২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বাল্যবিবাহের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আসামে গ্রেফতার ২ হাজার

বাল্যবিবাহের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আসামে গ্রেফতার ২ হাজার - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের পুলিশ বাল্যবিবাহ ঠেকাতে এখনো পর্যন্ত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করেছে। বাল্যবিবাহ করেছে, এমন কম বয়সী ছেলেরা যেমন এর মধ্যে আছে, তেমনই ধরা হয়েছে তাদের পরিবার আর কাজী– পুরোহিত যারা ওইসব বিয়ে দিয়েছেন, তাদেরও।

যেসব জেলায় অভিযান চলছে, তার মধ্যে মুসলমান-প্রধান জেলাগুলোও আছে। রাজ্যের একটি মুসলিম সংগঠন বাল্যবিবাহ রোধে এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছে, কিন্তু তারা বলছে শুধু পুলিশ দিয়ে নয়, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।

তবে আসামের এক মুসলিম রাজনীতিবিদ ও সংসদসদস্য এসব গ্রেফতারের বিরোধিতা করছেন।

অন্যদিকে যেসব পরিবারের পুরুষ বা কমবয়সী ছেলেদের পুলিশ নিয়ে গেছে, সেইসব পরিবারের নারীরা বা কমবয়সী স্ত্রীরা পড়েছেন বিপদে।

বাল্যবিবাহ রোধ আইনে অভিযুক্ত ৮ হাজার জন
আসামের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বিয়ের বয়স এবং কম বয়সে মাতৃত্বের বিপদ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সেই সূত্রেই তিনি এই সপ্তাহের গোড়ার দিকে ঘোষণা করেন যে বাল্য বিবাহের অপরাধে যুক্তদের একটা তালিকা করা হয়েছে।

আসাম পুলিশ বলছে ৪০০৪ টি বাল্যবিবাহের মামলা রুজু হয়েছে। এইসব মামলায় অভিযুক্ত আট হাজারেরও বেশি মানুষ।

সেই সব মামলার ভিত্তিতে শুক্রবার থেকে পুলিশ ধরপাকড় শুরু করে। শনিবার দুপুরে টুইট করে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা জানিয়েছেন, “আজ সকাল পর্যন্ত ২২১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই অভিযান ২০২৬ এর বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত চলবে।

শনিবার সন্ধ্যায় আসাম পুলিশকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, মোট গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৫৮।

যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহ রোধ আইনে মামলা হয়েছে, কিন্তু যেসব ঘটনায় বিয়ে হওয়া কিশোরীর বয়স ১৪-এর কম, সেইসব ক্ষেত্রে শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতনরোধ আইনেও মামলা করা হচ্ছে।

আসাম পুলিশের মহা নির্দেশক জি পি সিং বলছেন, “ধৃতদের মধ্যে ৫২ জন হলেন কাজী এবং পুরোহিত, যারা বাল্যবিবাহ দিয়েছিলেন। যত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার মধ্যে সবথেকে বেশি সংখ্যক ধরা পড়েছে বিশ্বনাথ, বাকসা, বরপেটা, ধুবরি, হোজাই আর কোকরাঝাড় জেলাগুলো থেকে।“

‘স্বামী আর ছেলেকে থানায় নিয়ে গেল’
বরপেটা জেলার হাউলি শহর লাগোয়া নগরজার গ্রামের এক বাবা আর ছেলেকে শুক্রবার ভোররাতে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

বাবা নওশের আলি আর তার ছেলে লালচাঁদ বাদশার বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়েকে পুত্রবধূ করে সংসারে নিয়ে এসেছে। লালচাঁদ বাদশার মা কোহিনূর বেগম বিবিসি

বাংলাকে টেলিফোনে জানাচ্ছিলেন, “ছেলের বয়স ২১ হয়ে গেছে, আর বউয়ের বয়স এখন ১৯। ১৬ মাস আগে ছেলের বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বউয়ের বয়স কম বলে তাকে এখনও ঘরে আনিনি। এটা পুলিশ এসেও দেখেছে যে ঘরে বউ নাই। কিন্তু তাও স্বামী আর ছেলেকে থানায় নিয়ে গেল।“

“স্বামী বিকলাঙ্গ, কোনো রোজগারপাতি নাই। ছেলে হাজিরা দিয়ে কামাত আর আমি সুপারি কাটার কাজ করে কিছু পয়সা পাই। এখন আমাদের সংসার কী করে চলবে তাই বুঝছি না। ঘরে কেনো গার্জেন নাই,” বলছিলেন কোহিনূর বেগম।

এখন কেন অভিযান?
ভারতে বাল্যবিবাহ রোধ আইনটি ১৯২৯ সালের। তা সংশোধন করা হয় ২০০৬ সালে। সর্বশেষ আইন অনুযায়ী ছেলেরা ২১ বছরের আগে আর মেয়েরা ১৮ বছরের আগে বিয়ে করতে পারে না।

তবে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখ বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে ভারতে।

জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষাতে, ২০২২ সালের যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে দেখা গেছে যে সদ্যজাত মৃত্যুহারের দিক থেকে আসাম তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এক হাজার শিশু জন্মালে ওই রাজ্যে ৩২টি সদ্যজাত মারা যায়।

আসামের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী রঞ্জিত দাস বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “শুধু যে সদ্যজাত শিশু মৃত্যুর হার আসামে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, তা নয়। প্রসূতিকালীন জটিলতার কারণেও বাল্যবিবাহ হওয়া মায়েরা বিপুল সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন আসামে। মূলত অশিক্ষা, সচেতনতার অভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা এগুলো বন্ধ করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছি।“

“এছাড়াও জন বিস্ফোরণ কমাতেই হবে আমাদের। কমবয়সে বিয়ে হলেই সন্তান সন্ততির সংখ্যাও বেশি হবে, আর সেটা তো ভবিষ্যতে ভারতের জনসংখ্যাই বাড়াবে। সেটা তো নিয়ন্ত্রণ করা আশু প্রয়োজন,” বলছিলেন দাস।

কী বলছে মুসলিম সংগঠনগুলি
পুলিশের দেয়া তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, যেসব জেলায় সবথেকে বেশি বাল্যবিবাহের অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে গত কয়েকদিনে, তার মধ্যে অনেকগুলি এলাকাই মুসলমান অধ্যুষিত।

কিছু এলাকায় আবার মুসলমান এবং আদিবাসী সম্প্রদায় অধ্যুষিত।

যদিও মুখ্যমন্ত্রী বারেবারেই বলেছেন যে বাল্যবিবাহ রোধ আইনে এই গ্রেপ্তারি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে না।

আসামের মুসলমান সংগঠনগুলোও এই সরকারি অভিযানের বিরোধিতা করছে না।

অল আসাম মুসলিম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আমসু দীর্ঘদিন ধরেই মুসলমানদের মধ্যে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচারণা চালায়।

সংগঠনটির সভাপতি রেজাউল করিম সরকার বলছিলেন, “বাল্য বিবাহ রোধে সরকার যে কঠোর উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে আমরা স্বাগতই জানাচ্ছি। তবে এর সাথে একটা কথা বলতে চাই, আমরা যখন সংখ্যালঘু এলাকাগুলোতে বাল্যবিবাহের সমস্যা নিয়ে ৫ বছর আগে থেকে সরব হয়েছিলাম তখন কিন্তু সরকার বা পুলিশ বা স্বাস্থ্য দফতর কারও সাহায্য পাইনি।

"সরকারের কাছে আমরা অনেকবার আবেদন জানিয়েছি, তখন আমাদের কথা কেউ শোনেনি। গত পাঁচ বছরে আমরা অন্তত সাড়ে তিন হাজার বাল্যবিবাহ আটকিয়েছি, তখন আমরাই কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে গালি শুনেছি, মারধর খেয়েছি বিয়ে আটকাচ্ছি বলে।“

সরকার আরো বলছিলেন যে পুলিশ দিয়ে ধরপাকড় করে এত বড় সামাজিক সমস্যার সমাধান করাটা সম্ভব না। তার জন্য প্রয়োজন স্কুল কলেজগুলোতে সচেতনতা বৃদ্ধি আর সংখ্যালঘু এলাকাগুলোয় প্রচারণা চালানো।

“যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের বাইরে আরো কিছু মানুষকেও গ্রেফতার করা উচিত। অনেক চিকিৎসক বয়সের ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, অনেক উকিল বেআইনিভাবে বাল্যবিবাহকে আইনসম্মত করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন – এদেরকেও গ্রেফতার করতে হবে,” বলছিলেন আমসুর নেতা রেজাউল করিম সরকার।

মুসলমানদের হয়রানির অভিযোগ
শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন আমসু বাল্যবিবাহ নিয়ে সরকারের পাশে থাকলেও মুসলমান জনভিত্তি আছে এমন একটি রাজনৈতিক দল ইউডিএফ অবশ্য এসব গ্রেফতারকে মুসলমানদের হয়রানির জন্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে।

দলের সংসদ সদস্য ও 'আতর-সম্রাট' বলে পরিচিত ইউডিএফের প্রধান বদরুদ্দিন আজমল বলেছেন, “বাল্যবিবাহ রোধ আইন তো অনেক পুরনো। এতদিন ধরে সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি, কোনো প্রচারণা চালায়নি, এখন হঠাৎ গ্রেফতার করতে শুরু করেছে। এরপরে তারা বলবে বাল্যবিবাহে জড়িত ৯০ শতাংশই মুসলমান। আমরা চিনি মুসলমানবিরোধী এই সরকারকে।“

ক্ষমতাসীন বিজেপি আজমলের এই মন্তব্যকে সাম্প্রদায়িক বলে বর্ণনা করেছে। তারা বলছে, আজমলের দলের কাজই হলো সরকারের যে কোনো উদ্যোগেই সাম্প্রদায়িক রঙ খুঁজে বের করা।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement