২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ভারতের আমজনতার কাছে আদানি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ!

ভারতের আমজনতার কাছে আদানি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ! - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ নামে এক মার্কিন সংস্থা শেয়ার বাজারে ব্যাপক অনিয়ম ও হিসাবে কারচুপির অভিযোগ এনেছে। অভিযোগ খণ্ডন করতে আদানি গ্রুপের দেয়া বক্তব্যের চেয়েও, তারা যেভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে তা ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আদানি শিল্পগোষ্ঠীর চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) যুগশিনদার সিং ভারতের একটি বিশাল তেরঙ্গা জাতীয় পতাকাকে পেছনে রেখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ওই বিবৃতিটি দিয়েছেন।

গণমাধ্যম সংস্থা ব্লুমবার্গের ভাষায় ‘তাকে দেখে একটি কোণঠাসা ও অভিযুক্ত কোম্পানির কর্মকর্তা মনে হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল ভারত সরকারের তরফেই কেউ যেন বক্তব্য পেশ করছে।’

ওই ভিডিও-বিবৃতির মধ্যে দিয়ে আদানি গ্রুপ যে বার্তা দিয়েছিল তাও পরিষ্কার, একটি বিদেশী সংস্থা (ফরেন এনটিটি) যদি আদানিকে আক্রমণ করে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে তারা ভারতকেই নিশানা করতে চাইছে।

গত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা ও আদানি শিল্পগোষ্ঠীর প্রসার যেরকম সমার্থক হয়ে উঠেছে, তার ভিত্তিতেই তারা এতটা জোরের সাথে ওই দাবিটা করতে পারছে। পাশাপাশি এই তথ্যও ক্রমশ প্রকাশ পেয়েছে যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বীমা সংস্থাগুলোরও আদানি শিল্পগোষ্ঠীতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে।

ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও বৃহত্তম বীমা সংস্থা লাইফ ইন্সুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) এই তালিকায় অগ্রগণ্য। এসবিআই ও এলআইসিতে অ্যাকাউন্ট বা পলিসি নেই, ভারতে এমন পরিবার কার্যত নেই বললেই চলে।

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট প্রকাশের পর আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন শেয়ারের দর যেভাবে হু হু করে পড়তে শুরু করেছিল, তাতে ওই এসবিআই ও এলআইসির লগ্নি দারুণভাবে বিপন্ন বলেও অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

ঠিক এই কারণেই অনেকে মনে করছেন, ভারতে ‘আদানি ইজ টু বিগ টু ফেইল’-অর্থাৎ দেশে কোটি কোটি আমজনতার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এমনভাবে আদানি গোষ্ঠীর ভবিষ্যতের সাথে জড়িয়ে আছে যে আদানির কোনো বিপর্যয় রাষ্ট্র হিসেবে ভারত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

কেন আর কিভাবে আদানি শিল্পগোষ্ঠী সাধারণ ভারতীয়দের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রতিবেদনে তারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে।

উত্থান অনিবার্য ছিল
সুপরিচিত অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মিহির শর্মা মনে করেন, ভারত এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তাতে গৌতম আদানির মতো এক জাতীয় চ্যাম্পিয়নের উঠে আসা অবধারিত ছিল, যিনি অসম্ভব ঝুঁকি নেয়ার সাহস দেখাতে পারেন।

মিহির শর্মা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বহু বছরের। সম্ভবত সে কারণেই গৌতম আদানি আজ এই জায়গাটায় পৌঁছেছেন, তিনি না থাকলে এক্স, ওয়াই বা জেড অন্য কেউ ঠিক এই জায়গাতেই আসতেন।’

তিনি আরো বলেন, এটাই আসলে হওয়া ছিল। আরো অনেক দেশের মতো ভারতও কিন্তু উন্নয়নের জন্য পুরনো ধাঁচের শিল্পনীতি প্রণয়নের রাস্তায় হেঁটেছে, বাজারকে সাপোর্ট করবে এমন কোনো কাঠামোগত সংস্কারের দিকে যায়নি। এই ব্যবস্থায় গৌতম আদানিদের জন্ম হতে বাধ্য।

বস্তুত আজকের ভারতে বন্দর, রাস্তা, রেল, বিদ্যুৎ, এয়ারপোর্টসহ বৃহৎ অবকাঠামোখাতের সর্বত্র যেভাবে আদানি তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন, তাতে তারা ভারতের অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

মিহির শর্মা বলেন, ‘হিন্ডেনবার্গ কিন্তু এমন কোনো নতুন তথ্য দেয়নি যা ভারতের লগ্নিকারীরা জানতেন না। বহু বছর ধরেই তাদের জানা ছিল এই শিল্পগোষ্ঠীর যেটা ’ফালক্রাম’, ওই আদানি এন্টারপ্রাইজেস দেনায় ডুবে আছে। কিংবা আদানির অর্থায়নের উৎসটা যে খুবই অস্বচ্ছ, সেটাও অজানা কিছু নয়। তারপরও তারা আদানিতে টাকা ঢেলেছেন, এসবিআই বা এলআইসিও কিন্তু আদানির ওপর ফাটকা খেলতে দ্বিধা করেনি।’

মিহির শর্মা অভিমত জানান, সাম্প্রতিক ওই বিতর্কের পর আদানি গোষ্ঠী তাদের প্রকল্পগুলো ঠিকমত শেষ করতে পারবে কি না, অর্থাৎ বন্দর এয়ারপোর্টের কাজ ঠিক সময়ে শেষ হবে কি না কিংবা রাস্তা আদৌ তৈরি হবে কি না, সেটাই ভারতীয়দের জন্য বড় দুঃশ্চিন্তার বিষয়।

তিনি বলেন, আসলে সরকারের সমর্থন পাওয়ার বিরাট ভরসা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে পাশ কাটাতে পারার দক্ষতা ও বিরাট অঙ্কের অর্থলগ্নি করার ক্ষমতা এই ধরনের প্রোফাইল নিয়ে মোদির আমলে এত বড় মাপের আর কোনো শিল্পপতি ভারতে উঠে আসেননি।

মিহির শর্মা মন্তব্য করেন, ‘ফলে শুধু ‘টু বিগ’-ই নন, আমার মতে আদানি হলেন ‘টু ইউনিক’ টু ফেইল!’

লগ্নিকারীরা কি বিপদে?
আদানি শিল্পগোষ্ঠীতে ভারতের ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ অন্তত ৮০ হাজার কোটি রুপি (প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার) বলে ধারণা করা হয়। এই অঙ্কটি আদানির মোট ঋণের ৩৮ শতাংশের মতো।

তবে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে বৃহত্তম স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ ব্যাংকের যে লার্জ এক্সপোজার ফ্রেমওয়ার্ক আছে, আদানিতে তাদের এক্সপোজার তার চেয়ে অনেক নিচেই।

তাছাড়া এই লগ্নি ক্যাশ-জেনারেটিং অ্যাসেটের মাধ্যমে সুরক্ষিত বলেও তারা দাবি করেছে, তবে এক্সপোজারের নির্দিষ্ট পরিমাণটা তারা জানায়নি।

ভারতের বৃহত্তম বীমা সংস্থা এলআইসিও গত কয়েক বছরে আদানি গ্রুপের শেয়ারে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে।

ওই পটভূমিতে ভারতের বিরোধী বামপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র নেতা সীতারাম ইয়েচুরি টুইট করেছেন, ‘হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ সত্যি হলে যে কোটি কোটি ভারতীয় তাদের সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় এসবিআই ও এলআইসিতে জমা করেছেন, তাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।’

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ অভিযোগ করেছেন, এত কিছুর পরেও আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোকে বেইল আউট করার জন্য এসবিআই ও এলআইসির ওপর অব্যাহতভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে।

তিনি টুইটারে মন্তব্য করে, ভারতের শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই সব দেখেশুনেও উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নীরব।

কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা বি কে হরিপ্রসাদ সোমবার এক হিসাব দিয়ে বলছেন, এসবিআই ইতোমধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি রুপি ও এলআইসি সাড়ে ২৩ হাজার কোটি রুপি খুইয়েছে। ফলে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম আগামী দিনে কোন দিকে যায় সে দিকে কোটি কোটি ভারতীয় এখন চরম উৎকণ্ঠার সাথে নজর রাখছে। এদের অনেকেরই হয়তো নিজস্ব পোর্টফোলিওতে আদানির একটিও শেয়ার নেই, কিন্তু এসবিআই ও এলআইসি তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকেও আদানির ভাগ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেছে।

শেয়ার বাজারে প্রভাব
আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় শিল্পপতি ও শেয়ার বাজারের বিশেষজ্ঞ বিপ্লব পাল কিন্তু মনে করছেন, এই হিন্ডেলবার্গ বিতর্কের জেরে ভারতের শেয়ার বাজারে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।

তিনি বলেন, ভারতের শেয়ার মার্কেটে অ্যাক্টিভিস্ট শর্ট সেলার কম। ফলে ভারতের শেয়ার মার্কেটে জালিয়াতির সম্ভাবনা শতকরা একশো ভাগ। এর কারণ হল- ভারতের মার্কেট কন্ট্রোলাররা সবাই রাজনৈতিক পার্টির সমর্থনে ক্ষমতায় আসে। আদানির জালিয়াতি ভারতের মার্কেট কন্ট্রোলার (সেবি) ধরতে গেলে, সেবির চেয়ারম্যানের চাকরি নিয়ে আগে টানাটানি পড়বে।

বিপ্লব পাল বলেন, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতে মার্কেট কনফিডেন্স ফেরাতে হিন্ডেনবার্গ যে আহ্বান জানিয়েছে, ভারতে অ্যাক্টিভিস্ট শর্ট-সেলাররা আরো সক্রিয় হোক, যারা করপোরেট জালিয়াতি ধরবে এবং তার থেকে শর্ট সেলিং করে লাভ করবে। তা হলে কিন্তু মার্কেটের ওপর বিশ্বাস অনেক বাড়বে।

তবে পাশাপাশি তিনি এটাও বলছেন, আদানি গোষ্ঠীর দেউলিয়া হবার প্রায় সম্ভাবনা নেই, কারণ তাদের পোর্ট এনার্জি সিমেন্টের ব্যবসা বেশ ভাল রকম লাভেই চলে। শেয়ারের দাম কম হলেও, তারা মনোপলি ব্যবসার জন্য ধার শোধ করতে এখনো সমর্থ। সুতরাং জনগনের টাকা মার যাবে, ওই ভয় এখন নেই। আদানি কিন্ত ইনফ্রাস্টাকচারে টাকা ঢেলে টাকার সদ্বব্যবহার করেছে, যেটা ভারতের সবচেয়ে বেশি দরকার। ফলে স্বল্পমেয়াদে হয়তো ভারতের খুচরা বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির মুখে পড়বে, এসবিআই বা এলআইসির মতো কোম্পানিগুলোও কিছুটা বিপদের সম্মুখীন হবে। কিন্তু আদানি শিল্পগোষ্ঠীকে ঘিরে এই বিশাল বিতর্কের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে তা আন্দাজ করা সত্যিই মুশকিল!

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের সেতু ভাঙ্গার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে! নাশকতার মামলায় চুয়াডাঙ্গা বিএনপি-জামায়াতের ৪৭ নেতাকর্মী কারাগারে হারল্যানের পণ্য কিনে লাখপতি হলেন ফাহিম-উর্বানা দম্পতি যাদের ফিতরা দেয়া যায় না ১৭ দিনের ছুটি পাচ্ছে জবি শিক্ষার্থীরা বেলাবতে অটোরিকশা উল্টে কাঠমিস্ত্রি নিহত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন

সকল