২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘পলাশ রে তুই কইরে বাবা, আমার কইলজার টুকরা আয়’

কান্নায় ভেঙে পড়ছেন পলাশের মা-বাবা। - নয়া দিগন্ত

‘অউ বুঝি আমার পুয়ায় (ছেলে) আইয়া কইবো, মাগো পেটো ভুক (ক্ষিধা) লাগছে। আমারে জলদি (তাড়াতাড়ি) ভাত দেও। খালি (শুধু) পথরবায় (রাস্তাপানে) চাই। আমার কইলজার টুকরা আয়।’ পলাশরে তুই কইরে বাবা- বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন কুলাউড়ায় বর্বর শিশু হত্যার শিকার পলাশের মা সন্ধ্যা রানী কর। আর বাবা পরিমল শব্দকর পায়ে জড়িয়ে ধরেন। ছেলের বর্বর হত্যাকারীদের বিচার চাইতে। আর পলাশের ছোট ভাই বিকাশ মাত্র ৩ বছরের শিশু। বড় ভাইকে খোঁজে ফেরে দিনমান। রাতে না পেয়ে ভাই ভাই বলে কেঁদে কেটে ঘুমিয়ে পড়ে। গত ২০ দিন থেকে এই পরিবারের কান্না যেন থামছে না।

সরেজমিন নিহত পলাশের বাড়িতে গেলে যে কারো নিজেকে সংবরণ করা হবে দুস্কর। বাড়ির আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে পলাশের স্মৃতিচারণ করে পরিবেশকে করে তোলে আরও বিষাদময় ।

নিহত পলাশের মা সন্ধ্য রানী কর জানান, খেতে বসলে ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ভাত পেটে যায় না। ঘুমাতে গেলে মনে হয়, পলাশ আসেনি এখনও। এভাবেই প্রতিটি মুহুর্ত পলাশের স্মৃতি তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

নিহত পলাশের মা বাবার একটাই চাওয়া- আর যেন কোন মা বাবাকে এভাবে সন্তান হারাতে না হয়। পলাশের হত্যাকারিদের ফাঁসি চান তারা।

পলাশের বর্বর হত্যাকান্ডের বর্ণনা দেন পাশের বাড়ির মহিলা হাসনা বেগম। নিহত পলাশে হাত বাঁধা, হাটুর উপরে পা বাঁধা, মুখের ভেতরে হা করানো অবস্থায় পেছনে বাঁধা, পেন্ট ছিলো হাটু পর্যন্ত নামানো। পায়খানার রাস্তায় চালানো বর্বরতা চিহ্ন ছিলো স্পষ্ট। বাড়ির পাশের জমিতে ধান রোপনে আরেকজনকে সহায়তা করছিলো পলাশ। সেখান থেকে দোকানে যাবার কথা বলে ডেকে নেয় জাহেদ। পলাশ আর জাহেদ এক সাথে গেলেও। বিকেলে একা ফেরে জাহেদ। এসময় তার চোখে মুখে ছিলো ভীতির ছাপ। পলাশের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে উল্টো ঝাড়ি মারে। রাতে যখন সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহানের উপস্থিতিতে বৈঠক বসে তখনও সে পলাশের কথা অস্বীকার করে। পরদিন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জাহেদ ঘটনাস্থল গিয়ে পলাশের লাশ দেখিয়ে দেয়।

স্থানীয় লোকজন জানান, রাতে যদি পলাশের সন্ধান দিতো তাহলে হয়তো তাকে জীবিত উদ্ধার করা যেতো। পলাশকে বলৎকার করে জাহেদ ও রাহেল বাড়িতে এসে বিষয়টি মির্জান আলীকে জানায়। তখন পলাশ জীবিত ছিলো। পরে মির্জান আলীর নির্দেশে ফের ঘটনাস্থলে গিয়ে পলাশের মৃত্যু নিশ্চিত করে। স্থানীয় লোকজন জানান, ঘটনার পর থেকে মির্জান আলীতে বাঁচাতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সাবেক জনপ্রতিনিধি। প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্বও নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে সরেজমিন এলাকায় গিয়ে খুনিচক্রের বিরুদ্ধে পাওয়া যায় ভয়ঙ্কর তথ্য। খুনি রাহেলের চাচা ও জায়েদের বাবা মির্জান আলী একজন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। গাছ চোর থেকে একজন বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী এই মির্জান আলী। ফেন্সিডিল ও গাজার ব্যবসা থেকে তার হাজার হাজার টাকা আয়। সেই এলাকার দরিদ্র অসহায় মেয়েদের বিদেশ পাঠানোর সেই টাকার কারণে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের আয়ের উৎস মির্জান আলী হয়ে উঠে তাদের কাছের মানুষ। আর এলাকাবাসীর জন্য মুর্তিমান আতঙ্ক। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে দুই ছেলে নাহিদ (পলাতক) ও জাহেদ (জেলহাজতে)।

স্থানীয় লোকজন জানান, মির্জান আলীর দুই ছেলের কাছে স্থানীয় বাসিন্দারা অসহায়। দিনে দুপুরে তারা মানুষের ঘর থেকে মোবাইল, টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে যায়। গরিব মানুষ মুখ ফুটে প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। আর যারা বিচার প্রার্থী হয় এলাকার জনপ্রতিনিধিরা তাদের কোন বিচার করেন না। একাধিকবার হাতে নাতে ধরার পরও মেম্বার চেয়ারম্যানদের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোন সঠিক বিচার না করার কারণে এরা এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠে। এর আগেও মির্জান আলীর ছেলে একই এলাকার অপর এক শিশুকে বলৎকার করে। আর পলাশকে হত্যার আগে যে বলৎকার করা হয়েছে, যারা পলাশের লাশ দেখেছে, তারা সবাই বলতে পারবে।

এদিকে ঘটনার পর থেকে মির্জান আলীর স্ত্রী কমলা বেগম ও বড় ছেলে নাহিদ আত্মগোপনে আছেন।

কুলাউড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সঞ্জয় চক্রবর্তী জানান, আসামীরা পুলিশের কাছে, আদালতের কাছে এবং সর্বোপরি রিমান্ডে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা কথা স্বীকার করেছে। তবে বলাৎকার করেই শিশু পলাশকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে।

উল্লেখ্য, কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বালিচিরি গ্রামের পলাশ শব্দকর (৭) নামক প্রথম শ্রেণির এক শিশু শিক্ষার্থীর নিখোঁজের একদিন পর অর্থাৎ ০১ আগস্ট বৃহস্পতিবার লাশ উদ্ধার করা হয়। এঘটনার সাথে জড়িত জাহেদ আলী (১৫) ও তার বাবা মির্জান আলী (৪৫) ও রাহেল আহমদ (২৬) কে ৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ। 


আরো সংবাদ



premium cement