আমার পোশাকে হাত দিও না...
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩:০৫
আফগানিস্তানে ছাত্রীদের পোশাক নিয়ে তালেবান যে নতুন কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে, তার বিরুদ্ধে নারীরা অনলাইনে প্রতিবাদ শুরু করেছেন।
#DoNotTouchMyClothes এবং #AfghanistanCulture হ্যাশট্যাগের এই প্রতিবাদে অনেকে অনলাইনে তাদের বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী পোশাক শেয়ার করছেন। বিবিসির সোদাবা হায়দার কথা বলেছেন এমন কয়েকজন নারীর সাথে যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রতিবাদ শুরু করেন।
আপনি যদি গুগলে 'ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক' টাইপ করেন, নানা রঙের ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক দেখে আপনি আপ্লুত হয়ে যাবেন।
প্রতিটি পোশাকই অনন্য। হাতে তৈরি নকশা এবং ভারী ডিজাইনের পোশাকের বুকের কাছে ছোট ছোট কাঁচের আয়না, লম্বা স্কার্ট।
আফগানিস্তানের জাতীয় নাচ 'আতান' এ অংশ নেয়ার জন্য একেবারে লাগসই পোশাক। অনেক নারী নকশা করা টুপি পরেন, অন্যরা ভারী টিকলি। আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের মাথায় জাতিভেদে দেখা যাবে বিভিন্ন রকমের টুপি বা অলংকার।
গত ২০ বছর ধরে যে সাধারণ আফগান মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কর্মস্থলে গেছে, এই পোশাকেরই একটু সাদামাটা সংস্করণ তাদের পরতে দেখা গেছে। অনেক সময় তারা হয়তো পাজামার পরিবর্তে জিন্স পরেছেন, কারো কারো ওড়না হয়তো কাঁধের পরিবর্তে জড়ানো ছিল মাথার ওপরে।
কিন্ত গত সপ্তাহান্তে কাবুলে 'তালেবানের শাসনের' সমর্থনে যে নারীরা একটি সমাবেশে যোগ দেন, সেখানে দেখা গেছে একদম উল্টো ছবি। এই নারীরা দীর্ঘ কালো বোরকায় আবৃত ছিলেন, তাদের মুখ এবং হাত ছিল ঢাকা।
একটি ভিডিওতে তালেবানের পক্ষে সমাবেশে যোগ দেয়া নারীদের বলতে শোনা যায়, যেসব আফগান নারী মুখে প্রসাধনী মাখে এবং আধুনিক পোশাক পরে, তারা ‘মুসলিম আফগান নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না।’
তালেবান যে ধরণের কঠোর ইসলামী অনুশাসনের পক্ষে, তার প্রতি ইঙ্গিত করে তারা আরো বলেছেন, ‘আমরা এমন নারী অধিকার চাই না, যা বিদেশ থেকে আমদানি করা এবং ইসলামী শরিয়ার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ।’
তবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আফগান নারীরা সাথে সাথেই এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তানের ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক ড. বাহার জালালি এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক আন্দোলনের সূচনা করেন। তাতে যোগ দেন আরো অনেকে।
তারা #DoNotTouchMyClothes এবং #AfghanistanCulture হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তাদের ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক তুলে ধরেন।
ড: বাহার জালালি বলেন, আফগানিস্তানের পরিচয় এবং সার্বভৌমত্ব এখন হুমকির মুখে বলে তার মনে হয়েছে, এটা নিয়ে তিনি সবচেয়ে উদ্বিগ্ন। সে কারণেই তিনি এই আন্দোলন শুরু করেছেন।
একটি সবুজ আফগান পোশাক পরে তিনি নিজের একটি ছবি টুইটারে পোস্ট করেন। তিনি অন্য আফগান নারীদেরকেও ‘আফগানিস্তানের আসল চেহারা’ তুলে ধরার আহ্বান জানান।
‘আমি বিশ্বকে বলতে চাই, গণমাধ্যমে যেসব পোশাকের ছবি আপনারা দেখছেন (তালেবানের সমাবেশে উপস্থিত নারীদের পোশাকের প্রতি ইঙ্গিত করে), সেগুলো আমাদের সংস্কৃতির নয়, আমাদের পরিচয় সেটা নয়।’
তালেবানপন্থী সমাবেশে যে নারীরা যোগ দিয়েছিলেন, তাদের পোশাক দেখে অনেকে বেশ অবাক হয়েছেন। অনেক আফগান, যারা ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল আফগান পোশাকের সাথে পরিচিত, তাদের কাছে নিকাব এবং মেয়েদের হাত দস্তানা পরে আবৃত করে রাখার বিষয়টি একটি ভিনদেশি ব্যাপার বলে মনে হয়।
আফগানিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক আছে। তবে এই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও একটা বিষয়ে মিল আছে, আফগান নারীদের এসব পোশাক বেশ বর্ণাঢ্য, পোশাকে লাগানো থাকে অনেক কাঁচের আয়না, থাকে অনেক নকশার বুনন। আর এই পোশাক নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনাও অভিন্ন- এসব পোশাক তাদের পরিচয়কেই তুলে ধরে।
‘এগুলো আমাদের খাঁটি আফগান পোশাক। আফগান নারীরা এরকম রঙ-বেরঙের এবং শালীন পোশাকই পরেন। কালো বোরকা কোনদিনই আফগান সংস্কৃতির অংশ ছিল না’, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া থেকে টুইট করেছেন স্পযমে মাসিদ নামে এক অধিকার কর্মী।
তিনি লিখেছেন, ‘আমরা বহু শত বছর ধরেই একটি ইসলামিক দেশ এবং আমাদের দাদী-নানীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকই শালীনভাবে পরেছেন। আরবদের কালো বোরকা কিংবা এই নতুন তৈরি নীল 'চাদারি' তাদের পোশাক ছিল না।’
‘আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং পাঁচ হাজার বছরের সংস্কৃতিকেই তুলে ধরে, যা নিয়ে প্রতিটি আফগান গর্বিত।’
আফগানিস্তানের সবচেয়ে রক্ষণশীল অংশে যারা বাস করেন, তারাও বলছেন নারীদের তারা কখনো নিকাব (মুখ আবৃত করে রাখা একটি কালো কাপড়) পরতে দেখেননি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি শেয়ার করা আরেক আফগান নারী ৩৭ বছর বয়সী লিমা হালিমা আহমাদ একজন গবেষক এবং পায়ওয়ান্দ আফগান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি নারী অধিকার সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি বলেন, ‘আমি এই ছবিটি পোস্ট করেছি, কারণ আমরা আফগান নারী এবং আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক গর্বের সাথেই পরি। কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠী আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করে দিতে পারে না। আমাদের সংস্কৃতি কালো নয়, সাদা-কালো নয়- এটি খুবই বর্ণিল, এবং এতে সৌন্দর্য আছে, শিল্প আছে, কারুকর্ম আছে এবং এটি আমাদের পরিচয়ও তুলে ধরে।’
লিমা আহমাদ গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানেই থেকেছেন, সেখানেই কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘নারীদের পোশাক বেছে নেয়ার অধিকার ছিল। আমার মা একটা লম্বা এবং বড় ঘোমটা দিতেন। অনেকে ছোট অবগুন্ঠন ব্যবহার করতেন। কে কী পোশাক পরবে, সেটা নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হত না।’
তালেবানের সমাবেশে যে ধরণের পোশাকে নারীদের দেখা গেছে, তার প্রতি ইঙ্গিত করে লিমা আহমাদ বলেন, ‘আমরাও আফগান নারী এবং এরকম আপাদমস্তক কালো কাপড়, হাতে কালো দস্তানা পরা- যেখানে আপনার চোখ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, এসব জিনিস আমরা দেখিনি। দেখে মনে হচ্ছে সমাবেশে এগুলো দেখানোর জন্যই যেন বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।’
টুইটারে এই প্রতিবাদে অংশ নেয়া আরেক নারী মালালি বাশির প্রাগে থাকেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা আফগান নারীদের ছবি আঁকেন, যাতে আফগান সংস্কৃতির সৌন্দর্য বিশ্বের কাছে তুলে ধরা যায়।
মালালি বাশির আফগানিস্তানের এক গ্রামে বেড়ে উঠেছেন (কিন্তু নিজের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য তিনি এই গ্রামের নাম বলেননি)।
তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের এই গ্রামেও কালো বা নীল বোরকা পরার নিয়ম ছিল না। মেয়েরা আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী পোশাকই পরতো। বয়স্ক নারীরা মাথায় কালো কাপড় দিতেন, আর তরুণীরা পরতো রঙ-বেরঙের শাল। মেয়েরা পুরুষদের করমর্দন করে স্বাগত জানাতো।’
“সাম্প্রতিককালে আফগান নারীদের ওপর আরো বেশি করে চাপ দেয়া হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক পোশাক বদলাতে, নিজেদের আপাদমস্তক আবৃত করতে। আমি আমার ছবি পোস্ট করেছি এবং আমার আঁকা একটি ছবি আবার শেয়ার করেছি যাতে আফগান নারীদের দেখা যাচ্ছে বর্ণাঢ্য পোশাকে, এবং তারা আফগানিস্তানের জাতীয় নৃত্যে অংশ নিচ্ছেন, যেটি 'আতান' নামে পরিচিত।’’
তালেবান কর্মকর্তারা বলেছেন, আফগান নারীরা শরিয়া আইন মেনে পড়াশোনা করতে পারবেন এবং কাজ করতে পারবেন, তবে তাদেরকে পোশাকের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।
কিছু আফগান নারী এরই মধ্যে আরো রক্ষণশীল পোশাক পরতে শুরু করেছেন। 'চাদারি' নামের নীল পোশাক, যাতে চোখের সামনে চারকোনা জালি থাকে, সেটি আবার ফিরে এসেছে। কাবুল এবং অন্যান্য শহরে এটি এখন অনেক নারীকে পরতে দেখা যাচ্ছে।
তালেবানের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী আবদুল বাকী হাক্কানি বলেছেন, নারী এবং পুরুষদের আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেয়া হবে এবং সব নারী শিক্ষার্থীর জন্য পর্দা মানা বাধ্যতামূলক করা হবে। তবে এই পর্দার মানে কি হিজাব নাকি পুরো মুখ ঢেকে রাখা- সেটা তিনি স্পষ্ট করেননি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা