২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিয়ানমারে জনপ্রিয় গায়িকার হত্যায় শঙ্কিত সেনাশাসনপন্থী সেলেব্রিটিরা

২৭ মার্চ সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপনে সেনা মুখপাত্র জেনারেল জ মিন টুনের সাথে লিলি নাইং চিয় - ছবি : বিবিসি

মিয়ানমারের গায়িকা লিলি নাইং চিয় মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক সপ্তাহ পর ইয়াঙ্গুনের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। অভিযোগ করা হয়, তিনি যে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করতেন, তার হত্যাকারীরা ছিল তার বিরোধী।

তার মৃত্যু শুধু সামরিক সরকারের সমর্থকদেরই শোকাহত করেনি, বরং সামরিকপন্থী মিডিয়ার সাথে যেসব সেলেব্রিটি কাজ করছেন তারাও হতবাক হয়েছেন।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার শীর্ষ নেতাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন ৫৮ বয়সী এই গায়িকা। এই সামরিক অধিনায়করা ২০২১ সালে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেন এবং দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেন। লিলি নাইং চিয় তাদের খবরাখবর যোগাতেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

তাকে হত্যার অভিযোগে দু’ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।

জানা যাচ্ছে, এই দু’জন সেনাবাহিনীর বিরোধী একটি গেরিলা গ্রুপের সদস্য ছিলেন যেটি মূলত শহর এলাকায় তৎপর রয়েছে। গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এদের একজনের দুই আত্মীয়কে দৃশ্যত প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হত্যা করা হয়।

চিয়’র হত্যা সরকারের হাই-প্রোফাইল সমর্থকদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ ঘটনা।

তার ওপর হামলার ঠিক চার দিন আগে মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের একটি চায়ের দোকানে আরেকজন সুপরিচিত জাতীয়তাবাদী এবং সামরিক সরকারের সমর্থক টিন্ট লুইনকে মাথায় গুলি করা হয়।

গত গ্রীষ্মে তার ওপর একটি গুলিবর্ষণের ঘটনায় প্রাণে রক্ষা পেয়ে তিনি এতদিন আত্মগোপনে ছিলেন।

৩০ মে সন্ধ্যায় ইয়াঙ্গুনের ইয়ানকিন এলাকায় তার বাড়ির বাইরে গাড়ি পার্ক করার সময় চিয় হামলার শিকার হন।

গাড়ির ভেতরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা তার মুখের একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হওয়ার পর প্রথমে খবরে বলা হয়েছিল তিনি মারা গেছেন।

কিন্তু আসলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয় এবং ৬ জুন ভোরে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে কোমায় ছিলেন।

তার পরিবার বিবিসিকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সরকারের তরফে এক বিবৃতিতে এই হামলাকে ‘একজন নিরপরাধ নারীর ওপর অমানবিক গুলিবর্ষণ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

সামরিক জান্তাপন্থী ১৭টি সংগঠন এই হত্যার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

একটি কট্টরপন্থী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠন মা-বা-থা এই ঘটনার পর উন্নত নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে।

লিলি নাইং চিয়’কে হত্যার অভিযোগে আটক দু’ব্যক্তি ইয়াঙ্গুনের একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠী, যার নাম স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, তার সদস্য বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

সিসিটিভি ফুটেজ থেকে কং জার নি হেইন নামের একজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। অন্যজনের নাম চিয় থুরা।

সন্দেহভাজনরা বিচারের জন্য এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন এবং সেনাবাহিনী দাবি করছে যে অভিযুক্তরা অপরাধ স্বীকার করেছেন।

সামরিক বাহিনী আরো অভিযোগ করেছে যে মিয়ানমারের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ডি নেইন লিন এই গোলাগুলির পেছনে রয়েছেন।

এই দু’ব্যক্তির গ্রেফতারের রাতেই কং জার নি হেইনের মা এবং চাচাতো ভাই ইয়াঙ্গুনে তাদের বাড়িতে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন।

তার ছোট ভাই এবং ছোট বোন আক্রমণ থেকে পালাতে সক্ষম হন।

সামরিক সরকারের সমর্থক একটি টিভি চ্যানেলের খবর অনুযায়ী, নিরাপত্তা বাহিনী এখন তাদের ‘বন্দুকধারীদের হাত থেকে রক্ষা করছে’।

কিন্তু কে বা কারা এই পরিবারটির ওপর হামলা চালিয়েছে সে সম্পর্কে নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কোনো গোষ্ঠীও এর দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি।

সামরিক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী চিয়’র সাথে শীর্ষস্থানীয় সেনা অধিনায়কদের দহরম-মহরম ছিল। প্রায়ই তাকে সরকারি অনুষ্ঠানে দেখা যেতো।

চিয়’র একটি গান মিয়ানমারের নববর্ষ উৎসব থিংইয়ানের অনানুষ্ঠানিক থিম সং হয়ে উঠেছিল।

চিয় সামরিক সরকারকে তথ্য যোগাতেন, এজন্যই তাকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে। তার বাড়ির মহল্লায় হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়ে যারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেন তিনি তাদের ভিডিও ফুটেজ সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করেছিলেন, যার ফলে প্রতিবাদকারীদের আটক করা হয়।

বিপ্লবী বাহিনীর সাথে জড়িত তরুণদের সম্পর্কেও তিনি সরকারকে খবর দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সামরিক অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে অং সান সু চি’র নির্বাচিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে (এনএলডি) ক্ষমতাচ্যুত হয়, তার ক’মাস পর নিউজ চ্যানেল সিএনএন এবং সাউথ-ইস্ট এশিয়া গ্লোব সংবাদপত্র যখন মিয়ানমার সফর করে তখন তাদের সাথে কথা বলার জন্য চিয়’কে বেছে নেয়া হয়।

সে সময় তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে তাকে গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিহ্নিত করে তার বাড়ির কাছে ল্যাম্পপোস্টে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে।

তিনি আরো বলেছিলেন, তার বাড়িতে ভাঙচুরও চালানো হয়েছে।

‘আমি সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করি এবং অভ্যুত্থানকে মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার আশেপাশের অধিকাংশ মানুষ এনএলডিকে সমর্থন করে এবং তারা আমাকে হত্যা করতে চায়,’ এই গায়িকা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এসব লোক জাতিকে ধ্বংস করতে চায়।’

এরপর কোনো কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন, কারণ কোন সেলেব্রিটিরা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছেন তাদের খবর তিনি সরকারকে জানিয়ে দিতেন যাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

সামরিক সরকারের হাতে আটক ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো এই অভিযোগ করছে।

মিয়ানমারের একজন খ্যাতনামা গীতিকার অং নাইং সান, যিনি গণতন্ত্রের সমর্থক, সোশ্যাল মিডিয়ায় চিয়’র সাথে দীর্ঘদিনের এক বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

গত সপ্তাহে চিয়’র হত্যার ছবি ফেসবুকে লাইক করার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়।

‘যেকোনো মৃত্যুই দুঃখজনক,’ ১ জুন এক ফেসবুক পোস্টে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘কিন্তু ব্যক্তিগত আঘাত ও ঘৃণার কারণে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।’

এক সময় এরা দু’জন ছিলেন ভালো বন্ধু, কিন্তু অভ্যুত্থানকে সমর্থন করার জন্য তিনি চিয়’র সমালোচনা করেছিলেন এবং ২০০৯ সালে ওই বন্ধুত্ব ভেঙে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় চি’র ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার ওপর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে, মন্তব্য করে কিংবা পোস্ট শেয়ার করার পর অন্তত ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশিরভাগের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ধারার ৫০৫(ক)এ অভিযোগ আনা হয়েছে।

এটি এমন এক আইন যাতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাল খবর প্রচার এবং উসকানি দেয়া একটি অপরাধ।

লিলি নাইং চিয়’র হত্যাকাণ্ড মিয়ানমারের সরকারপন্থী অন্যান্য সেলেব্রিটির মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দিয়েছে।

এদের মধ্যে কেউ কেউ ঘোষণা করেছেন যে তারা আর সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করবেন না।

কারণ তারা মনে করেন, তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই এবং যেকোনো দিন অস্ত্রধারীরা তাদের দরজায় এসে হাজির হতে পারে।

এদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো থেকে জানা যাচ্ছে, এরা একে অপরকে সাবধানতার সাথে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে বলছেন এবং ঘাড় গুঁজে থাকার জন্য সতর্ক করছেন।

মিয়ানমারের ‘রাজনৈতিক মাইনফিল্ড’-এ আটকে পড়া একজন হলেন মডেল ও অভিনেতা পেইং টাখোন, যিনি ২০২১ সালে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে যোগদানের জন্য তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করবেন এই শর্তে তাকে দ্রুত মুক্তি দেয়া হয়।

কিন্তু এপ্রিল মাসে নববর্ষের সরকারি উৎসবে যোগ দেয়ার পর থেকে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হচ্ছে।

‘রেন্ট বয়’ নামে তার একটি নতুন সিনেমার ট্রেলারের নিচে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা নানা রকম ক্ষুব্ধ মন্তব্য পোস্ট করেছেন।

কেউ কেউ তাকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, অন্যরা পোস্ট করেছেন : ‘আপনার লজ্জা হওয়া উচিত’ এবং ‘পাইং টাখোন এখন আর মিয়ানমারের জনগণের নায়ক নয় এবং তিনি এখন নৃশংস সামরিক জান্তার সহযোগী’।

এর জবাবে এই অভিনেতা ফেসবুকে তার ২৮ লাখ ফলোয়ারের প্রতি লিখেছিলেন, মিয়ানমার কোনো উন্নতি করছে না কারণ সে দেশের মানুষ একে অন্যের সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত।

তবে, তার ওই পোস্টটি কিছুক্ষণ পরই সরিয়ে নেয়া হয়।

গত এপ্রিলে ইয়াঙ্গুনের এক রেস্তোরাঁয় এক ব্যক্তি ছুরি নিয়ে ইয়োন লে নামের একজন র‍্যাপ গায়কের ওপর হামলা চালায়, কিন্তু তিনি অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে তিনি লিখেছিলেন, সশস্ত্র বাহিনীকে ভালোবাসা মানেই বেসামরিক সংস্থাগুলোকে ঘৃণা করা নয়।

‘আমি চরমপন্থা পছন্দ করি না। আমি সত্যিই চাই সবাই শান্তিতে থাকুন এবং ঐক্যবদ্ধ থাকুন,’ তিনি ওই পোস্টে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু চিয়’র মতো তাকেও সামরিক বাহিনীর চর হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তবে যেসব সেলেব্রিটি সরকারের সমালোচনা করেছেন তাদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে।

দেশে লাগাতার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য গত মাসে সামরিক সরকারকে উপহাস করেছিলেন র‍্যাপ গায়ক বিউ হার।

এজন্য ‘শান্তি বিঘ্নিত করা’ এবং ‘অপপ্রচার ছড়ানোর’ দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

তার বাবা বিখ্যাত সুরকার নাইং মায়ানমার ‘কাবার মা কেয়ায় বু’ গানটি রচনা করেছিলেন, যার অর্থ ‘বিশ্ব ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামবো না’।

এটি ছিল মিয়ানমারে ১৯৮৮ সালের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সঙ্গীত এবং এখন ২০২১ সালেও সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এই গানটি গাওয়া হয়ে থাকে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement