ভারতের ভোটের কালির যে গোপন রহস্য আজও ফাঁস হয়নি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৩ মে ২০২৪, ০৯:৪৭
ভারতে ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের জন্য চলছে ম্যারাথন ভোটগ্রহণ। গণতান্ত্রিক এই পরম্পরা শুরু হয়েছিল সাত দশকেরও বেশি আগে। দেশটিতে সংসদীয় নির্বাচনের এই দীর্ঘ ইতিহাসে বহু জিনিসই কালের নিয়মে পাল্টে গেছে। কিন্তু একটা ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ রীতি গত ৬৩ বছরে এক চুলও বদলায়নি। আর সেটা হলো ‘ভোটের কালি’!
ভারতে ভোট দেয়ার পর ভোটারদের আঙুলে যে ‘অমোচনীয়’ কালির দাগ লাগিয়ে দেয়া হয়, ১৯৬২তে দেশের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবার চালু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই পদ্ধতি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়েছে।
কোনো ব্যক্তি যাতে দু’বার ভোট না দিতে পারেন এবং ভোটগ্রহণে জালিয়াতি এড়ানো যায়, সেই লক্ষ্যেই ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন অমোচনীয় বা ‘ইনডেলিবল’ কালি ব্যবহারের এই পদ্ধতি চালু করেছিল।
ভারতে ভোট দেয়ার পদ্ধতি কিন্তু গত ২০-২৫ বছরে আমূল বদলে গেছে। আগে যেখানে ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রার্থীর নামের পাশে ছাপ দিয়ে ভোট দিতে হতো, এখন তার জায়গায় ইলেকট্রনিক ভোট যন্ত্র বা ইভিএমে বোতাম টিপে ভোট দিতে হয়।
পুরো দেশের নির্বাচনী ফলাফল জানতেও আগে যেখানে তিন-চারদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে আজকাল মোটামুটি একবেলার মধ্যেই বেশিরভাগ ফলাফল জেনে যাওয়া যায়।
কিন্তু ভোটগ্রহণের পদ্ধতিতে ভোটারের হাতে এই কালি দিয়ে দাগ টেনে দেয়ার রীতিটি বছরের পর বছর ধরে অবিকল একই রকম রয়ে গেছে!
এ কালির বিশেষত্ব কী?
আজও ভারতে লাখ লাখ ভোটার নিজের ভোট দেয়ার পর আঙুলের সেই দাগ দেখিয়ে গর্বভরে ছবি তোলেন বা সোশ্যাল মিডিয়াতে সেলফি আপলোড করেন।
বস্তুত ওই কালির দাগ দিয়েই তারা প্রমাণ করতে চান, তারা ভারতে গণতন্ত্রের উৎসবে সামিল হয়েছেন।
ভারতের নির্বাচনে যে বিশেষ কালিটি ব্যবহার করা হয়, তা আঙুলের উপরিভাগের ত্বকে কম করে ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টা এবং নখের কিউটিকলে কম করে দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
মজার ব্যাপার হলো, ভারতে অন্য সব ধরনের কালি বাজারে বা অনলাইনে কিনতে পাওয়া গেলেও এই ভোটের কালি মাথা কুটে মরলেও সাধারণ ক্রেতারা কেউই কিনতে পারেন না।
সারাদেশে শুধু একটি সংস্থাই এই কালি বানায়, তাদের নাম ‘মাইসোর পেইন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড’ বা এমপিভিএল।
আর তাদের কাছ থেকে কালি কিনতে পারে কেবল একটিই প্রতিষ্ঠান, সেটি হলো দেশের নির্বাচন কমিশন।
এই কালির যে গোপন ফর্মুলা, তা ভারতের ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি (এনপিএল) উদ্ভাবন করেছিল আর এটি উৎপাদনের দায়িত্ব পেয়েছিল এমপিভিএল।
মহীশূরের রাজাদের প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানিটি স্বাধীনতার পর কর্নাটক সরকার অধিগ্রহণ করে এবং আজও এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি ভোটের কালি বানিয়েই কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে চলেছে।
কালি বানানোর গোপন ফর্মুলা
বছর পাঁচেক আগে এমপিভিএলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ড: চন্দ্রশেখর ডোড্ডামনি ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকাকে জানিয়েছিলেন, ওই কালি বানানোর গোপন ফর্মুলা এমন কী তারও জানা নেই!
তিনি বলেন, ‘আসলে ওই ফর্মুলা আমারো জানার এক্তিয়ার নেই।’
‘নিয়ম অনুযায়ী কোম্পানির শুধু দু’জন সিনিয়র কেমিস্ট এটা জানতে পারেন আর তারা কেউ অবসর নিলে তাদের বাছাই করা উত্তরসূরিকে এটা জানিয়ে যান’, বলেছিলেন তিনি।
এমপিভিএল সংস্থা আরো জানিয়েছে, কোকা কোলা পানীয়র গোপন ফর্মুলার মতো তারা এটি লিখিত আকারে কোনো ভল্ট বা সেফে রাখে না। কিন্তু দু’জন সিনিয়র কেমিস্ট মুখে মুখে এটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রকাশ করে যান!
তবে একটা জিনিস মোটামুটিভাবে জানা আছে, এই কালিতে থাকে সিলভার নাইট্রেট নামে একটি রাসায়নিক উপাদান, যা চামড়ার প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে এমন একটি অধ:ক্ষেপ ফেলে, যেটি আঙুলের ত্বকের সাথে পুরোপুরি সেঁটে বসে।
আর যখনই কালি লাগানোর পর ভোটাররা বুথ থেকে বাইরে বেরোন, রোদের আলোতে আলট্রা ভায়োলেট রে তার ওপর পড়লেই বেগুনি কালির রঙ বদলে গিয়ে আরো গাঢ় কালচে-বাদামি চেহারা নেয়।
কোনো সাবান বা ডিটারেজন্ট ঘষেই তোলা যায় না সেই ‘অমোচনীয়’ কালির দাগ।
ভোটের কালি কিভাবে তোলা যায়, তা নিয়ে নানা ফিসফিসানির ‘টোটকা’ বাতাসে ভাসলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো ‘আ্যান্টিডোট’ বা প্রতিষেধক বের করা যায়নি সেটাও কিন্তু ঠিক। আর এ কারণেই আজ ৬২ বছর ধরে ভারতের নির্বাচনে বহাল তবিয়তে টিঁকে রয়েছে এই কালি।
কালি রফতানি বিদেশের ভোটেও
শুধু ভারতেই নয়, থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া কিংবা আফগানিস্তান থেকে নাইজেরিয়া, বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে এই কালি সে সব দেশের নির্বাচনের জন্য রফতানিও করেছে এমপিভিএল ।
পেরুর সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন ‘শাইনিং পাথ’ তো একবার হুমকিও দিয়েছিল, সে দেশে তাদের ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করে কেউ যদি ভোট দেন এবং তাদের আঙুলে ওই কালির ছাপ দেখা যায় তাহলে তাদের প্রাণেই মেরে ফেলা হবে!
২০০৪ সালে আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় অভিযোগ উঠেছিল ভারতের পাঠানো ওই কালি না কি আঙুল থেকে খুব সহজেই মুছে ফেলা যাচ্ছে আর সেই সুযোগে ভোটে অবাধে কারচুপি চলছে।
আসলে ওই কালি লাগানোর জন্য আফগানিস্তানে তখন যে মার্কার পেন ব্যবহার করা হয়েছিল তাতেই ত্রুটি ছিল বলে পরে জানা যায়।
২০১০ সালে সেই আফগানিস্তানেই পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় ভোট বয়কটের ডাক দেয়া তালেবান বাড়ি বাড়ি চিঠি পাঠিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, কারো আঙুলে ওই কালির দাগ দেখা গেলে সেই আঙুলই কেটে ফেলা হবে।
২০০৮ সালে মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে এই কালি ব্যবহারের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেলেও ভোটের মাত্র এক সপ্তাহ আগে কর্তৃপক্ষ কালি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়। কারণ তারা শেষ মুহূর্তে আবিষ্কার করেছিল, কারো আঙুলে কালির দাগ থাকার পরেও তাকে যদি ভোট দিতে না দেয়া হয় তাহলে সেটা সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী ‘অসাংবিধানিক’ হবে।
ওই একই বছরে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আবার দেখা গিয়েছিল, সরকার-সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী যাদেরই আঙুলে কালির দাগ দেখা যাচ্ছে না, তাদেরই ধরে ধরে পেটাচ্ছে।
ফলে এই কালির ব্যবহার নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা রকম বিতর্কও কিন্তু কম হয়নি!
ভারতে এবারে সাত পর্বের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আজ সোমবার চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৮৫টিতে ভোটের পালা সম্পন্ন হয়েছে ইতোমধ্যেই। এদিন ভোট নেয়া হবে আরো ৯৬টি আসনে। সারাদেশের ভোটগণনা হবে একইসাথে, আগামী ৪ জুন।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা