালিশাকান্দা ও পাইকুরাটি ইউনিয়নের সুনই মজিবনগর গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামে নির্মিত বেশ কয়েকটি ঘরেই ফাটল দেখা দিয়েছে।

যার মধ্যে ১০টি ঘর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। ঘরগুলোর মেঝে, ভিট, দেয়াল ও রান্নাঘরে ফাটল ধরেছে। এর মধ্যে দুটি ঘরের ভিট ধসে গেছে। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ঘরগুলো থেকে বাসিন্দারা অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এতে এসব ঘরে থাকা সুবিধাভোগী নিম্নবিত্ত মানুষগুলো আছেন আতঙ্কে। স্থাানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঘর নির্মাণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঘরগুলো দ্রুতই মেরামত করা হবে। নির্মাণকাজের ঠিকাদারি পেয়েছেন ইউএনও-এর বড় ভাই টুটুল মিয়া। উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে।

সরেজমিন কয়েক নির্মাণ শ্রমিকের সাথে কথা বলে পুরোটা স্বীকার না করলেও কিছুটা সত্য বলে তারা নিশ্চিত করেছেন।

প্রকল্প এলাকার রাজমিস্ত্রি আব্দুল বারেক বলেন, ‘ভাই আমরা তো ইট নিয়ে আসছি না। ইটসহ সকল সামগ্রী নিয়ে আসতেছে ইউএনও স্যারের ভাই টুটুল মিয়া। ইট ২ নম্বর না ১ নম্বর সেটি দেখা আমাদের দায়িত্ব নয়, কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। কাজের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকতা উপস্থিত নেই কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে ইউএনও স্যারের ভাই টুটুল ভাই এসে কাজ দেখে যান। আবার কোনো কোনো সময় ইউএনও আসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার মধ্যনগর ও পাইকুরাটি ইউনিয়নের সুনই মজিবনগর, খালিশাকান্দা, মাসকান্দা গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামে আশ্রয়ন প্রকল্পের প্রকল্প-২ ‘ক’ তালিকার গড়ে উঠা ১২০টি ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে এমন ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। ঘর পাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর চোখে মুখে এখন দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের (আশ্রয়ণ প্রকল্প-২) ‘ক’ তালিকার গৃহহীন ও ভূমিহীন অসহায় পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে গত অর্থবছরে ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলায় মধ্যনগর, জয়শ্রী, চামরদানী, ইউনিয়নের পরিবারকে ১২০ সেমিপাকা ঘর তৈরি করে দেয়া হয়।

প্রতিটি ঘর তৈরিতে বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। প্রথম পর্যায়ে নির্মিত এসব ঘর গত ২৩ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উপকারভোগীদের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়। সেমিপাকা দুই ক বিশিষ্ট এসব ঘরে একটি রান্নাঘর ও টয়লেট রয়েছে। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই ঘরগুলোতে ফাটল দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি হলে চাল দিয়ে পানি পড়ছে। ঘর তৈরিতে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও টাকা লুটপাটের অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: মুনতাসির হাসান। কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) প্রজেশ চন্দ্র দাস।

উপকারভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘর দেয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু ঘরে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করেন ঠিকাদাররা। বৃষ্টি শুরু হলেই ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকাংশ ঘরের মেঝে ও পিলার ফেটে গেছে। এসব ঘর বেশি দিন টিকবে না।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মো: শফিকুল ইসলাম ও কলেজ মিয়া জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘর পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। তার জন্য দোয়া করি। কিন্তু আমাদের ঘরগুলো নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আমাদের ঘরের সামনের তিনটা পিলার ফেটে গেছে। কখন ভেঙে পড়ে, চিন্তায় আছি। খুব আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি আমরা।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা মন্নাফ আলী ফকির বলেন, ‘ঘরের বিটে ফাটল ধরেছে। চাল দিয়ে পানি পড়ে। এখানের প্রায় সবগুলো ঘরের একই অবস্থা। কোনোটির পিলার ফেটে গেছে, কোনোটির চাল দিয়ে পানি পড়ে, কোনোটির মেঝে ফেটেছে আবার কোনোটির দেয়ালে ফাটল ধরেছে। আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার না করলে দুর্ঘটনা ঘটবে।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা মোতালিব ও সোহাগ বলেন, ‘আমার ঘরের বিট ও রান্নাঘর, টয়লেট ভেঙে গেছে। থাকার কোনো অবস্থাা নেই। প্রায় সব ঘরের একই অবস্থা। কম সিমেন্ট দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে। এজন্য সব ঘরে ফাটল ধরেছে। ছয় মাসও গেল না। ঘরগুলোর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা শুক্কুর মিয়া বলেন, ‘ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে এসব ফাটল ধরা ঘরে থাকতে ভয় লাগছে। অনেকে ঘর ছেড়ে বাইরে থাকছে। আমরা ভূমিহীন গরিব মানুষ বলেই ঘর পেয়েছিলাম। কিন্তু, এমন ঘর পেলাম যে ঘরে থাকা এখন ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। সেইসাথে আমাদেরকে ভালো মানের ঘর তৈরি করে দেয়া হোক। আর যারা ঘর নির্মাণে অনিয়ম করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছি।’

উপজেলা নির্মাণশ্রমিকের সভাপতি আব্দুল সিদ্দিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার এলাকার শ্রমিকদের হাতে কাজ না থাকায় তারা খেয়ে না খেয়ে আছে। তাদের পেটের ভাত মেরে বর্তমান ইউএনও স্যার তার নিজ জেলার শ্রমিক এনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ করছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর নির্মাণকাজে ইট, বালু, সিমেন্ট, দরজা, জানালা, টিন কাঠসহ যাবতীয় মালামাল উপজেলা প্রশাসনের তদারকিতে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ সব অনিয়ম যেন দেখার কেউ নাই।

এ বিষয়ে ঠিকাদার মো: টুটুল মিয়া বলেন, ‘আমি শুধু মিস্ত্রি দিয়ে কাজ করি। ইট, বালু, সিমেন্ট, দরজা, জানালা, টিন, কাঠসহ যাবতীয় মালামাল সরবরাহ করে উপজেলা প্রশাসন। এর মধ্যে কোনো সামগ্রী যদি নিম্নমানের হয়ে থাকে তার দায়-দায়িত্ব আমার নই। আপনি ইউএনও স্যারের সাথে যোগাযোগ করেন বলে তিনি ফোন কেটে দেন।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রজেশ চন্দ্র দাস বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে হয়তো বিভিন্ন ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে সরজমিন পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাা গ্রহণ করা হবে।

দু’দিনে একাধিকবার মোবাইলেফোন দিয়ে জানতে চাইলে ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মুনতাসির হাসান বলেন, ঘর নির্মাণে কোনো প্রকার অনিয়ম হয়নি। দ্রুত ফাটল ধরা ঘরগুলো মেরামত করে বসবাসের উপযোগী করে তোলা হবে।

জেলা প্রশাসক মো: জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব।’

উল্লেখ্য, মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে প্রায় ৫০০ ঘর ধর্মপাশা ও মধ্যনগর ভূমিহীনদের দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল