২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইমরান খান কেন পাকিস্তানের মিডিয়া থেকে গায়েব হয়ে গেলেন?

গত বছর ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়- পরবর্তী নির্বাচন এবছর শেষের দিকে। - ছবি : সংগৃহীত

এটা অনেকটা পরাবাস্তব মুহূর্তই মনে হচ্ছিল। মঙ্গলবার রাতে লাইভ টিভি শো চলার সময় পাকিস্তানি উপস্থাপক কাশিফ আব্বাসি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে এক আইনজীবীর দায়ের করা একটি আইনি নোটিশের বিষয়ে কথা বলছিলেন।

আব্বাসি তার নাম উচ্চারণ করলেন, পরে আবার নিজেকে থামিয়ে দিলেন: ‘তিনি আর্টিকেল ছয় এর অধীনে ইমরান খানের বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন... আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন।‘

আমরা আব্বাসির সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।

গত সপ্তাহে ইমরান খানের নাম বা তার ছবি পাকিস্তানের মিডিয়াতে খুঁজে পেতে বা শুনতে বেশ কসরতই করতে হয়েছে।

এক মাস আগে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করাটা তার এই পতনের পেছনের প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। মঙ্গলবার (৯ মে) যখন খানকে ইসলামাবাদের একটি আদালত প্রাঙ্গন থেকে তুলে নেয়া হয়, তখন দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। অনেকেই শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করেছেন, আর অনেকেই ছিলেন সহিংস।

সামরিক স্থাপনা এমনকি লাহোরে অবস্থিত জ্যেষ্ঠ সেনা কমান্ডারের বাসভবনেও হামলা হয়েছিল। পুলিশ ওই সময় খানের হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেফতার করে এবং সামরিক বাহিনী বলেছিল যে মূল হোতাদের বিচার সামরিক আদালতে করা হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো অনেক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছিলো যে সেটা আসলে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

বুধবার (৩১ মে) পাকিস্তানের মিডিয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেমরা পাকিস্তানের সংবাদ চ্যানেলগুলোর জন্য একটি নির্দেশিকা পাঠায়। যেখানে ৯ মে’র ঘটনার কথা উল্লেখ করে সংবাদ চ্যানেলগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে ঘৃণা ছড়ায় এমন বক্তব্য যেসব ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দিয়ে থাকেন তাদের বিষয়ক যেকোনো সম্প্রচার থেকে যাতে চ্যানেলগুলো বিরত থাকে।

ওই নির্দেশিকার কোথাও ইমরান খানের নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু আমরা বেশ কয়েকটি টিভি স্টেশনের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি যারা আমাদেরকে বলেছে যে তাদের চ্যানেলে খুব পরিষ্কার ভাষায় বার্তা পাঠানো হয়েছে।

তারা আমাদের বলেছে, ইমরান খানের নাম উল্লেখ করা যাবে না, তার ছবি প্রচার করা যাবে না, তার কণ্ঠস্বর শোনানো যাবে না এমনকি চ্যানেলের টিকারেও এমন কিছু উল্লেখ করা যাবে না। যদি তাকে উল্লেখ করাটা একান্তই দরকার হয় তাহলে খানকে শুধু তার পদবী দিয়ে উল্লেখ করা যাবে, আর সেটি হচ্ছে তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান।

দুটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, তারা তাদের টিভি স্টেশনের মালিকের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন।

তারা জানিয়েছেন, চ্যানেলের মালিকদেরকে সামিরক এবং গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে এক বৈঠকের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা কী চায়।

‘তাদেরকে বলা হয়েছে, তার নাম রয়েছে এমন কোনো খবর প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না এবং এরপরেও যদি আপনি সেটি করেন তাহলে তার জন্য আপনি নিজেই দায়ী থাকবেন, পাকিস্তান টিভিতে কাজ করেন এমন একজন এই তথ্য জানিয়েছেন। মিডিয়ার সব ব্যক্তিই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।

বিবিসি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে এখনো উত্তর মেলেনি। পেমরার মহা-পরিচালক নির্দেশিকা পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কিন্তু তিনি বলেছেন যে ইমরান খানের নাম উল্লেখ না করার মতো কোনো নির্দেশনা চ্যানেলগুলোকে দেয়া হয়নি।

কোনো রাজনীতিবিদকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় ফেলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়, ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা নওয়াজ শরীফের বক্তব্য প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।

‘পাকিস্তানে সব সময়ই কোন না কোনভাবে সেন্সরশীপ ছিল,’ এক সাংবাদিক আমাকে বলেন। ‘আমি প্রায় সময়ই আইএসপিআর (সামরিক বাহিনীর প্রেস শাখা) থেকে ফোন পেয়েছি ইমরান খানের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার পরিণতি ভোগ করার বিষয়ে।‘

‘তখন আমাদের বিরোধীদলীয় কোনো নেতার সাথে কথা বলতে বেশ বেগ পেতে হতো কারণ তারা কারাগারে ছিল। এখন আমাদের পিটিআইয়ের পক্ষে কথা বলার জন্য কাউকে পেতে বেগ পেতে হয়। খানের শাসনামল এবং এখনকার সময়ের মধ্যে বড় পার্থক্য হচ্ছে এখন বৈধতা পেতে তাদের হাতে ৯ মে’র উদাহরণ রয়েছে।‘

এটি কিভাবে তাদের চ্যানেলের উপর প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে মিডিয়ায় যারা রয়েছেন তারা আমাদের সাথে কথা বলেছেন।

‘এখানকার শীর্ষ চ্যানেলগুলো বলছে, ‘আপনারা একে কিভাবে সামাল দেবেন?’ ভয়ের জায়গাটি হচ্ছে, চ্যানেলগুলো যদি পিটিআই সম্পর্কিত কোনো খবর না দেখায় এবং সরকারি সংবাদ সম্মেলনই বেশি করে প্রচার করে তাহলে তারা শিগগিরই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।’

‘বিপুল সংখ্যক মানুষ টিভি দেখে কারণ তারা ইমরান খান সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। তিনি যেদিন গ্রেফতার হন সেদিন দর্শক সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।’

প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে ছাড়া পেয়ে পিটিআইয়ের অনেক শীর্ষ নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তার দলটি থেকে পদত্যাগ করছেন। মিডিয়ার ওপর এই কড়াকড়ি মূলত চলতি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনের আগে ইমরান খানের প্রভাব কমিয়ে আনার অতি সাম্প্রতিক চেষ্টা মাত্র।

তবে এটিকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তার সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষন করেছেন।

ফাইসাল ভাওদা যিনি সাবেক পিটিআই নেতা এবং খানের সাবেক ঘণিষ্ঠ সহযোগী বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তার নাম প্রচারে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ঘুরিয়ে বলা হয়েছে।’ ২০২২ সালের শেষের দিকে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। ‘আইনগতভাবে দেখতে গেলে পেমরা কোথাও আনুষ্ঠানিকভাবে বলেনি যে এটা তার (ইমরান খান) সম্পর্কে বলা হয়েছে।‘

‘যারাই সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত, যেকোনো ধরণের সহিংসতার সাথে যুক্ত তাদেরকেই সংবাদ মাধ্যমে আনা উচিত নয়, এটাই এই দেশের মৌলিক আইন।’

‘বাস্তবিকপক্ষে এই চিত্র আসলে তার সাথে মিলে যায় কারণ তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সবকিছুর নির্দেশনা দিয়েছেন। সব সাক্ষী বলেছেন যে তারা তার কাছ থেকেই নির্দেশনা পেয়েছেন।’

এই বক্তব্যের বিরোধীতা করেছেন খান। তিনি বলেন, সহিংসতা গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল। যদিও তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।

মিডিয়ায় যারা রয়েছেন এবং যাদের সাথে আমরা কথা বলেছি তারা এই বক্তব্যকে হতাশাজনক বলে উল্লেখ করেছেন।

‘এটা অযৌক্তিক,’ একটি টেলিভিশন চ্যানেলে নিয়মিত অনুষ্ঠানে অংশ নেন এমন একজন একথা বলেন। ৯ মে সম্পর্কিত আলোচনায় তিনি অংশ নিতে পারেন কিন্তু তার ইমরান খানের নাম উচ্চারণ করার অনুমতি নেই।

‘আপনি যখন পৌঁছাবেন, তখন তারা আপনাকে বলবে রাজনীতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের হস্তক্ষেপের বিষয়ে কিছু বলা যাবে না কারণ তাদের শঙ্কা এতে তারা বিপদে পড়তে পারে। এমনকি আপনি যদি তার নামও উচ্চারণ করেন, দেরি হয়ে যাওয়ার কথা বলে তারা আপনার সম্প্রচার বন্ধ করে দেবে। এটা শুধুমাত্র একটা ভয়ের পরিবেশ, এমন মনে হয় যে আমরা যেন সামরিক আইনের অধীনে বাস করছি।’

রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক এবং গোয়েন্দা সংস্থাকেই সংক্ষেপে বোঝানো হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে তারাই (সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থা) সাম্প্রতিক এই কঠোর অবস্থার জন্য দায়ী।

পাকিস্তানের মিডিয়ায় কড়াকড়ি আরোপের নজির থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার্সের করা মুক্ত সংবাদমাধ্যমের তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০ তম।

‘আমি মনে করি, ৯ মে’র পর থেকে, মুশাররফের শাসনকাল থেকে আমাদের যে স্থান ছিল তা আমরা হারিয়েছে। আমরা মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়েছি,’ একজন সাংবাদিক আমাকে বলেন। ‘গত এক বছরে সামরিক বাহিনী যেভাবে টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রে সমালোচনার শিকার হয়েছে আমি এর আগে তা কখনো দেখিনি।‘

‘এখন আমার মনে হয় সেই জায়গাটি ফিরে পেতে আমাদের বছরের পর বছর এমনকি এক দশকের মতো সময় লেগে যেতে পারে।’

‘এটি একটি নজীরবিহীন অবস্থা,’ আরেকজন বলেন। ‘এটা আসলে নিজেরাই নিজেদের উপর সেন্সরশীপ আরোপ করার মতো, যা সবচেয়ে বেশি খারাপ। এটা নিজের আত্ম-সমালোচনা করার মতো, নিজের দলের আত্ম-সমালোচনা করার মতো। তারা কোনো কিছু ভুল করে ফেলতে পারে-এমন ভীতি নিয়ে তারা আমার কাছে আসে, এটা শিরোনাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিংবা কোনো অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে হয়ে থাকে। তারা ভয় পায় যে সেই অতিথি হয়তো ইমরান খানের নাম উচ্চারণ করে ফেলবে অথবা তারা বর্তমানে দলটিতে যা হচ্ছে তা নিয়ে সমবেদনা জানাতে পারে।’

‘এটা সিদ্ধান্তই নেয়া যায় না যে কাকে অতিথি করা যায়। আমরা আসলেই চাপে আছি।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু

সকল