২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যাঙ্গালুরু কিভাবে হয়ে উঠল ভারতের সিলিকন ভ্যালি

ব্যাঙ্গালুরু কিভাবে হয়ে উঠল ভারতের সিলিকন ভ্যালি - ছবি : সংগৃহীত

দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালুরু যা একসময় ব্যাঙ্গালোর নামে পরিচিত ছিল, এই শহরটি বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য বিখ্যাত। এসব কোম্পানির কাজের ধরন ও কর্মীদের কারণে এখানে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ধরনের এক সংস্কৃতি।

ভারতের অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় এই ব্যাঙ্গালুরু শহরে অনেক দ্রুত ব্যবসা ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটে প্রযুক্তির কল্যাণে। এখানকার বিভিন্ন কোম্পানিতে যেসব প্রকৌশলী ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদ কাজ করেন, তাদের রয়েছে বিশেষ কদর ও মর্যাদা। সুপরিচিত সব আন্তর্জাতিক টেক জায়ান্ট অনেক বেশি বেতন দিয়েও তাদেরকে কর্মী হিসেবে হায়ার করতে আগ্রহী।

কিন্তু ৫০ বছর আগেও বর্তমান ব্যাঙ্গালুরু শহরের চিত্রটা এরকম উজ্জ্বল ছিল না। প্রযুক্তির দিক থেকে এটি ছিল ভারতের পিছিয়ে থাকা অন্যান্য শহরের মতোই আরো একটি শহর।

এই শহরটি কিভাবে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং একপর্যায়ে হয়ে উঠল ভারতের সিলিকন ভ্যালি?

ইনফোসিসের সূচনা
ব্যাঙ্গালুরুতে গড়ে ওঠা এমন একটি সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নাম ইনফোসিস। শহরটিকে ভারতের সিলিকন ভ্যালিতে রূপান্তরিত করার পেছনে এই কোম্পানির অবদান উল্লেখ করার মতো।

‘একেবারে প্রথম দিন থেকেই আমরা কম খরচে বিশ্বাস করতাম। কারণ আমাদের কাছে প্রচুর অর্থ ছিল না। একারণে আমরা যে পাঁচ থেকে ছয়জন কাজ করতাম, তারা সবাই মিলে এক রুমের একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম,’ বলছিলেন ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি।

১৯৮০-এর দশকে গড়ে ওঠা এই ইনফোসিস বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর একটি।

কোম্পানির শুরুর দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে গিয়ে মূর্তি বলেন, সন্ধ্যার সময় আমরা সবাই একসাথে সময় কাটাতাম। সেটা ছিল অন্য রকমের আনন্দ। আমাদের মধ্যে কেউ রান্না করতো, কেউ সবজি কাটাকুটি করতো, কেউ হয়তো থালাবাসন ধোয়া-মোছা করতো। আমরা একটা টিমের মতো ছিলাম। সবাই মিলে অনেক মজা করতাম।

‘ভেবে দেখুন, আজকের দিনে এরকম একটি কোম্পানির আর্থিক মূল্য আট হাজার কোটি ডলার। এ থেকে বোঝা যায় ওইসময় আমরা যে কঠোর পরিশ্রম করেছি তার প্রতিদান আমরা পেয়েছি,’ বলেন তিনি।

নারায়ণ মূর্তির উদ্যোগ
নারায়ণ মূর্তির জন্ম ১৯৪৬ সালে, ভারতের কর্নাটক রাজ্যে, যা ব্যাঙ্গালুরু থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

নিজের পরিবারের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের পরিবারে ছিল ১১ জন। এটা ছিল একটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। হাই স্কুলের একজন শিক্ষকের বেতন দিয়ে এত জনের সংসার পরিচালনা করা খুব এটা সহজ ছিল না।

নারায়ণ মূর্তির জন্মের মাত্র এক বছর পরেই ১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশটির প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন।

এর আগে থেকেই দক্ষ প্রকৌশলী তৈরির করার জন্য ব্যাঙ্গালুরু শহরটির খ্যাতি ছিল। ভৌগলিকভাবেও দেশের মাঝখানে হওয়ার কারণে এই শহরটির ছিল বাড়তি কিছু সুবিধা।

পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ার কারণে, প্রধানমন্ত্রী নেহরু এই শহরে প্রযুক্তি খাত গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটা লাভবান হয়েছিল।

বিশাল বিশাল যন্ত্র
কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের আগ পর্যন্তও ভারত প্রযুক্তি বিষয়ক সুপার-পাওয়ার হয়ে উঠতে পারেনি।

ওইসময় আমরা যেসব যন্ত্র দেখেছি সেগুলো ছিল বিশাল আকৃতির। একটি ছিল দুই ফুট বাই তিন ফুট, বলেন নারায়ণ মূর্তি।

’এক দিন আমার এক সহপাঠী বলল যে সে আমাকে কম্পিউটার দেখাতে নিয়ে যাবে। পড়ালেখার জন্য আমি যেখানে থাকতে গিয়েছিলাম সেখানে পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনেই সে একথা বলল।’

বদলে গেল যেভাবে
ওইসময় ভারতের বামপন্থী সরকার দেশটির বেশিরভাগ প্রযুক্তি শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু বয়সে তরুণ নারায়ণ মূর্তি, ওইসময় তার বয়স হবে ২৭-২৮, যখন ইউরোপ সফরে যান তখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে এই সিস্টেম বদলাতে হবে।

‘আমি প্যারিস থেকে অমৃতসরে চলে এলাম। ইউরোপে আমি দেখলাম যে চারপাশে সমৃদ্ধি। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দ্রুতগতির ট্রেনগুলো বেশ ভালোভাবেই চলছে। তখন থেকেই বামপন্থী আদর্শ এবং সমাজতন্ত্রের ওপর আমার বিশ্বাস ধসে পড়তে শুরু করল।’

তিনি বলেন, ‘তখনই আমি উপলব্ধি করলাম যে দারিদ্র থেকে একটি দেশের বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা যাতে তারা আরো বেশি করে সম্পদ ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে।’

নারায়ণ মূর্তি তখনই একজন উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

সফটওয়্যার উদ্ভাবন
ইনফোসিস এমন কিছু সফটওয়্যার তৈরি করলো যার সাহায্যে আমেরিকার একটি কোম্পানি কোনো একটি পোশাক তৈরির জন্য তাইওয়ানের অরণ্যে অবস্থিত পোশাক প্রস্তুতকারী একটি কারখানার কাছে কাস্টমার অর্ডার পাঠাতে পারে।

এই সফটওয়্যারের কারণে অর্ডার দেয়া এবং পণ্য ও সেবার জন্য মূল্য পরিশোধ করা অনেক বেশি দ্রুত ও সহজ হয়ে ওঠে।

কিন্তু তখনও ইনফোসিস প্রযুক্তি-খাতে ইতিহাস তৈরি করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির আরো বড় হয়ে ওঠার জন্য তাদেরকে ভারতের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বড় ধরনের লড়াই শুরু করতে হয়।

আকস্মিক পরিবর্তন
কিন্তু ১৯৯১ সালে হঠাৎ করেই সবকিছু বদলে গেল।

১৯৯৭ সালে প্রচারিত বিবিসির একটি তথ্যচিত্রে দেখানো হয় যে কয়েক বছর আগেও ভারতের ব্যাঙ্গালুরু শহর অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন এই শহরের চেহারা আমূল বদলে গেছে। এটি এখন ভারতের 'কম্পিউটার রাজধানীতে' পরিণত হয়েছে।

ভারত সরকার ১৯৯১ সালে উদার অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে ইনফোসিসের মতো বিভিন্ন কোম্পানি নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও বিধি-নিষেধ থেকে মুক্তি লাভ করে।

এর ফলে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে। প্রবেশ করে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভ বা ইন্টারনেট।

স্যাটেলাইট যোগাযোগ এবং ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তি কারণে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী কোম্পানিগুলো এতো কাছাকাছি চলে আসে যেন তারা পাশের রাস্তায় অবস্থান করছে।

নব্বই-এর দশকের মাঝামাঝি ইনফোসিসে কাজ করতেন এরকম একজন প্রযুক্তিবিদ বলেন হঠাৎ করেই তাদের কদর কেন এতো বেড়ে গিয়েছিল।

সামনের কাতারে ব্যাঙ্গালুরু
কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সামনের কাতারে চলে আসে। এর পরে গত কয়েক দশক ধরে তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং তখনই সারা বিশ্বের নজরে চলে আসে ব্যাঙ্গালুরু শহর।

এই শহরে যেসব প্রকৌশলী কাজ করেন সারা বিশ্বের প্রযুক্তিবিদরা তাদের ইর্ষার চোখে দেখেন।

নারায়ণ মূর্তি বলেন, ইনফোসিস যেদিন নাসডাকে তালিকাভুক্ত হলো, এটাই ছিল ভারতের প্রথম কোনো কোম্পানি যা নাসডাকে তালিকাভুক্ত হলো, সেদিন আমি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে নাসডাক এক্সচেঞ্জের অফিসে উঁচু একটা টুলের ওপর বসেছিলাম। নীল আর্মস্ট্রং-এর কাছ থেকে কিছু কথা ধার করে সেদিন আমি বলেছিলাম- নাসডাকের জন্য এটা একটা ছোট্ট পদক্ষেপ, কিন্তু ইনফোসিস ও ভারতের জন্য এটা একটা বিশাল লাফ দেওয়ার ঘটনা।

প্রযুক্তি বিপ্লব
এর পরে গত ৪০ বছরে ব্যাঙ্গালুরুতে প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটে গেছে।

কিন্তু শহরের এই পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি কি তখনকার ইউরোপের মতো হয়েছে যা নারায়ণ মূর্তি তার সফরে প্রত্যক্ষ করেছিলেন?

তিনি বলেন, আমাদের নাগরিকদের জীবন অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক হয়েছে। এখন অনেক ভালো হাসপাতাল আছে, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু এসব কি যথেষ্ট?

বর্তমানে ইনফোসিস বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির জন্য সফটওয়্যার তৈরি করে এবং ৫০টিরও বেশি দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তি সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে থাকে।

নারায়ণ মূর্তি ২০১৪ সালে ইনফোসিস থেকে অবসর নিয়েছেন।

বর্তমানে তার বেশিরভাগ সময় কাটে পদার্থ বিজ্ঞান ও কম্পিউটার সায়েন্সের ওপর বই পড়ে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
চীনা কোম্পানি বেপজা অর্থনৈতিক জোনে ১৯.৯৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে মৃত মায়ের গর্ভে জন্ম নিলো নতুন প্রাণ দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদ সমাবেশে কেউ মারা যায়নি : পুলিশ সুপার হামাসকে কাতার ছাড়তে হবে না, বিশ্বাস এরদোগানের জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিক নিরাপত্তার উদ্যোগ ভালো লেগেছে : সীতাকুন্ডে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১০ দেশের অংশগ্রহণে সামরিক মহড়া শুরু করল আরব আমিরাত গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের পর ২ হাজার ফিলিস্তিনি নিখোঁজ ৯ বছর পর সৌদি আরবে আসছে ইরানি ওমরা কাফেলা দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা : প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের হামলার নিন্দা হেফাজতে ইসলামের ভর্তি পরীক্ষায় জবিতে থাকবে ভ্রাম্যমাণ পানির ট্যাংক ও চিকিৎসক মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশীরা কারা?

সকল