২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তথ্যচিত্র ‘দি মোদি কোয়েশ্চেন’ : কতটা চাপে পড়েছে মোদি

তথ্যচিত্র ‘দি মোদি কোয়েশ্চেন’ : কতটা চাপে পড়েছে মোদি। - ছবি : সংগৃহীত

গুজরাটে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ২০২০ সালে দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ওপর বিবিসির দু’পর্বের একটি তথ্যচিত্র নিয়ে ভারতে তোলপাড় চলছে। ‘ইন্ডিয়া, দি মোদি কোয়েশ্চেন’ নামের অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রের প্রথম পর্বটি ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় ওই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোমির ভূমিকা নিয়ে।

আর নতুন বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালে দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এটার দ্বিতীয় পর্ব। ভারতে যেন তথ্যচিত্রটি দেখা না যায় তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার যে ধরনের নজিরবিহীন তৎপরতা শুরু করেছে, তাতে বিস্ময় তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে সারা বিশ্বে খবর হচ্ছে।

কিন্তু একটি সংবাদ মাধ্যমের একটি তথ্যচিত্র নিয়ে ভারতের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সরকারের মধ্যে এত মাত্রার স্পর্শকাতরতা এবং উদ্বেগ ঠিক কেন?

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা উড্র উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করছেন, অস্বাভাবিক নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তির প্রশ্নে তার দল, অনুসারী ও সমর্থকদের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে।

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, সন্দেহ নেই ভারতে মোদি খুবই জনপ্রিয়। তার ভাবমূর্তি অনেকটা কাল্টে (অতি মানবীয়) রূপ নিয়েছে। তাদের নেতার এই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ থাকার বিষয়টি তার সমর্থকদের ও সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু গুজরাট দাঙ্গায় মোদির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। বিবিসির তথ্যচিত্রে যা বলা হয়েছে, তার বেশিরভাগই পুরনো। সবই ভারতীয়দের জানা।

একটি বিষয় কিছুটা নতুন। তা হলো, দাঙ্গার পর তা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব একটি তদন্তের ফলাফলের কিছু অংশ প্রথমবারের মতো জানা গেছে। ব্রিটিশ ওই তদন্ত রিপোর্টে গুজরাটে ’জাতিগত হত্যাকাণ্ডের’ মতো শব্দ ছিল। বলা হয়েছে, ওই হত্যাযজ্ঞের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদি সরাসরি দায়ী ছিলেন।

অবশ্য এমন সন্দেহ-অভিযোগও নতুন কিছু নয়। যদিও ২০১২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের গঠিত বিশেষ তদন্ত কমিটি দাঙ্গায় মোদির সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খারিজ করে দেয়, তারপরো বিতর্ক থামেনি।

এসব সন্দেহ-বিতর্কে ভারতের রাজনীতিতে মোদির যে ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো প্রমাণ নেই।

বিশ্বনেতা হতে চাইছেন মোদি

তাহলে ওই তথ্যচিত্র ভারতের মানুষ দেখতে পেলেও কি খুব ক্ষতি হতো মোদি বা তার দল বিজেপির?

যদিও বিরোধী অনেক দল, বিশেষ করে বামপন্থীরা সরকারের রাখ-ঢাক নিয়ে সোচ্চার হতে শুরু করেছে, কিন্তু মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন না ওই তথ্যচিত্র অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদিকে আদৌ কোনো বিপদে ফেলবে।

কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি তো মনে করি তার বরঞ্চ সুবিধা হতে পারে। তার সমর্থকরা দেখছে বাইরে থেকে তার দেশের দুর্নাম করা হচ্ছে এবং মোদি শক্তভাবে তার জবাব দিচ্ছেন। এটা দেখে তার সমর্থকরা খুশি হবে, তার জনপ্রিয়তা তাতে বাড়তে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকারের বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের বাইরে থেকে কোনো প্রশ্ন-অভিযোগ ওঠানো হলেই বিজেপি সরকার রুটিনমাফিক শক্ত ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কৌশল মোদির সমর্থকরা পছন্দ করছে। তারপরও তথ্যচিত্রটি নিয়ে বিজেপি সরকার যা করছে, তাতে অবাক হচ্ছেন অনেক পর্যবেক্ষক।

কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি বিজেপি সরকার নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছে। যারা হয়তো ওই তথ্যচিত্র নিয়ে মাথাই ঘামাতো না, এত বাড়াবাড়ি দেখে তারাও এখন দেখার চেষ্টা করবে।

ভারত সরকারের এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে?

কুগেলম্যান মনে করেন যে বাইরের বিশ্বে তার ভাবমূর্তি নিয়ে মোদি এখন অনেক উদ্বিগ্ন। তিনি ভারতকে বিশ্বের দরবারে উঁচু জায়গায় বসাতে উদগ্রীব। ফলে, কিভাবে বাকি বিশ্ব তাকে দেখে তা নিয়ে মোদি উদ্বিগ্ন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই পর তিনি গুজরাট দাঙ্গার কারণে সৃষ্ট দুর্নাম ঘুচিয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখানে নতুন করে যে কোনো হুমকি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।

গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে দুর্নাম ঘোচানোর চেষ্টায় মোদি যে অনেকটাই সফল হয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই।

পশ্চিমা যেসব দেশ গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে সবচেয়ে খড়গহস্ত ছিল তারা কার্যত ওই পর্ব ভুলে গেছে। ওইসব দেশের সাথে মোদি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এমনকি তার সময়ে সৌদি আরব ও ইউএই-সহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথেও ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের বিশেষ অতিথি ছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাতাহ আল সিসি।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদায় বসানোর চেষ্টার সাথে মোদি নিজেও শীর্ষ সারির বিশ্ব নেতা হওয়ার চেষ্টা করছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও উচ্চাভিলাষের সুফল পাচ্ছেন তিনি।

২০১৪ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর ঘনঘন বিদেশ সফর করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক যেকোনো ফোরামে যোগ দেয়ার কোনো সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেন না।

কুগেলম্যান বলেন, সন্দেহ নেই মোদি চান বিশ্ব পরিসরে ভারতের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ুক। কিন্তু ওই সাথে নিজের মর্যাদা নিয়েও তিনি একইভাবে উদ্বিগ্ন। একজন বিশ্বনেতা হতে চাইছেন তিনি।

মধ্যবিত্তের বিশাল বাজার
ভারত সম্প্রতি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর জোট জি-টুয়েন্টির নেতৃত্ব পেয়েছে। এ বছরের শেষে দিল্লিতে ওই জোটের শীর্ষ বৈঠক হওয়ার কথা।

কিন্তু তার এই প্রয়াসের মাঝে গুজরাট দাঙ্গার মতো স্পর্শকাতর ঘটনা নিয়ে আবার কথা শুরু হয়েছে এবং এমন সময় ওই তথ্যচিত্র প্রচার হলো, যখন গত কয়েক বছর ধরে ভারতে সংখ্যালঘুদের অধিকার, গণমাধ্যমের অধিকারের প্রশ্নে বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে কম-বেশি সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে অ্যামনেস্টি ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থাগুলো ঘনঘন তাদের উদ্বেগ জানাচ্ছে।

দিল্লিতে গবেষণা সংস্থা বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন, এসময় ওই তথ্যচিত্র প্রচারের পেছনে সম্ভাব্য মতলব দেখছেন সরকার এবং ভারতের অনেকেই।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বিশ্ব মানচিত্রে ভারতের মর্যাদা যখন দিন দিন বাড়ছে, তখন এতদিনের পুরনো একটি বিতর্ক নতুন করে তোলাটাকে বহু মানুষ একবারেই ভালো চোখে দেখছে না। মানুষ ভাবছে এর পেছনে হয়তো কোনো মতলব আছে।

সন্দেহ নেই বিশ্ব পরিসরে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ভারতের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু তার কৃতিত্ব কতটা মোদি দাবি করতে পারেন?

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক উদারীকরণের জেরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যে অসামান্য অগ্রগতি ভারতে হয়েছে, তা গত দু’দশকে ভারতের গুরুত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বিচারে আমেরিকা ও চীনের পর, ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় দেশ। ভারতে বাড়ছে মধ্যবিত্তের সংখ্যা এবং তাদের ক্রয় ক্ষমতা।

ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা ওইসিডি মনে করছে, ২০৩০ সাল নাগাদ উল্লেখযোগ্য ক্রয় ক্ষমতার অধিকারী মধ্যবিত্তের সংখ্যায় আমেরিকা, চীন ও ইউরোপকেও ছাড়িয়ে যাবে ভারত। বিশ্বের ২৩ শতাংশ মধ্যবিত্তের বসবাস হবে ভারতে।

এমন একটি দেশের বাজারে ভাগ বসাতে সবাই যে উদগ্রীব তাতে সন্দেহ নেই।

চীন ফ্যাক্টর
সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রভাব নিয়ে চীন ও আমেরিকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান রেষারেষির কারণেও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কাছে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে।

চীনকে চাপে রাখার অন্যতম কৌশল হিসেবে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করেছে আমেরিকা। চীনা সীমান্তের কাছে যৌথ সামরিক মহড়া চালাতে শুরু করেছে দু’দেশ। আমেরিকা তাদের অত্যন্ত স্পর্শকাতর সামরিক গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করছে ভারতকে।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কাছে ভারতের গুরুত্ব বাড়ার পেছনে নিঃসন্দেহে চীন একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।

ভারত ও প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের গুরুত্ব তারা (আমেরিকা ও তার মিত্ররা) পরিষ্কার অনুধাবন করছে। একই সাথে তারা দেখছে চীনের সাথে ভারতও দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি দেশ।

মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন যে ভারতের গুরুত্ব বৃদ্ধির পেছনে দেশটির বাজার ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত কূটনীতি ও তৎপরতার গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।

সুতরাং গুজরাট দাঙ্গায় তার ভূমিকা নিয়ে এখন যে নতুন করে সোরগোল তৈরি হবে, তা মোদিকে বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

যে দু’টি দেশ ২০০২ সালে দাঙ্গার পর মোদি ওপর সবচেয়ে বেশি খড়গহস্ত হয়েছিল, বিবিসির তথ্যচিত্র প্রকাশের পর তাদের প্রতিক্রিয়া থেকেই তা অনুমান করা যায়। মার্কিন সরকার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে এই বিতর্কে তারা মাথা ঘামাতে চায় না।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইসকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিবিসির তথ্যচিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশীদার।

গত সপ্তাহে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এক এমপি ওই তথ্যচিত্রের কথা তুললে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন মোদিকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তার সাথে তিনি একমত নন।

শ্রীরাধা দত্ত ও মাইকেল কুগেলম্যান কেউই মনে করেন না, গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে বাকি বিশ্ব এখন আদৌ মাথা ঘামাবে।

এমনিতেই কোভিডের পরের অর্থনীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সবাই চাপের মধ্যে। এখন এই বিষয়টি কারোরই অগ্রাধিকারের মধ্যে নেই বলে আমি মনে করি, বলেন শ্রীরাধা দত্ত। কুগেলম্যানের মন্তব্য ছিল, অধিকাংশ দেশ অনেক আগেই গুজরাটের ঘটনা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে।

কিন্তু গুজরাট দাঙ্গা যে নরেন্দ্র মোদির কাছে এখনো কতটা স্পর্শকাতর বিবিসির ওই তথ্যচিত্রের প্রচারের পর আরেকবার তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement