২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারতের মোদি আর মিসরের সিসি কিভাবে এত কাছাকাছি এলেন?

দিল্লিতে প্রেসিডেন্ট সিসি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি - ছবি : সংগৃহীত

ভারতে বৃহস্পতিবার প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথির আসনে ছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতা আল-সিসি, যে সামরিক প্যারেডে অংশ নিয়েছিল মিসরের সেনাবাহিনীর একটি দলও।

এর মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেই প্রেসিডেন্ট সিসি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে একযোগে ঘোষণা করেন, তারা দুই বন্ধু দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কে’র মাত্রায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মিসরই আরব বিশ্বের প্রথম কোনো দেশ, যাদের সাথে ভারত এ ধরনের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্কে প্রবেশ করল। বস্তুত প্রতিরক্ষা থেকে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি- সব খাতেই ব্যাপক সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেছে এই দুই দেশ।

নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে প্রেসিডেন্ট সিসি-ও এই নিয়ে তিন-তিনবার ভারত সফরে এলেন।

কোভিড মহামারির জন্য বিশ্বব্যাপী লকডাউন শুরু না-হয়ে গেলে ২০২০ সালের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী মোদিরও মিসর সফর করার কথা ছিল। তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যাওয়া সেই সফর অচিরেই অনুষ্ঠিত হবে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে।

সার্বিকভাবে গত মাত্র সাত-আট বছরের মধ্যে যে মিসর ও ভারতের সম্পর্কে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এবং দুই দেশের নেতাদের মধ্যে যে একটি পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেই লক্ষণ স্পষ্ট।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মূলত ভারত, মিসর ও যুগোশ্লোভিয়ার নেতৃত্বে যখন নির্জোট আন্দোলন (ন্যাম) দানা বাঁধছে, দিল্লি ও কায়রোর সুসম্পর্ক আবার ওই রকম উচ্চতায় পৌঁছতে চলেছে বলেও বহু পর্যবেক্ষক ধারণা করছেন- যদিও এখনকার পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন।

একটি হিন্দুত্ববাদী দল যখন ভারতের ক্ষমতায়, তখন আরব দুনিয়ার নেতৃস্থানীয় দেশ মিসরের সাথে তাদের সম্পর্কের এই ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও এর পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে বলেই তারা মনে করছেন।

ভারতের কাছে মিসরের গুরুত্ব কোথায়?
ভৌগোলিকভাবে মিসরের অবস্থান বিশ্বের এমন একটা জায়গায় যেটাকে ইউরোপ, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থল বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রুট সুয়েজ খাল মিসরই নিয়ন্ত্রণ করে।

দিল্লিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক সি রাজামোহন মনে করেন, ‘এই ইউনিক স্ট্র্যাটেজিক লোকেশনের কারণেই বৈশ্বিক রাজনীতি ও কূটনীতির বহু সিদ্ধান্তকে নানাভাবে প্রভাবিত করার একটা ক্ষমতা মিসরের আছে।’

তিনি আরো বলেন, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজের (ওআইসি) মঞ্চেও একাধিকবার মিসরের আপত্তিতে ভারতবিরোধী প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়নি কিংবা কাশ্মীর নিয়ে বিবৃতির সুর নরম করতে হয়েছে।

যে তথাকথিত ‘সীমান্ত-পাড়ের সন্ত্রাসবাদ’ বহু বছর ধরে ভারতের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ, প্রেসিডেন্ট সিসি ও প্রধানমন্ত্রী মোদি বুধবার দিল্লিতে একযোগে ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার নিন্দাও জানিয়েছেন।

এ মুহুর্তে ভারতের যোধপুরে দুই দেশের বিশেষ বাহিনী প্রথমবারের মতো যৌথ সামরিক মহড়ায় শামিল, আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখার সদস্যরাই যৌথ অনুশীলনে অংশ নিতে মিসরে যাবেন।

মিসর ভারত থেকে যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও নানা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ব্যাপারেও কথাবার্তা চালাচ্ছে।

প্রতিরক্ষার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও ভারত ও মিসরের সহযোগিতার পরিসর বাড়ছে হু হু করে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মোট পরিমাণ সোয়া ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৬০ ভাগ বেশি।

মিসরে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত নাভদীপ সুরি বলছেন, ‘মিসরের সাথে কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশের ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা অবাধ বাণিজ্যের চুক্তি আছে। ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ওই দেশে প্লান্ট স্থাপন করলে তাদের জন্য ইউরোপ, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের নতুন নতুন বাজারে ঢোকা অনেক সহজ হবে।’

মিসরের কী লাভ?
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক মিডল-ইস্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক মোহাম্মাদ সোলায়মান মিসর-ভারত সম্পর্ক নিয়ে চর্চা করছেন বহুদিন ধরেই।

সোলায়মানের বলেন, ‘আসলে মিসর ও ভারতের মধ্যে আদর্শ স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার হয়ে ওঠার সব লক্ষণই আছে।’

‘মিসর মনে করে, ভারত হলো এমন একটি দেশ, নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও আদর্শের সাথে কোনো আপোষ না-করেই যাদের সাথে সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। অন্য বহু দেশের ক্ষেত্রেই এই কথাটা কিন্তু খাটে না।’

তিনি আরো বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মিসর যখন গুরুতর খাদ্য সঙ্কটের সম্মুখীন, তখন ভারত তাদের গম রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকেও মিসরকে ছাড় দিয়েছিল।

ফার্মাসিউটিক্যালস বা ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে, ভ্যাকসিন সরবরাহেও দিল্লি ও কায়রো সম্প্রতি পরস্পরকে অনেক সাহায্য করেছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ ও কোভিড-১৯ও দুই দেশকে আরো কাছাকাছি এনেছে।

তবে এ মুহুর্তে মিসর তাদের ‘সুয়েজ ক্যানাল ইকোনমিক জোন’কে একটি গ্লোবাল প্রোডাকশন হাব হিসেবে গড়ে তোলার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, সেখানে তারা ভারতের আরো সক্রিয় ও বৃহত্তর যোগদান আশা করছে।

এই অর্থনৈতিক জোনটি হল প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার লম্বা একটি চ্যানেল তথা বাণিজ্যিক হাব, যেখানে আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে অন্তত ছয়টি বন্দর থাকবে।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক নাভদীপ সুরি জানাচ্ছেন, ‘এই সুয়েজ ক্যানাল ইকোনমিক জোনে চীন কিন্তু ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রকল্পে ১০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এটা তাদের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের একটা অংশও বটে।’

এখানে চীনের তুলনায় ভারত এখনো অনেক পিছিয়ে থাকলেও সুয়েজে ভারতের সরকার ও বেসরকারি শিল্পসংস্থাগুলোর বিনিয়োগের খুব বড় অবকাশ ও সুযোগ আছে বলেই সুরি মনে করেন।

উল্লেখ্য, চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং দায়িত্ব নেয়ার পর তার আফ্রিকা সফরের শেষ ধাপে দিন দশেক আগেই কায়রো ঘুরে এসেছেন।

প্রেসিডেন্ট সিসি এবং মিসরের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, সুয়েজ খালে ও মিসরের অন্য অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে তাদের বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত থাকবে।

চীনা লগ্নির বহরের সাথে ভারতের হয়তো টেক্কা দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মিসর মনে করছে, তাদের দেশের শিল্প ও ইনফ্রা খাতে ভারতও খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করতে পারে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement