২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া সেনা অফিসার কেন ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলেন

শাহবেগ সিং - ছবি - বিবিসি

সময়টা ১৯৭১ সালের জুলাই মাস।

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাবার সাথে দীর্ঘদিন সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছিলেন না ব্রিগেডিয়ার শাহবেগ সিংয়ের পরিবার। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর টেলিফোনে এই সংক্ষিপ্ত ঠিকানাটুকু পেলেন ‘মিস্টার বেগ, কেয়ার অব হাবিব টেইলরিং হাউস, আগরতলা’।

‘আমাদের উনি পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, চিঠিতে ভুলেও শাহবেগ সিং লিখবে না – কারণ আমি এখন মি. বেগ!’

‘আর আগরতলাতে ওই দর্জির দোকানের ঠিকানায় পাঠালেই সেই চিঠি আমার হাতে পৌঁছে যাবে’, প্রায় ৫২ বছর আগেকার সেই স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন শাহবেগ সিংয়ের ছোট ছেলে প্রভপাল সিং – যিনি এখন থাকেন দিল্লির উপকণ্ঠে ভিওয়াডি-তে।

নাম-পরিচয় গোপন করে সেনা কর্মকর্তা শাহবেগ সিং তখন পুরোপুরি ছদ্মবেশে। কারণ তিনি ভারতীয় সেনার পক্ষ থেকে একটি গোপন মিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত।

শিখরা যে লম্বা চুল পাগড়িতে বেঁধে রাখেন, সেই চুলও কেটে ফেলেন তিনি। কাজের প্রয়োজনে বিসর্জন দেন পাগড়িও। এবং সেই গোপন মিশনটা আর কিছুই নয় – পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীতে পরিণত করা।

এর কিছুদিন আগেই দিল্লিতে সেনা সদর দফতরে তলব করে ব্রিগেডিয়ার শাহবেগ সিং-কে এই বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান, জেনারেল স্যাম মানেকশ বা ‘স্যাম বাহাদুর’। সেই সিদ্ধান্তে সায় ছিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীরও।

কোনো লেফটেন্যান্ট জেনারেল বা মেজর জেনারেলের পরিবর্তে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার একজন অফিসারকে এই দায়িত্ব দেয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল ভারত গোটা অপারেশন-টাই খুব গোপন রাখতে চেয়েছিল।

পূর্ব সীমান্তে ভারত অন্তত কোনো যুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে না। বাকি দুনিয়াকে এটা দেখানোটা তখন খুব জরুরি ছিল।

স্যাম বাহাদুরের ‘ব্রিফ’ নিয়েই কাজে লেগে পড়েন শাহবেগ সিং ওরফে মি. বেগ। ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের কমপক্ষে চারটি রাজ্যে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিম দিতে শুরু করে দেন।

প্রাথমিকভাবে তার দায়িত্ব ছিল ডেল্টা সেক্টরে, অর্থাৎ পূর্ব ও মধ্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া। পরে ত্রিপুরা ছাড়াও আসাম, মেঘালয় বা মিজোরামের নানা জায়গায় গিয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন।

যুদ্ধের পর এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য শাহবেগ সিং-কে ‘পরম বিশিষ্ট সেবা পদকে’ও ভূষিত করা হয়। রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তাকে ওই পদক পরিয়ে দেন।

কিন্তু একাত্তরের সেই নায়ক ঠিক এক যুগ পর সেনাবাহিনী ছেড়ে হাত মেলান বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা ভিন্দ্রানওয়ালের সাথে, যার কিছুকাল পর ১৯৮৪ সালের জুন মাসে স্বর্ণমন্দিরে চালানো অপারেশন ব্লু স্টারে ভারতীয় সেনার হাতেই মৃত্যু হয় ভিন্দ্রানওয়ালের এই ‘সামরিক উপদেষ্টা’র।

একদিন ভারতের হয়ে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করা শাহবেগ সিং কেন আর কিভাবে শেষ পর্যন্ত ভারতের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরলেন এবং তাতে প্রাণও দিলেন, সে কাহিনী কোনো উপন্যাসের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়!

তাভলিন সিং-য়ের কথা
ভারতের সুপরিচিত লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক তাভলিন সিং-য়ের কাছে শাহবেগ সিং চিরকালই খুব আকর্ষণীয় একটি ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে থেকে গেছেন।

আর্মি পরিবারের মেয়ে তাভলিন সিং তার ‘দরবার’ নামের বইটিতে শাহবেগ সিং-য়ের জীবনের এই ‘রূপান্তর’ নিয়ে বিশদে লিখেওছেন।

১৯৮৪ সালে স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টারের মাত্র তিন-চার মাস আগে তিনি শাহবেগ সিং ও তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করেন।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তাভলিন সিং বলছিলেন, ‘অমৃতসরে স্বর্ণমন্দির লাগোয়া গুরু রামদাস সরাইয়ের একটা ছোট্ট ঘরে তারা তখন থাকতেন। এতটাই দুরবস্থা ছিল যে শাহবেগ সিংয়ের হার্টের ওষুধ কেনারও পয়সা ছিল না!’

‘কথিত এক দুর্নীতির দায়ে আর্মি তাকে বরখাস্ত করেছিল অবসর নেয়ার মাত্র একদিন আগে, ফলে তিনি পেনশনও পাচ্ছিলেন না।’

তাভলিন সিংয়ের মতে, এই দুর্নীতির অভিযোগটাও ছিল অতি তুচ্ছ।

তিনি জানাচ্ছেন, ‘দেরাদুনে শাহবেগ সিং একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। সেই বাড়ির জন্য ইঁট-সুড়কি তিনি আর্মির ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে গেছেন, স্রেফ এই অভিযোগে ঠিক অবসরের আগের দিন তাকে ডিসমিস্যালের চিঠি ধরানো হয়!’

অনেকেই অবশ্য মনে করেন, বেরিলিতে পোস্টেড থাকার সময় সেনা ব্যারাকের বেশ কিছু আর্থিক অসঙ্গতির ব্যাপারে অডিটের নির্দেশ দিয়েই সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়েছিলেন শাহবেগ সিং।

সে যাই হোক, তাভলিন সিং ধারণা করেছিলেন এই ক্ষুব্ধ জেনারেলকে যদি কোনোভাবে খালিস্তান আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরিয়ে আনা যায় তাহলে হয়তো স্বর্ণমন্দিরে রক্তগঙ্গা বওয়া ঠেকানো যাবে।

তাভলিন সিংয়ের কথায়, ‘এরপর আমি দিল্লিতে ফিরেই দেখা করি রাজীব গান্ধীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে বলি, জেনারেলকে আপনারা অন্তত পেনশনের ব্যবস্থাটা করে দিন!’

‘এটাও বলেছিলাম, মনে রাখতে হবে মুক্তিবাহিনী কিন্তু উনার হাতেই গড়া। এ মানুষটির অবদান ছাড়া আপনারা হয়তো বাংলাদেশ যুদ্ধে জিততেই পারতেন না।’

কিন্তু না। যেকোনো কারণেই হোক রাজীব গান্ধী পারেননি শাহবেগ সিংয়ের পেনশন চালু করতে, স্বর্ণমন্দিরে হত্যাযজ্ঞও ঠেকানো যায়নি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অবদান
কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঠিক কী এমন করেছিলেন শাহবেগ সিং, যা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের এক মারাত্মক গেরিলা-বাহিনীতে পরিণত করেছিল?

দিল্লিতে সামরিক গবেষক কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শৈলেন্দ্র সিং মনে করেন, ভারতীয় সেনার নানা ধরনের ডিভিশনে কাজ করার ব্যাপক অভিজ্ঞতাই তাকে প্রশিক্ষক হিসেবে এত সফল করে তুলেছিল।

সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাবার সিনিয়র সহকর্মী হিসেবেও শৈলেন্দ্র সিং তার ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার শাহবেগ সিং-কে দেখেছেন।

‘দীর্ঘদেহী, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটিকে আমার মনে আছে তার অ্যাগ্রেসিভ বডি ল্যাঙ্গুয়েজের জন্য। সাধারণ গল্প করার জন্যও সোফাতে এমনভাবে বসতেন, যেন উল্টোদিকের মানুষটির ওপর যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বেন’, হাসতে হাসতে বলছিলেন তিনি।

বিবিসি বাংলাকে তিনি আরো বলছিলেন, ‘আসলে নানা ধরনের লেথাল ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল শাহবেগ সিংয়ের, সেটাই তিনি মুক্তিবাহিনীকে শিখিয়ে দিতে পেরেছিলেন।’

‘প্যারাট্রুপার হিসেবে শাহবেগ সিং ছিলেন ভয়ডরহীন একজন মানুষ। এই নির্ভীকতাটা তিনি মুক্তিবাহিনীর ভেতরেও নিয়ে এসেছিলেন। আবার গোর্খা ব্রিগেডের অংশ হিসেবে তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর ঘাতক!’

গোর্খাদের অবিশ্বাস্য ‘কুকরি ড্রিলে’র কথা উল্লেখ করে শৈলেন্দ্র সিং জানাচ্ছেন, ‘সোজা কথায়, মুক্তিবাহিনীকে তিনি এটাই শেখাতে পেরেছিলেন প্রয়োজনে ঠাণ্ডা মাথায় শত্রুকে হত্যা করতেও দ্বিধা করবে না।’

শাহবেগ সিংয়ের আর একটি অনন্য কীর্তি ছিল মুক্তিবাহিনীতে ‘সুইসাইড বম্বার’ তৈরি করা, যারা গাছের ওপর থেকে শত্রুর ট্যাঙ্কে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত। তাদের কোমরে বাঁধা বোমার ধাক্কায় উড়ে যেত পাকিস্তানি ফৌজের সাঁজোয়া গাড়ি।

শৈলেন্দ্র সিংয়ের কথায়, ‘অল্পবয়সী বাচ্চা কয়েকটা ছেলে, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, তারা কিন্তু প্রাণের মায়া পর্যন্ত করেনি।’

‘এই পদ্ধতি এতটাই সফল হয়েছিল যে ভয়ে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক বাইরে বেরোতেই সাহস পেত না।’

ছেলের চোখে শাহবেগ
শাহবেগ সিংয়ের ছোট ছেলে প্রভপাল সিং নিজেও ভারতীয় সেনাতে ছিলেন, ক্যাপ্টেন পদে থাকাকালীন ব্যক্তিগত কারণে বাহিনী থেকে সরে দাঁড়ান।

ব্রিটিশ আমলে ‘কিংস কমিশন অফিসার’ হিসেবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলেন যে তরুণ শাহবেগ সিং, বাবার সেই বয়সের ছবিটাই আজো তার চোখে লেগে আছে।

‘একাত্তরের কথা তো আমরা জানিই, তার আগে ৪৮’ ও ৬৫’র পাকিস্তান যুদ্ধ, ৬২’তে চীন যুদ্ধ – সবগুলোতে ফ্রন্টলাইনে লড়েছেন বাবা।’

‘ব্রিটিশ আমলে যখন বার্মায় মোতায়েন ছিলেন, সিঙ্গাপুর মুক্ত করার অভিযানেও ছিলেন তিনি’, দিল্লি থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে নিজের বাড়িতে বসে বিবিসিকে বলছিলেন প্রভপাল সিং।

শাহবেগ সিং দুর্ধর্ষ অ্যাথলিট ছিলেন, মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে তখনকার ভারতীয় রেকর্ড স্পর্শ করেছিলেন– এই তথ্যও জানা গেল তার ছেলের কাছ থেকে।

বই পড়তে ভীষণ ভালবাসতেন – আর পাঞ্জাবি, ফার্সি, উর্দু, গোর্খালি, হিন্দি, ইংরেজি-সহ মোট সাতটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। এই তালিকায় সপ্তম ভাষাটা ছিল বাংলা – যা একাত্তরে অসম্ভব কাজে এসেছিল।

মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় তিনি যে বাংলাতেই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, সেটা তাই আশ্চর্যের কিছু নয়।

প্রভপাল সিং বলছিলেন, ‘আর কী শেখাননি তিনি তাদের? সেনা অফিসারদের গুপ্তহত্যা, স্নাইপার রাইফেল চালাতে শেখানো, ব্রিজ-কালভার্ট ওড়ানো,আর্মি কনভয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো, রসদ পৌঁছতে না-দেওয়া – সবই ছিল সিলেবাসে।’

‘বাবার তত্ত্বাবধানেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ধীরে ধীরে হাতিয়ার চালাতে শিখল, অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক কৌশলে হাত পাকাল।’

‘সামান্য ট্রেনিং নিয়েই তারা এক সময় টানেল ওড়াতে শুরু করল। চট্টগ্রাম বন্দরে একবার তো মুক্তিবাহিনী একসঙ্গে পাঁচটা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল’, বলছিলেন তিনি।

আগরতলার শাহবেগ সিংয়ের চালানো গোপন ট্রেনিং ক্যাম্পেই মুক্তিযোদ্ধারা শিখেছিল এই সব সামরিক কায়দাকানুন।

যেভাবে খালিস্তানিদের সংস্পর্শে
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুকাল পর শাহবেগ সিংয়ের পোস্টিং হয় উত্তরপ্রদেশের বেরিলিতে। সেনাবাহিনীতেও পদোন্নতি পেয়ে তিনি ততদিনে মেজর জেনারেল হয়ে গেছেন।

এই বেরিলিতে থাকাকালীন তিনি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় শাহবেগ সিং এমন কয়েকটি অডিটের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা আর্মি হাইকমান্ডে অনেকের পছন্দ হয়নি।

সেনাপ্রধানের পদ থেকে শাহবেগের প্রিয় বস ‘স্যাম বাহাদুর’ও ততদিনে অবসর নিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের ১ জুন সেনাপ্রধান হলেন জেনারেল তপীশ্বর নারায়ণ রায়না। যেকোনো কারণেই হোক শাহবেগ সিং যার খুব একটা সুনজরে ছিলেন না।

১৯৭৮ সালে অবসরের মাত্র একদিন আগে মেজর জেনারেল শাহবেগ সিংকে ধরানো হলো বরখাস্ত করার চিঠি।

কোনো কোর্ট মার্শাল ছাড়াই দুর্নীতির অভিযোগে তাকে বাহিনী থেকে ছেঁটে ফেলা হলো। বন্ধ হয়ে গেল পেনশনসহ সব অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা।

যখন ওই চিঠি তার হাতে আসে, শাহবেগ সিং এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন।

আত্মীয়-পরিজন পরিবৃত অবস্থায় ওই চরম ‘বেইজ্জতি’ তিনি কোনোদিন মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, ক্ষমা করতে পারেননি সেনা হাইকমান্ডকে। অপমানিত, ক্ষুব্ধ শাহবেগ সিং এর পরই আর্মির বিরুদ্ধে বদলা নেয়ার পণ করে বসেন।

তার জীবনে চরমপন্থী শিখ নেতা ভিন্দ্রানওয়ালের প্রবেশও ঠিক এই পর্বেই, আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাব বাস্তবায়নের নামে যিনি তখন কার্যত শিখদের জন্য পৃথক খালিস্তান গঠনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সামরিক ইতিহাসবিদ শৈলেন্দ্র সিং মনে করেন, জীবনের একটা খুব ‘দুর্বল মুহূর্তে’ ধর্মের সম্মোহন শাহবেগ সিংকে ধরে ফেলেছিল।

তিনি বলছিলেন, ‘সঙ্গে বোধহয় এই বঞ্চনাও উসকানির কাজ করেছিল যে তাকে কখনো কোনো সেনা ডিভিশনের কমান্ডের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এবং পাশাপাশি এটাও বলব, তাকে এমন একটা চার্জে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যেখানে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে মনে করতেন।’

ঠিক এই পটভূমিতে জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে নিজে থেকেই দূত পাঠিয়ে শাহবেগ সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, যে সম্পর্ক তার পরবর্তী জীবনে সাঙ্ঘাতিক প্রভাব ফেলেছিল।

শাহবেগ সিং এরপর ভিন্দ্রানওয়ালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার ছায়াসঙ্গীতে পরিণত হন। সাবেক এই সেনা অফিসার শিখ ‘গ্রন্থী’দের মতো বেশভূষা পরতে শুরু করেন, রাখতে থাকেন লম্বা দাড়ি।

‘আসলে এই হতাশ, ক্ষুব্ধ মানুষটির জন্য ধর্ম বোধহয় ক্যাটালিস্টের কাজ করেছিল। যিনি একটা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া ছিলেন’, বিবিসিকে বলছিলেন কর্নেল শৈলেন্দ্র সিং।

‘তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে আমার এতদিনের সেবার প্রতিদানে তোমরা যদি আমার সঙ্গে এই জিনিস করতে পারো তাহলে আমিও দেখিয়ে দেবো আমারো কতটা ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে!’

স্বর্ণমন্দিরে চক্রব্যূহ
পরে লখনৌর সিবিআই আদালতে শাহবেগ সিং যাবতীয় দুর্নীতির দায় থেকে মুক্তি পেলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

স্বর্ণমন্দিরকে ঘিরে শাহবেগ সিং তৈরি করে ফেলেছেন এক মারাত্মক চক্রব্যূহ– যেটা পরে ভারতীয় সেনাদের জন্য মৃত্যুফাঁদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল।

প্রভপাল সিং বলছিলেন, ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গেরিলা যোদ্ধা হো চি মিনের সঙ্গে লোকে তার তুলনা করত।’

‘আর স্বর্ণমন্দিরে ওনার স্ট্র্যাটেজিও ছিল খুব সহজ-সরল। জমিতে গর্ত খুঁড়ে রাইফেলগুলো মাটিতে সাজিয়ে ফায়ারিং করতে থাকো। সব গুলি শত্রুর পায়েই লাগবে, তাক করার কোনো দরকারই নেই।’

স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযানের সময় শুধু রাইফেল বের করে মেঝের লেভেল থেকে গুলি চালিয়ে গিয়েছিলেন শিখ রক্ষীরা। পরে দেখা গেছে হতাহত বহু ভারতীয় সেনারই বুলেট লেগেছিল হাঁটুর নিচে।

শাহবেগ সিংয়ের ছেলে আরো বলছিলেন, ‘তাছাড়া সাদা মার্বেলে মোড়া স্বর্ণমন্দিরে আপনি যদি কালো পোশাকের কমান্ডো পাঠান, তারা তো এমনিতেই আরো বেশি করে চোখে পড়বে।’

‘ভারতীয় সেনার প্ল্যানিংয়ে এটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, ন্যাশনাল কমান্ডোদের তারা কালো পোশাকে কেন পাঠিয়েছিল?’

অপারেশনের পর ভারত সরকারের প্রকাশ করা শ্বেতপত্রেই স্বীকার করা হয়েছে, স্বর্ণমন্দির অভিযানে ভারতের কমপক্ষে ৮৩ জন সেনা সদস্য ও কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন আরো অনেকে।

শাহবেগ সিংয়ের ধুরন্ধর স্ট্র্যাটেজিই যে ছিল এই নিহতের মূলে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও সবাই একমত।

তাভলিন সিং বিবিসিকে বলছিলেন, ‘স্বর্ণমন্দিরের ঠিক নিচে পুরো একটা ভূগর্ভস্থ শহরই আছে বলা যায়, যেখানে শস্য মজুত রাখার জায়গা-সহ আরো অনেক কিছু আছে।’

‘এই নিচের অংশটায় তিনি বহু স্নাইপার মোতায়েন করেছিলেন। আর মন্দির কমপ্লেক্সে ঢোকার পথগুলো নিয়েও আর্মির কোনো ধারণা ছিল না। তারা ঢুকেছিল মূল প্রবেশপথ দিয়ে, আর আক্ষরিক অর্থেই প্রায় কচুকাটা হয়েছিল’, বলছিলেন মিস সিং।

আসলে শাহবেগ সিং পুরো স্বর্ণমন্দিরটাকেই একটা দুর্ভেদ্য দুর্গের চেহারা দিয়েছিলেন, প্রহরীরা কেউ ছিল ছাদে বা মিনারে, কেউ আবার মাটির তলায়।

‘এই কারণেই ভারতীয় সেনাকে তারা প্রতিহত করতে পেরেছিল ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে’, বলছিলেন তাভলিন সিং।

মন্দির কমপ্লেক্সের ভেতরই আরো প্রায় ছয় শ’ সহযোদ্ধার সাথে প্রাণ হারান মেজর জেনারেল শাহবেগ সিং। ঠিক কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল, তা নিয়ে অবশ্য নানা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।

পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর ভৈরব দত্ত পান্ডের বাড়ির বাইরে তিন দিন পড়ে থেকেও তার পরিবার কিন্তু শাহবেগ সিংয়ের লাশ হাতে পাননি। ধর্মীয় রীতি মেনে তার শেষকৃত্যও তাই করা সম্ভব হয়নি।

তবে সেনাবাহিনী থেকে পেনশন না পেলেও শাহবেগ সিংয়ের ব্যাজ ও সেনা পদক কিন্তু কেড়ে নেয়া হয়নি।

ফলে ভারতীয় সেনার ইতিহাসে তিনি আজও মেজর জেনারেল শাহবেগ সিং, পিভিএসএম, এভিএসএম নামেই পরিচিত থেকে গেছেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement