১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চাকরির নাম করে রাশিয়ার যুদ্ধে পাঠানো ভারতীয়দের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা

- ছবি : বিবিসি

গত বছর অক্টোবর মাসে ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে কেরালার ডেভিড মুথাপ্পানের। বিজ্ঞাপনটা ছিল রাশিয়ায় নিরাপত্তারক্ষীর চাকরির। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করলে মাসিক বেতন দেয়া হবে দুই লক্ষ চার হাজার রুবেল (২২০১ ডলার বা ১৭৩৯ পাউন্ড)।

দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালার পোজিহুর গ্রামের এই স্কুলছুট মৎসজীবীর কাছে অঙ্কটা বিশাল বলে মনে হয়েছিল।

কয়েক সপ্তাহ পর ২৩ বছরের এই যুবক গিয়ে পড়েন পূর্ব ইউক্রেনের রুশ নিয়ন্ত্রিত দোনেৎস্ক শহরের যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে তার অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে ডেভিড মুথাপ্পান বলেছেন, ‘চারিদিকে শুধু নাশকতা আর মৃত্যু।’

তিনি এবং কেরালার আরো এক ব্যক্তি চাকরির নামে প্রতারণার শিকার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে পড়েছিলেন। দু’জনেই গত সপ্তাহে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।

শুধু এই দুইজনই নন গত কয়েক মাসে একাধিক ভারতীয় ব্যক্তি একইভাবে এজেন্ট মারফত চাকরির নামে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর বাধ্য হয়েছেন রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।

এদের মধ্যে কয়েকজন ফিরে আসতে পারলেও অনেকেই এখনো রাশিয়াতে আটকে রয়েছেন বলে অভিযোগ। এখন পর্যন্ত কমপক্ষে দু’জন ভারতীয় এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন।

এদের মধ্যে বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন। বিভিন্ন কাজের বিনিময়ে অর্থের লোভ দেখানো হয়েছিল তাদের। সেনাবাহিনীতে সহায়কের কাজের প্রস্তাবও ছিল সেই তালিকায়।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রতারণা করে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার জন্য ‘রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের উপর ক্রমাগত চাপ দেয়া হচ্ছে’।

গত সপ্তাহে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বিষয়টিকে তাদের জন্য ‘গভীর উদ্বেগের’ বলে মন্তব্য করেছেন। বিবিসি মন্তব্যের জন্য ভারতে রাশিয়ান দূতাবাসকে ইমেল করেছে।

ডেভিড মুথাপ্পান কেরালায় তার গ্রামে ফিরে আসতে পেরে স্বস্তি বোধ করলেও যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি।

যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেহের বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল মাটিতে।’ এই দৃশ্য দেখে মৎসজীবীদের গ্রাম থেকে আসা যুবক বমি করতে থাকেন এবং সংজ্ঞাও প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন।

‘এরপর রাশিয়ান কমান্ডার আমাকে ক্যাম্পে ফিরে যেতে বলেন। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আমার কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল,’ বলেছেন মুথাপ্পান।

দূরবর্তী অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গিয়ে গত ক্রিসমাসে পা ভেঙ্গেছিলেন তিনি। ডেভিড মুথাপ্পান জানিয়েছেন তার পরিবার সেই সময় এর কোনো কিছুই জানতেন না। আংশিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠার আগে আড়াই মাস তিনি লুহানস্ক, ভলগোগ্রাম, রোস্তোভ- এর বিভিন্ন হাসপাতালে কাটিয়েছেন।

মার্চ মাসে কয়েকজন ভারতীয়স তাকে মস্কোর ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করতে সাহায্য করেন। তাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করে ভারতীয় দূতাবাস।

ডেভিড মুথাপ্পানের গ্রাম থেকে আনুমানিক ৬১ কিলোমিটার দূরে আঞ্চুথেঙ্গুতে থাকেন প্রিন্স সেবাস্টিয়ান। মৎসজীবী প্রধান গ্রামটির বাসিন্দা এই যুবকের অভিজ্ঞতাও একই- মানসিক বিপর্যয় এবং কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসা।

চাকরির এজেন্টের দ্বারা প্রতারণার শিকার হওয়ার পর গিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। রাশিয়ার দখলে থাকা পূর্ব ইউক্রেনের শহর লিসিচানস্কয়ে ৩০ জনকে নিয়ে তৈরি একটি বাহিনীতে মোতায়েন করা হয়েছিল তাকে।

মাত্র তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পর, সেবাস্টিয়ানকে ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছিল। সঙ্গে ছিল একটি আরপিজি-৩০ (হাতে ধরা যায় এমন ডিসপোজেবল রকেট-চালিত গ্রেনেড লঞ্চার) এবং বোমাসহ বেশ কয়েকটি অস্ত্র, যার কারণে দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে।

যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর মিনিট পনেরো পর হঠাৎ একটি ক্লোজ রেঞ্জ থেকে ছোড়া বন্দুকের গুলি ট্যাঙ্কের (যে ট্যাঙ্কে প্রিন্স সেবাস্টিয়ানরা ছিলেন) গায়ে ধাক্কা খেয়ে তার বাঁ কানের নিচে এসে লাগে। তিনি পড়ে যান। খানিক পরে বুঝতে পারেন একজন মৃত রাশিয়ান সৈন্যের উপরে পড়ে আছেন তিনি।

‘আমি আতঙ্কে ছিলাম, নড়তে পারছিলাম না। এক ঘণ্টা পর রাতের দিকে একটা বোমা বিস্ফোরণ হয়। এর ফলে আমার বাঁ পায়ে তীব্র আঘাত লাগে,’ বলছিলেন সেবেস্টিয়ান।

রক্তাক্ত অবস্থায় রাত কাটানোর পর কোনোমতে তিনি পালাতে সক্ষম হন। পরের কয়েক সপ্তাহ সেবাস্টিয়ান বিভিন্ন হাসপাতালে কাটান।

সুস্থ হওয়ার জন্য তাকে এক মাসের ছুটি মঞ্জুর করা হয়। এই সময় এক ব্যক্তির সাহায্যে ভারতীয় দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন। দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাকে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়।

সেবাস্টিয়ানের সঙ্গে আরো যে দু’জন রাশিয়া গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তাদের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। পেশায় তারাও মৎসজীবী। ওই দুই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা কিংবা সেবাস্টিয়ান গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

কেরালার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন তারা প্রিন্স সেবাস্টিয়ান, ডেভিড মুথাপ্পান এবং আরো দু’জনের কাছ থেকে এজেন্টের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ পেয়েছেন।

সেবাস্টিয়ান জানিয়েছেন তিনি ও তার বন্ধুরা একজন স্থানীয় এজেন্টের (ওই ব্যক্তি এখন পলাতক) সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন ইউরোপে চাকরির জন্য।

ওই এজেন্ট রাশিয়ার কথা বলেন। একই সঙ্গে মাসিক দুই লক্ষ টাকা (২৪০২ ডলার, ১৮৯৮ পাউন্ড) বেতনের নিরাপত্তা রক্ষীর কাজের প্রস্তাবকে ‘সুবর্ণ সুযোগ’ বলে আখ্যা দেন ওই এজেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান সেবাস্টিয়ান এবং তার বন্ধুরা। এরপর রাশিয়ান ভিসা তৈরির জন্য তিনজনের প্রত্যেকে সাত লক্ষ টাকা করে দেন ওই এজেন্টকে।

জানুয়ারির চার তারিখে তারা মস্কো পৌঁছান। সেখানে অ্যালেক্স নামে এক ভারতীয় এজেন্ট তাদের স্বাগত মালায়লম (সেবাস্টিয়ানদের মাতৃভাষা) ভাষায়। সেদিন রাতটা তিনজন কাটান একটা ফ্ল্যাটে।

পরদিন একজন ব্যক্তি তাদের ৩৩৬ কিলোমিটার দূরে কস্ত্রোমা-র সামরিক দফতরে নিয়ে যান। সেখানে রুশ ভাষায় লেখা একটি কন্ট্র্যাক্টে তাদের সই করতে বলা হয়। ওই ভাষা অবশ্য তাদের কেউই পড়তে বা বুঝতে পারতেন না।

শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তিনজন তাদের সাথে যোগ দেন। এরপর এই ছয়জনকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউক্রেনের সীমান্তে থাকা রাস্তোভ অঞ্চলে। তাদের পাসপোর্ট এবং মোবাইল ফোন নিয়ে নেন কর্মকর্তারা।

প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১০ জানুয়ারি। কিছুদিনের মধ্যে তাদের শেখানো হয় কিভাবে ‘হ্যান্ডহেল্ড অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গ্রেনেড’ ব্যবহার করতে হয়, আহত হলে কী করতে হবে।

এরপর তাদের ‘সেকেন্ডারি বেস’- এ নেয়া হয় যা ‘অ্যালবিনো পলিগন’ নামে পরিচিত। সেখানে পরের ১০ দিন দিন-রাত প্রশিক্ষণ চলে।

‘সব ধরনের অস্ত্র সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল,’ সেবাস্টিয়ান বলেছিলেন। ‘আমি অস্ত্রগুলোকে খেলনার মতো উপভোগ করতে শুরু করি।’ যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কঠিন বাস্তবতা তাকে আঘাত করে।

মাছ ধরাকেই আবারও নিজের জীবিকা হিসাবে বেছে নিতে চান সেবাস্টিয়ান। ‘যাদের কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলাম তাদের ফেরত দিতে হবে। আরো একবার নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হবে আমাকে,’ বলেছেন তিনি।

পোজিহুরের বাসিন্দা ডেভিড মুথাপ্পানো তাই স্থির করেছেন।

‘যাওয়ার আগে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আমি কথা দিয়েছিলাম টাকা উপার্জন করে ফিরব। একটা বাড়ি বানাবো বিয়ের আগে,’ বলেছিলেন তিনি।

মুথাপ্পানকে নিজের জীবন নতুনভাবে গড়তে হবে তাই আপাতত এই যুগল দুই বছর অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যুদ্ধে তাকে কাউকে হত্যা করতে হয়নি এটা ভেবেই খুশি এই যুবক।

‘একটা সময় মাত্র দুশো মিটার দূরে ছিল ইউক্রেনের সেনা। উত্তরে আমাদের আক্রমণ করতে বলা হয় কিন্তু আমি একটাও গুলি চালাইনি। কাউকে হত্যা করতে পারব না আমি।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement

সকল