২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুনামগঞ্জে লক্ষমাত্রার ২৫ ভাগ ধানও কিনতে পারেনি খাদ্য বিভাগ

সুনামগঞ্জে লক্ষমাত্রার ২৫ ভাগ ধানও কিনতে পারেনি খাদ্য বিভাগ - নয়া দিগন্ত

করোনা আর হঠাৎ বন্যায় সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য বিভাগ সরকারী ভাবে ধান-চাল ক্রয়ের সময় ৪ মাসের মধ্যে ২ মাস পাড় হয়ে গেলেও এখনো লক্ষ্যমাত্রার ২৫ ভাগ ধানও ক্রয় করতে পারে নি। কৃষকের ধান এখন ফড়িয়াদের ঘরে। জেলা খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তারা আশাবাদি। কৃষকরা জানিয়েছেন, খাদ্য বিভাগ যে নিয়মে ধান কিনছে, তারা ধান চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না।

জেলার প্রায় ১শ’ মিল মালিককে চুক্তি মোতাবেক চাল দিতে না পারায় কারণ দর্শানো চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছর (বৈশাখ মাষে) সুনামগঞ্জে এবার প্রায় ১৩ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। ৩২ হাজার ২৬৪ টন ধান ক্রয় করবে সরকার। এছাড়াও ১৪ হাজার ৩০৯ চাল আতব ও ১৪ হাজার ৬৮৭ টন সিদ্ধ চাল কিনবে।

সুনামগঞ্জে এবার বাম্পার বোরো ফসল উৎপাদনের পরেও জেলা খাদ্য বিভাগ ২৯ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ১৯১ টন ধান, ২৪৩৫ টন সিদ্ধ ও ৩০১৩ টন অতব চাল কিনেছে। হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে ধান চাল কেনার এই করুণ অবস্থায় কৃষক নেতারা বলেছেন, সরকার যেভাবে, বা যে নীতিমালা মোতাবেক ধান কিনছে, ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব না।

ফেনার বাঁক গ্রামের কৃষক (গৃহস্ত) মো. বজলুর রহমান চৌধুরী বলে, আমি একজন কৃষক। সাড়ে ৭শ’ থেকে সাড়ে ৮শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছি। বাড়ি থেকেই ধান নিয়েছে ব্যাপারী। অন্য কৃষকরাও এভাবে বিক্রি করছেন। খাদ্য গোদামে ধান নিয়ে গেলে ময়েশ্চার, কম শুকনা ইত্যাদি নানা কথা বলে কোন কোন ক্ষেত্রে হয়রানিও করা হয়।

কৃষক রবিউল বলেন, গুদামে ধান নিয়ে যেতে পরিবহন খরচও বেশি লাগে। ধান শুকনা কি না এমন ঝামেলার জন্য ধান কৃষকরা গোদামে নিয়ে যেতে আগ্রহী নয়। যাদের নাম লটারীতে উঠেছে আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন তাদের ঘরে কি ধান আছে না অন্য দালাল রা তাদের নামে ধান দিচ্ছে গুদামে। কোন কোন কৃষক বলেন, ধান কেনার লক্ষমাত্রা পুরণ করতে হলে বড় বড় ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে শুকনো ধান কিনে নিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত ১০৪০ টাকা থেকে কিছু টাকা কমেও কেনা যাবে, অর্থাৎ পরিবহন খরচের টাকা কৃষকদেরই কম দেওয়া যেতে পারে। এতে কৃষকরাও অনায়াসে ধান বিক্রি করতে পারবে।

কৃষক হারুন মিয়া বলেন, লটারী বাদ দিয়ে উন্মুক্ত ভাবে ধান ক্রয় করলেও কৃষক সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে এবার ধান দিতে যাবে না। কারণ বাড়িতেই ৯শ’ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করছি। তাহলে পরিবহণ খরচ দিয়ে, তেল মালিশ করে, সরকারি দলের নেতাদের পিছু ঘুরে তদবির করিয়ে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান দিতে যাব কেন? সরকার আগে থেকেই আমাদের কথা ভাবেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, আমরা বলেছিলাম এবার মোট জাতীয় উৎপাদন কম হচ্ছে। অনেক জমি পতিত থাকছে, কৃষির প্রতি মানুষের অনিহা তৈরি হচ্ছে। সরকার তখন আমাদের কখা শুনেন নি। মোট জাতীয় উৎপাদন কম হওয়ায় কৃষকের ধান বিভিন্ন মাধ্যমে মিলে চলে যাচ্ছে। সরকার হয়তো কিছু চাল মিল মালিকদের কাছ থেকে নিতে পারবে। ধান কিনতেই পারবে না। ধান এখন কিনতে হলে গ্রামে গ্রামে-হাটবাজারে অস্থায়ী ক্রয় কেন্দ্র করে সহজ শর্তে ধান কিনতে হবে।

জামালগঞ্জে এক কৃষক আক্ষেপ করে জানান, আমি একজন বড় কৃষক। দলীয় ক্যাডার ও খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে নানাভাবে লাইন করে ধান দেওয়া লাগে। এজন্য ৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় অনেকে কার্ড বিক্রি করে দিয়েছেন। আপনা (সাংবাদিকরা) খোঁজ নিয়ে দেখুন সত্যতা পাবেন।

সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সিপিবি’র সভাপতি চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বলেন, সরকার বিদেশ থেকে ধান-চাল আমদানী করবে জানলাম। এটি সিদ্ধান্ত হবে ভুল সিদ্ধান্ত। কৃষককের বাড়ী থেকেই সহজ শর্তে ধান কেনা যাবে। কৃষকদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করলেই হবে, ধান গোদামে পৌঁছে দেবার খরচ কৃষকের। তাহলে লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ধান কেনা সম্ভব।

সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বড় ধানের আড়ৎ মধ্যনগরে বৃহস্পতিবার ২৯ জাতের ধান বিক্রি হয়েছে ৯৩৫ থেকে ৯৪০ টাকা এবং ২৮ জাতের ধান বিক্রি হয়েছে ৯৫৫ থেকে ৯৬০ টাকা মণ দরে। প্রতিদিন এই ধানের আড়তে এখন ১০ থেকে ১২ হাজার মণ ধান বেচা কেনা হচ্ছে বলে জানালেন আড়তের সাবেক সভাপতি জ্যোতির্ময় রায়।

জামালগঞ্জে খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা সালেহ আহম্মদ বলেন, জোন ক্লোজিং এর জন্য ধান কিনা কিছুটা সমস্য হয়েছে, আমাদের উপজেলা ৩৭ শ’ টনের কিছু বেশী ধান ক্রয়ের লক্ষমাত্রায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৮-৯ শ’ টন ধান কিনা হয়েছে। তবে সময় আছে হাতে লক্ষমাত্র পুরণ হবে আশা করি।

সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য কর্মকর্তা জাকারিয়া মুস্তফা দৈনিক নয়াদিগন্তকে বলেন, করোনা আর হঠাৎ বন্যার জন্য ধান ক্রয়ের কিছুটা সমস্য হয়েছে। আশা করি লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ধান কিনতে পারবো আমরা। বুধবার পর্যন্ত ৬ হাজার ১৯১ টন ধান কেনা হয়েছে। ৩০১৩ টন চাল আতব চাল ও সিদ্ধ চাল ২৪৩৫ টন কেনা হয়েছে। আমরা কৃষদের জানিয়ে দিয়েছি হয়রানিমুক্ত ভাবে ধান দিতে পারবেন। তারা যেন সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান নিয়ে আসেন। বড় কৃষক ৬ টন, ছোট কৃষকও ২-৩ টন ধান দিতে পারবেন।

চালের ক্ষেত্রে ৩০০ মিলের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। যারা কিছু দিয়েছেন তাদেরকে বুধবার তাগাদাপত্র দেওয়া হয়েছে। যারা একেবারেই দেন নি এরকম একশ’এর বেশি মিল মালিককে চুক্তি লঙ্ঘন কেন করছেন এ জন্য কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো হয়েছে। চুক্তি লঙ্ঘন করলে কালো তালিকাভুক্ত হবেন, সেটিও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement