২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সিদ্দিক কাপ্পান : গণধর্ষণের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কারাবাসে ১৫০ দিন

কেরালায় সিদ্দিক কাপ্পানের মুক্তির দাবিতে পোস্টার - ছবি : বিবিসি

গত বছরের ৫ অক্টোবর সকালে ভারতের উত্তর প্রদেশের এক গ্রামে আমি গিয়েছিলাম খবর সংগ্রহ করতে। বহুল পরিচিত ‘হাথরাস মামলার’ ঘটনা ঘটে ওই গ্রামে ।

যাওয়ার কিছুদিন আগেই, উত্তর প্রদেশের হাথরাস জেলার ভুলগারহি নামের ওই গ্রামে ১৯ বছরের এক দলিত তরুণীর তার উচ্চবর্ণীয় কয়েক প্রতিবেশীর ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল।

নিষ্ঠুর এই আক্রমণ, ওই তরুণীর মৃত্যু এবং পরিবারের অসম্মতিতে মধ্যরাতে জোর করে পুলিশের শবদাহ করার ঘটনা ওই সময় সারাবিশ্বেই আলোড়ন তৈরি করেছিল।

সকাল ১০টায় আমি ওই তরুণীর বাড়িতে পৌঁছে তার শোকাহত পরিবার সাথে সাক্ষাত করি। পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশিরা আমাকে লম্বা কালো চুলের লাজুক হাসির মিষ্টি এক কিশোরীর কথা জানান।

তারা আমাকে তার শরীরের আঘাতের বিষয়ে জানান এবং জীবিত ও মৃত অবস্থায় পুলিশ ও সরকার তার সাথে যে নির্মম ব্যবহার করে, তার বর্ণনা দেন।

ওই সকালেই মালায়লাম ভাষার সংবাদমাধ্যম আজিমুখামের ৪১ বছর বয়সী সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান দিল্লি থেকে ভুলগারহির উদ্দেশে যাত্রা করেন, যেখানে তিনি নয় বছর ধরে সংবাদমাধ্যমটির জন্য কাজ করছেন।

কিন্তু আমার চেয়ে তার যাত্রা ভিন্ন এক ফল বয়ে আনে।

হাথরাস থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে তার গাড়িতে থাকা আরো তিনজনের সাথে কাপ্পান গ্রেফতার হন। গত সপ্তাহে, কারাগারে ১৫০ তম দিন পার করেন তিনি।

পরিবার ও আইনজীবীদের কাছে কাপ্পান জানান, পুলিশের গারদে ওই রাতে তাকে জিজ্ঞেসাবাদের অজুহাতে টানাহেঁচড়া করা হয়, লাঠি দিয়ে পায়ে পেটানো হয়, মুখে থাপ্পড় মারা হয়, সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত জোর করে জাগিয়ে রাখা হয় এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

ডায়বেটিকসের রোগী হওয়া সত্ত্বেও তাকে ওষুধ নেয়া থেকে বঞ্চিত করা হয় বলে জানান তিনি।

পুলিশ তার অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, হাথরাসে গিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ও দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সিদ্দিক কাপ্পানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার অপর তিনজনকেও একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।

পুলিশ জানায়, কাপ্পানের সাথে থাকা অপর যাত্রীরা কেরালাভিত্তিক হার্ডলাইন মুসলিম সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার (পিএফআই) সদস্য, যাদের সাথে উগ্রবাদী সংগঠনের সংযোগের অভিযোগ রয়েছে এবং উত্তর প্রদেশ সরকার যাদের নিষিদ্ধ করতে চায়।

তারা জানায়, কাপ্পান মূলত অপ্রচলিত এক সংবাদপত্রের সাংবাদিকের ভানকারী। প্রকৃতপক্ষে তিনিও পিএফআইয়ের সদস্য।

কেরালার সাংবাদিক ইউনিয়ন, কাপ্পানের আইনজীবী ও পিএফআই পুলিশের এই দাবি অস্বীকার করেছে।

কেরালার সাংবাদিক ইউনিয়ন, যে সংস্থায় কাপ্পান একজন পদাধিকারী, উত্তর প্রদেশদের পুলিশকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ত্রুটিপূর্ণ বিবৃতি’ তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং তার গ্রেফতারিকে ‘অবৈধ’ বলে দাবি করে।

ইউনিয়ন জোর দিয়ে জানায়, কাপ্পান ‘শুধুই একজন সাংবাদিক’ এবং সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের জন্যই তিনি হাথরাসে যাত্রা করেছিলেন। ইউনিয়ন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে তার মুক্তির জন্য একটি আবেদন দাখিল করে।

কাপ্পানের সংবাদমাধ্যম আজিমুখামও এক বিবৃতিতে জানায়, তিনি তাদের সংবাদকর্মী এবং অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবেই তিনি হাথরাসে যাচ্ছিলেন।

সিদ্দিক কাপ্পান ও সাংবাদিক ইউনিয়নের আইনজীবী উইলস ম্যাথুস ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, শুরুতে তার মক্কেলকে ক্ষুদ্র জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু দুই দিন পরে পুলিশ তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বেআইনি কর্মকাণ্ড নিরসন আইনের (ইউএপিএ) অধীনে মামলা দায়ের করে। ইউএপিএ ভারতে কঠোরতম সন্ত্রাসবিরোধী আইন যার জামিন পাওয়া প্রায়ই অসম্ভব।

উইলস ম্যাথুস বলেন, তার মক্কেল ‘শতভাগ নিরপেক্ষ, স্বাধীন সাংবাদিক।’

তিনি বলেন, ‘কিছু লোকের সাথে ট্যাক্সি শেয়ার করায় তিনি অপরাধী হয়ে যাননি।’

ম্যাথুস বলেন, ‘এক সাংবাদিককে বিভিন্ন লোকের সাথেই মিশতে হয়, এমনকি যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তাদের সাথেও। অন্য অভিযুক্তদের সাথে থাকা গ্রেফতারির কোনো কারণই হতে পারে না।’

আদালতের তথ্যানুসারে, গ্রেফতারির কয়েক সপ্তাহ পরেও কাপ্পানের বাইরের জগতের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না।

গ্রেফতারির ২৯ দিন পর ২ নভেম্বর তিনি পরিবারের সাথে ফোনে প্রথম যোগাযোগ করার সুযোগ পান। তার স্ত্রীর সাথে এর আটদিন পর প্রথম কথা বলার সুযোগ পান তিনি। ৪৭ দিন পর তার সাথে ম্যাথুস প্রথম যোগাযোগ করার অনুমতি পান। এর পরই তিনি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন দাখিল করেন।

কেরালার মালাপ্পুরাম জেলার নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে সিদ্দিক কাপ্পানের স্ত্রী রাইহানাথ আমাকে ফোনে জানান, ২ নভেম্বরে তার ফোন কলের আগ পর্যন্ত তিনি এমনকি নিশ্চিত ছিলেন না ‘সিদ্দিক জীবত আছেন কিনা।’

গত মাসে সুপ্রিম কোর্ট ৯০ বছর বয়সী অসুস্থ মায়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য তাকে পাঁচ দিনের অন্তর্বর্তী জামিন দেন। তার চারদিনের অবস্থানকালে উত্তর প্রদেশের ছয় পুলিশ ও প্রাদেশিক নিরাপত্তারক্ষীর দুই ডজন সদস্য বাড়ির বাইরে ঘেরাও করে রাখে।

পরিবারের জন্য এটি ছিল শঙ্কাপূর্ণ এক অবস্থা। রাইহানাথ বলেন, ‘তিনি তার মায়ের দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও আমাদের তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার স্বামী অন্যায় কিছু করেননি এবং শুধু মুসলমান হওয়ার জন্যই তাকে লক্ষ্যে পরিণত করা হয়েছে।

রাইহানাথের তথ্যমতে পুলিশ তার স্বামীকে বারবার প্রশ্ন করছিল তিনি গরুর গোশত খান কিনা (অনেক হিন্দুই গরুকে সম্মান করেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানরা ভারতে গরুর গোশত খাওয়া বা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য আক্রমণের শিকার হয়েছেন।)

তিনি আরো বলেন, তারা সিদ্দিককে প্রশ্ন করে কয়বার তিনি ডা. জাকির নায়েকের সাথে সাক্ষাত করেছেন। ডা. নায়েককে ভারতে বিতর্কিত ইসলামি বক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যার বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক মন্তব্য ও অর্থপাচারের অভিযোগ করা হয়েছে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় নির্বাসনে থাকা ডা. নায়েক এই সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তাকে আরো প্রশ্ন করা হয়, দলিতের বিষয়ে মুসলমানদের এতো ঝোঁকের কারণ কী।

সুপ্রিম কোর্টের এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অভিলাষ এম আর আমাকে বলেন, ‘যদি কেই বলে সিদ্দিক কাপ্পানের গ্রেফতারি ইসলামোফোবিক, তবে আমি এই মতামতে সমর্থন দেবো।’

অভিলাষ এম আর বলেন, এই মামলা রাজনৈতিক ‘উইচ হান্ট’ ও রাজনৈতিক নিপীড়ণের অংশ। এর মাধ্যমে কাপ্পানের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে।

সমালোচকরা উত্তর প্রদেশের গেরুয়া পোশাকের সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ নেতৃত্বের বর্তমান সরকারকে অন্যায়ভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেছে। যোগী আদিত্যনাথকে ভারতের সবচেয়ে বিভেদ সৃষ্টিকারী ও কট্টর রাজনীতিবিদ হিসেবে বর্ণনা করা হয় যিনি মুসলিম বিরোধী আতঙ্ক ছড়িয়ে নিজের প্রচারণা করেন।

হাথরাসে দলিত তরুণীর গণধর্ষণ ও মৃত্যুতে তার সরকার ও পুলিশের ভমিকায় বিশ্বব্যাপী বিপুল সমালোচিত হয়। বিশেষ করে তার পরিবার ও সংবাদমাধ্যমকে দূরে রেখে মধ্যরাতে ওই তরুণীর শবদাহের ঘটনায় নিন্দার ঝড় ওঠে।

দলিত ওই তরুণীর মৃত্যুর পর সারা ভারতে বিক্ষোভ আয়োজিত হয়। উত্তর প্রদেশের পুলিশ তরুণীর পরিবারের সাথে দেখা করতে যাওয়া লোকদের ঠেকাতে লাঠিচার্জ করার জন্য প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে। বিরোধীদলীয় নেতারাও এই প্রতিবাদে অংশ নিতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হন।

সিদ্দিক কাপ্পান ও আমার হাথরাসে যাওয়ার একদিন আগে ৪ অক্টোবর, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেন, রাজ্যের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ চলছে এবং ‘রাজ্য সরকারের অগ্রগতিতে অসুখী ব্যক্তিরা এই ঘটনার সুযোগ নিচ্ছে।’

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় কাজ করা অ্যাকটিভিস্টদের এই ঘটনা উদ্বিগ্ন করেছে। তারা বলছেন, ক্রমেই ভারত সাংবাদিকদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। গত বছর রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার প্রণীত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের তালিকায় ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২ তম স্থান লাভ করে, যা আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ নিচে।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির কৃষক বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করা আট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের জন্য বিশেষভাবে নারী ও মুসলিম সাংবাদিকদের বেছে নেয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অভিলাষ এম আর জানান, পুলিশ সিদ্দিক কাপ্পানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিন্দু পরিমাণ প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।

তিনি বলেন, তারা শুধু একটি কাজ সফলভাবে করতে পেরেছে; হাথরাসে না যাওয়ার জন্য সাংবাদিকদের সতর্ক বার্তা দেয়া।

উইলস ম্যাথুস বলেন, সিদ্দিক কাপ্পানের গ্রেফতার কোনো সাধারন লোকের গ্রেফতার নয়।

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমকে নিশ্চুপ করা গণতন্ত্রকে শেষ করা।’

বিবিসি থেকে অনূদিত


আরো সংবাদ



premium cement