২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে নতুন করে যে কারণে বাড়ছে উত্তেজনা

২০১৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী টিটিপির বিরুদ্ধে উপজাতীয় এলাকায় সামরিক অভিযান শুরুর পর ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালায় স্থানীয় লোকজন। - এএফপি ফাইল ছবি

তার ফোনে যখন রিং এলো ১৭ বছরের ইসরার তখন গভীর ঘুমে। রাত তখন দুটো। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে ফোন ধরার পর অন্য প্রাপ্ত থেকে সে যা শুনলো তা ছিল দুঃস্বপ্ন। তার ভাই জানায়, কয়েকজন অস্ত্রধারী বাড়িতে ঢুকে তাদের বাবাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে।

‘আমার ভাই আমাকে দ্রুত বাড়িতে যেতে বললো,’ বললো ইসরার (ছদ্মনাম)। এসব এলাকায় কেউই সাংবাদিকদের কাছে আসল নাম প্রকাশ করতে চায় না, ভয় পায়।

বিবিসির সংবাদদাতার সাথে ইসরারের দেখা হয় ওরাকজাই জেলায়। পাকিস্তানের উপজাতীয় সাতটি অঞ্চলের একটির নাম ওরাকজাই। এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা পশতুন জাতিগোষ্ঠীর।

ইসরারের বাবার হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পর ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান (আইএস-কে) উগ্রবাদী গোষ্ঠী জানায়- এই হত্যার পেছনে তারাই ছিল। আইএস-কে সন্দেহ করেছে যে ইসরারের বাবা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চর ছিল, যদিও ইসরারের কথা- তা একবারেই সত্যি নয়।

‘ওরাকাজাইতে আমার বাবা একটি দোকান চালাতেন। তিনি তার জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনকে সাহায্য করতেন। শহরে তিনি অনেকটা মুরুব্বির মতো ছিলেন।’

পাশের দেশ আফগানিস্তানে এখন তালেবান আর আইএস-কের মধ্যে লড়াই চলছে। পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকার চিত্র আফগানিস্তানের চেয়ে আরো জটিল।

বাড়ছে সহিংসতা
শুধু ইসরারদের বাড়িতেই হামলা হয়েছে তা নয়। একই দিনে, ওরাকজাইতে সেনাবাহিনীর চর সন্দেহে আরো একজনকে হত্যা করা হয়। তারও দায় স্বীকার করে আইএস-কে।

পাকিস্তানের উপজাতীয় সাতটি এলাকার মধ্যে ওরাকজাই একটি। বাকিগুলো – বাজৌর, মোহমান্দ, খাইবার, কুররাম, উত্তর ওয়াজিরস্তান ও দক্ষিণ ওয়াজিরস্তান।

তিন বছর আগ পর্যন্ত এসব এসব জায়গা ছিল কার্যত স্ব-শাসিত। পাকিস্তানি আইনের বদলের এখানে চলতো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন। ২০১৮ সালের মে মাসে এসব উপজাতীয় এলাকা খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের অঙ্গীভূত করা হয়। চালু হয় পাকিস্তানি আইন।

এ বছরের শুরু থেকে পাকিস্তানের এই উপজাতীয় এলাকাগুলোতে হঠাৎ সহিংসতা, রক্তপাত বাড়তে শুরু করে, বলছে ইসলামাবাদের গবেষণা সংস্থা পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস)।

তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), যাদের সাথে আফগান তালেবানের আদর্শিক ঐক্য রয়েছে – তাদের কারণেই মূলত নতুন করে এই সহিংসতা। আফগান তালেবানের মতো টিটিপিও চায় পাকিস্তান কট্টর শারিয়া আইনভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হোক।

পিআইপিএস’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর টিটিপির ৯৫টি হামলায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু জুলাই থেকে যখন আফগানিস্তানে তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করতে শুরু করে, টিটিপিও পাকিস্তানে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসেই টিটিপির চালানো ৪৪টি হামলায় মারা যায় ৭৩ জন। নিহতদের সিংহভাগই পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য।

হুমকি ও হয়রানি
হামলা এবং হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চলছে ভেতরে ভেতরে নানা হুমকি এবং হয়রানি। ওরাকজাইয়ের অনেক বাসিন্দা বলছেন, চাঁদার দাবিতে তারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মোবাইল ফোন নম্বর থেকে কল পাচ্ছেন।

বাজৌরের সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী আহমেদ (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, জুলাই এবং আগস্ট মাসে বিভিন্ন ফোন নম্বর থেকে তিনি কল পাচ্ছেন। ফোনের অন্য পাশ থেকে কলাররা নিজেদের তালেবান বলে পরিচয় দেয় এবং টাকা-পয়সা দাবি করে।

‘আমি টাকা দিতে অস্বীকার করার পরও তারা ভয়েস ম্যাসেজ পাঠায়, হোয়াটসঅ্যাপে হুমকি দেয় যে চাঁদা না দিলে আমার এবং পরিবারের বিপদ হবে,’ বলেন আহমেদ।

তিনি বলেন, জেলার সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং বেসামরিক প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে হুমকির প্রমাণ দিয়েছেন। ‘তারা আমাকে জানিয়েছেন, আমি শুধু একা নই, আমার মতো অনেকেই মোবাইল ফোনে হুমকির শিকার হচ্ছেন। তারা বলছেন, সবাইকে নিরাপত্তা দেয়া অসম্ভব। তারা আমাকে সাবধান হতে বলছেন, বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে বলছেন।’

টিটিপি কারা
২০০৭ সালে দক্ষিণ ওয়াজিরস্তানে বাইতুল্লাহ মেহসুদ নামে উগ্র এক ধর্মীয় নেতা টিটিপি প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামাবাদের লাল মসজিদ থেকে একজন কট্টর ইসলামি নেতাকে গ্রেফতারে সেখানে সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে উগ্র এই গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ওয়েস্ট পয়েন্টে আমেরিকান মিলিটারি অ্যাকাডেমির সহকারী অধ্যাপক ড. আমিরা জাদুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা এবং কাবুলে তালেবানে সরকারের পতনের সময় থেকে আফগান ও পাকিস্তানি তালেবানের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হয়।

অনেক পর্যবেক্ষক বলেন, আফগানিস্তানে আমেরিকানদের সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে আফগান তালেবানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে পাকিস্তান তালেবান। পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় আফগান তালেবান নেতা এবং যোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, টাকা-পয়সা যুগিয়েছে।

কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই টিটিপি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ শুরু করে। তাদের নিশানা ছিল পাকিস্তানের বেসামরিক এবং সামরিক প্রতিষ্ঠান। পাল্টা ব্যবস্থা নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। একের পর এক সামরিক অভিযানের মুখে টিটিপি নেতারা আফগানিস্তানে পালিয়ে যান। ২০১৫ সাল থেকে তারা সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে আছেন। সেখানে থেকেই পাকিস্তানে হামলা পরিচালনা করছেন তারা।

জুলাইতে আফগান তালেবান যখন কাবুলের দিকে অগ্রসর হয়, টিটিপি নেতাদের বেশি করে চোখে পড়তে শুরু করে।

পাকিস্তানী তালেবানের প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদ সিএনএনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আফগান তালেবানের বিজয় ‘বিশ্বের মুসলমানদের বিজয়’। একইসাথে তিনি পাকিস্তানের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ‘আমাদের লড়াই শুধুই পাকিস্তানে। পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে আমাদের যুদ্ধ চলছে।’

টিটিপি নেতা আরো বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী উপজাতীয় অঞ্চলগুলো দখল করে স্বাধীনতা কায়েম করবো।’

সিঙ্গাপুরভিত্তিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুল বাসিত মনে করেন, আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয় টিটিপিকে ‘নিশ্চিতভাবে উজ্জীবিত করেছে’।

‘তারা মনে করছে আমেরিকা যেখানে আফগানিস্তানে পরাজিত হয়েছে সেখানে পাকিস্তান তো কিছুই না,’ তিনি বলেন। ‘সেই সাথে তারা স্থানীয় জাতিগত বিরোধ উসকে দিচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজনের যে অভিযোগ-অনুযোগ তাতে বাতাস দিচ্ছে … বিশেষ করে পশতুন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা নিয়ে যে ক্ষোভ তাকে ব্যবহার করছে।’

কিন্তু পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং অবসরপ্রাপ্ত তিন-তারকা জেনারেল নিসার জানজুয়া মনে করেন, টিটিপির শক্তি ক্রমেই কমছে।

‘বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে টিটিপি তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। পাকিস্তান আমেরিকার সহযোগী বলে তাদের সাথে লড়াই করতে হবে - এই প্রচারণা আর ধোপে টিকবে না। কারণ আমেরিকানরা আর আফগানিস্তানে নেই,’ তিনি বলেন।

‘টিটিপি যে তাদের সহিংস তৎপরতা বাড়াচ্ছে তাতেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় তারা অস্তিত্বের লড়াই করছে।’

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও দাবি করে যে টিটিপি এবং তাদের সহযোগীরা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ইতিমধ্যেই পরাজিত হয়েছে। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে,’ বিবিসিকে বলেন সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র ।

ভালো তালেবান, মন্দ তালেবান
এটা কম-বেশি সবারই জানা যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে আফগান তালেবানের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, বহুদিনের। কিন্তু পাকিস্তানি তালেবান বা টিটিপির সাথে গত এক দশক ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছে পাকিস্তান। এই লড়াইয়ে হাজার হাজার সামরিক এবং বেসামরিক লোকের জীবন গেছে পাকিস্তানে।

দুই তালেবানকে নিয়ে এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানকে অনেকে পাকিস্তানের ‘ভালো তালেবান, খারাপ তালেবান’ কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেন - আফগান তালেবান ভালো, কিন্তু পাকিস্তানী তালেবান খারাপ।

উপজাতীয় এলাকাগুলো থেকে টিটিপি এবং তাদের সহযোগীদের নির্মূল করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বছরের পর বছর ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে যার পরিণতিতে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আবার পাশাপাশি সরকার পাকিস্তান তালেবানের বিভিন্ন অংশের সাথে শান্তি মীমাংসারও চেষ্টা করেছে।

কিন্তু উপজাতীয় এলাকায় আইএস-কের উপস্থিতি পাকিস্তানের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আফগানিস্তানেও তালেবানের সাথে আইএস-কে’র শত্রুতা এখন চরমে। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মৌলিক মতবিরোধ রয়েছে। আইএস-কে’র বক্তব্য যে দোহায় আমেরিকার সাথে শান্তিচুক্তি করে তালেবান জিহাদ ত্যাগ করেছে ফলে তারা ধর্মচ্যুত এবং তাদেরকে আঘাত করা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের জন্য আইএস-কে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

‘আইএস-কে এবং পাকিস্তানি তালেবানের সাথে জাতিগত ভিন্নতা রয়েছে। আইএস-কে মনে করে টিটিপি পথভ্রষ্ট মুসলিম যারা আসলে পাকিস্তান, ইরান এবং অন্যান্য কিছু আঞ্চলিক দেশের চর,’ বলেন সুইডেন নিবাসী আব্দুল সায়েদ যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জিহাদি গোষ্ঠীগুলো নিয়ে গবেষণা করেন।

তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, তৃণমূল স্তরে টিটিপি এবং আইএস-কে’র ক্যাডাররা একই লোকজন যারা দুটো গোষ্ঠীর প্রতি অনুগত এবং দুই পক্ষের হয়েই কাজ করে।

ড. জাদুন মনে করেন, টিটিপির চেয়ে আইএস-কে’র লক্ষ্য অনেক বিস্তৃত এবং সুদূরপ্রসারী। ‘আইএস-কে ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা দখল করতে চায়। তারা মনে করে তারাই মুসলিম বিশ্বের সত্যিকারের প্রতিনিধি।’

নানামুখী চাপে বিপর্যস্ত মানুষ
পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকাগুলাতে এতসব উগ্র গোষ্ঠী তৎপর যে সাধারণ মানুষজনের জীবন ওষ্ঠাগত।

টিটিপির বিরুদ্ধে লড়াইতে কয়েকবছর আগে সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করেছেন এমন একজন মিলিশিয়া নেতা বিবিসি সংবাদদাতাকে বলেন, আফগান সীমান্তবর্তী মোহমান্দ জেলায় তার গ্রাম থেকে পুরো পরিবারকে পালাতে হয়েছে। ‘আমার বাবা শহীদ হয়েছেন। আমার চাচাতো ভাই মারা গেছে। অমাদের বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে,’ বলেন শেহজাদ (ছদ্মনাম)।

বাজৌরের ব্যবসায়ী আহমেদও খুবই বিপর্যস্ত। ‘মাঝে মধ্যে আমি সত্যিই পরিবার নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবি, ভাবতে বাধ্য হই। কিন্তু কোথায় যাবো? বাড়ি ছেড়ে কীভাবে চলে যাবো?’

তবে ওরাকজাইয়ের ইসরার সোজাসাপ্টা বললেন তারা হয়তো শহর ছেড়ে চলে যাবেন। ‘১৪/১৫ বছর আগে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমরা চলে গিয়েছিলাম। আমার বাবা দু বছর আগে ফিরে আসেন। কিন্তু দেখুন আমার মা এখন বিধবা।’

‘সরকার শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু কোথায় শান্তি?’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement