২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মণিপুর থেকে পালাচ্ছে ভিন রাজ্যের বাসিন্দারা, শরণার্থীর ঢল মিজোরামে

মণিপুর থেকে পালাচ্ছে ভিন রাজ্যের বাসিন্দারা, শরণার্থীর ঢল মিজোরামে। - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উপদ্রুত মণিপুর থেকে দেশের অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার। বিশেষ বিমানে তাদের নিরাপদে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এছাড়াও হিংসাকবলিত মণিপুর থেকে প্রায় ৬০০ মানুষ পার্শ্ববর্তী মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে, যারা প্রায় সবাই কুকি-চিন-মিজো জনগোষ্ঠীর মানুষ।

ভারতের যে সব রাজ্য মণিপুর থেকে তাদের ছাত্রছাত্রী বা লোকেদের সরিয়ে নিচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, সিকিম, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, দিল্লি বা মহারাষ্ট্র।

গত বুধবার থেকে অগ্নিগর্ভ মণিপুরে পরিস্থিতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সেনাবাহিনী ও আসাম রাইফেলস মিলে রোববার পর্যন্ত ওই রাজ্যের ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে।

মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, ওই রাজ্যের মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

মেইতেই সম্প্রদায়কে ওই মর্যাদা দেয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রের আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখতে হাইকোর্ট মণিপুর সরকারকে নির্দেশ দেয়ার পর থেকেই রাজ্যে সহিংসতার সূত্রপাত হয়। ইতোমধ্যে হাইকোর্টের ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে মণিপুরে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এমএলএ ডিনগাংলুং গাংমেই সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। তার আবেদনের ওপর সোমবার শীর্ষ আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

উদ্ধার অভিযান
ইম্ফলে কেন্দ্রীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন পশ্চিমবঙ্গের এমন ১৮ জন ছাত্রছাত্রী সোমবার সকালে ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌঁছায়।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে জানান, ‘নবান্ন কন্ট্রোল রুমে ডিসট্রেস কল পাওয়ার পরই ওই ছাত্রছাত্রীদের সরকারি খরচে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিমানবন্দরে আমাদের কর্মকর্তারা তাদের রিসিভ করেছেন ও সেখান থেকে তাদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

একইভাবে ত্রিপুরা সরকারও বিশেষ বিমান ভাড়া করে মণিপুর থেকে তাদের ২০৮ জন ছাত্রছাত্রীকে ফিরিয়ে এনেছে, যাদের বেশির ভাগই রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসে শিক্ষার্থী।

মণিপুরের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেও তারা আরো ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে পুলিশ পাহারা দিয়ে বিমানে আগরতলায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে।

অন্ধ্র প্রদেশেরও প্রায় ১৫০ ছাত্রছাত্রী মণিপুরে রয়েছে। তাদের উদ্ধারের জন্য বিমান ভাড়া করতে রাজ্য সরকার কেন্দ্রের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাহায্য চেয়েছে।

তেলেঙ্গানা সরকার এক ধাপ এগিয়ে ইম্ফলে ইতোমধ্যেই তাদের বিশেষ বিমান পাঠিয়ে দিয়েছে। তাদের রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরাও মণিপুর থেকে বাড়ি ফিরে আসছে।

মেঘালয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আম্পারিন লিংডো জানিয়েছেন, তাদের রাজ্যের ৬৭ জন ছাত্রছাত্রী শুক্রবার রাতেই গুয়াহাটিতে এসে নেমেছে। দ্বিতীয় দফায় আরো অনেককে ফেরানোর ব্যবস্থা করেছেন।

নাগাল্যান্ড সরকারও মণিপুরে বসবাসরত তাদের ৬৭৬ জনকে আসাম রাইফেলসের সাহায্যে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেছে।

সিকিমের যারা মণিপুরে পড়াশুনো করতেন, তাদেরও প্রায় সবাই কলকাতা হয়ে নিজেদের রাজ্যে ফিরে গেছে।

দিল্লি ও মহারাষ্ট্র সরকারও একই পদক্ষেপ নিচ্ছে, সোমবার সকালে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিংয়ের সাথে এ ব্যাপারে কথাও বলেছেন।

মিজোরামে শরণার্থীর ঢল
মণিপুরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সেখানকার কুকি জনগোষ্ঠীর মানুষরা দলে দলে পার্শ্ববর্তী মিজোরামের দিকে যেতে শুরু করেছে। মিজো, কুকি ও চিন-রা নিজেদের একই জাতিগোষ্ঠীর অংশ বলে মনে করে এবং ঐতিহাসিকভাবেই তারা একে অন্যের বিপদে প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে মণিপুরের কুকিরা এবারো মিজোরামে আশ্রয় পাচ্ছে।

মিজোরাম সরকার জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে রোববার পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মানুষ মণিপুর থেকে এসে তাদের রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী আইজল-সংলগ্ন জেলাতেই এসেছে ১৫১ জন। বিভিন্ন অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে তাদের মাথার ওপর ছাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তাছাড়া আসাম সীমান্তের কাছে কোলাসিব জেলাতে আরো ২২৮ জন ও মণিপুর লাগোয়া সাইতুয়ার জেলাতে আরো ২১৭ জনকে আশ্রয় দিয়েছে মিজোরাম।

মিজোরামে গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার থেকে আসা ৪০ হাজারেরও বেশি চিন শরণার্থী বসবাস করছে। সম্প্রতি তার সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়া আরো কয়েক শ’ শরণার্থী। ফলে মিজোরামে অনেক আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ছিল, এখন মণিপুর থেকে নতুন করে আসা শরণার্থীদের স্রোত ভারতের ওই ছোট রাজ্যটিকে নতুন করে আরো বেশি চাপে ফেলে দিয়েছে।

অমিত শাহর বক্তব্য
মণিপুরে সহিংসতা শুরু হওয়ার প্রায় ছ’দিন পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবশেষে ওই রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার মুখ খুলেছেন। গত কয়েক দিন ধরে তিনি দক্ষিণের রাজ্য কর্নাটকে ভোটের প্রচার নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।

ভারতের একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ দাবি করেছেন, মণিপুরের সার্বিক পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তিনি রাজ্যের সব অধিবাসীকে শান্তি বজায় রাখারও আবেদন জানান। আর হাইকোর্টের যে আদেশকে ঘিরে এ বিরোধের সূত্রপাত, সে বিষয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন।

অমিত শাহ বলেন, ‘আদালত একটি আদেশ দিয়েছে। এখন এটা নিয়ে সব স্টেক হোল্ডারদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা হবে এবং তারপরেই মণিপুর সরকার একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি পাশাপাশি এটাও বলব কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীরই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মণিপুরের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে এভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও গত কয়েক দিনের সহিংসতার জেরে রাজ্যেজুড়ে যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে তা সহজে থিতিয়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement