ভারতে ৯ মুসলমানকে আল কায়েদার সদস্য বলে দাবি নিয়ে সন্দেহ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২০:৪৭
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় অতর্কিত অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা মোট ৯ জন মুসলিম ব্যক্তিকে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি বা এনআইএ আল কায়দার সক্রিয় সদস্য বলে দাবি করার পর তা নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় তৈরি হয়েছে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তদন্তে ভারতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই সংস্থা বলছে, গ্রেফতার হওয়া এই ব্যক্তিরা রাজধানী দিল্লিসহ বিভিন্ন জায়গায় উগ্রবাদী হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
কিন্তু মানবাধিকার কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টরা পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবেই আল কায়দার অস্তিত্ব বিপন্ন সেখানে কীভাবে এই ভারতীয় নাগরিকদের সাথে তাদের যোগসাজস খুঁজে পাওয়া গেল?
পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা অধীর চৌধুরীও মনে করছেন, ধৃতরা যদি আল কায়দার সদস্য হয়েও থাকে, সেটা সরকারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই পরিণাম।
ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি দুদিন আগে প্রেস বিবৃতিতে জানায়, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও কেরালার এর্নাকুলামে একযোগে অভিযান চালিয়ে তারা মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে - যারা সবাই ‘আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী সংগঠন আল কায়দার সদস্য’।
এনআইএ দাবি করে এদের কাছ থেকে প্রচুর জিহাদি বইপত্র, দেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ডিজিটাল ডিভাইস ও বিস্ফোরক বানানোর কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া শাখার প্রধান মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বিবিসিকে বলেছেন, এরা আল কায়দার সদস্য এ কথা বিশ্বাস করতেই তার কষ্ট হচ্ছে।
তার কথায়, ‘এখন তো আল কায়দা অপারেটই করছে না। আফগানিস্তানে শান্তি আলোচনা চলছে, আমরা তো আল-কায়দার কোনো কাজকর্মই দেখছি না। তাহলে এনআইএ হঠাৎ করে কেন আল কায়দার কথা বলল?’
‘আফগানিস্তানে আল কায়দার বিরুদ্ধে লড়তে আমেরিকা যে সেনা মোতায়েন করেছিল সেটাও তারা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।’
‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যন্ত যেখানে আল কায়দার বিরুদ্ধে 'ওয়ার অন টেরর' শেষ করে দিচ্ছেন, সেখানে আমরা এখনও ভারতে আল কায়দা খুঁজে বেড়াচ্ছি এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার নয়?’’, প্রশ্ন মীনাক্ষি গাঙ্গুলির।
ভারতের এনআইএ অবশ্য বলছে, প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে পাকিস্তানভিত্তিক আল কায়দা সদস্যরাই নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মুর্শিদাবাদের এই বাসিন্দাদের র্যাডিকালাইজ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের সুপরিচিত সিভিল রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট নিশা বিশ্বাস বলেছেন, এর আগেও ভারতের পুলিশ বা বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা নানা উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় শত শত মুসলিম যুবককে আটক করেছে এবং তাদের ইসলামিক স্টেট বা আল কায়দার সদস্য হিসেবে চার্জ এনেছে। কিন্তু প্রায় নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কিছুই প্রমাণ হয়নি।
নিশা বিশ্বাস বলেছেন, ‘আসলে এই সরকারের প্যাটার্নই হল আসল ইস্যু থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেয়া: মহামারির দায় চাপিয়ে দাও তাবলীগ জামাতের ওপর, শ্রম আইনে সংস্কার নিয়ে সমালোচনা হলে রামমিন্দর দেখিয়ে দাও।’
‘এই মুহূর্তে সরকার অনেকগুলো বিল পার্লামেন্টে পাস করানোর জন্য মরিয়া। সেগুলো নিয়ে যাতে বেশি কথাবার্তা না হয়, তার জন্য চালাকি করে কিছু লোককে ধরে অ্যান্টি-ন্যাশনাল বলে দাও - মুর্শিদাবাদে ঠিক সেটাই হয়েছে।’
আর এই কাজে গত কয়েক বছরে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সিকে অবিশ্বাস্য পরিমাণে ক্ষমতা দিয়ে তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে বলেও ড: বিশ্বাসের পর্যবেক্ষণ।
‘এনআইএ-কে ক্ষমতা দিয়ে তার অসম্ভব অপব্যবহার করা হচ্ছে।’
‘আপনি হিন্দু হলে ভীমা-কোরেগাঁওয়ের মতো কেস, আর মুসলিম হলে কাশ্মির কিংবা নাগরিকত্ব আইনবিরোধী বিক্ষোভের জন্য মামলা - অজুহাতের কোনো অভাব নেই। বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করানো হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এনআইএ সরকারের হয়ে এখন ঠিক এই কাজটাই করছে - বিরোধী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে তল্লাসি চালানো বা তাদের ভয় দেখানোর জন্য যেভাবে এতদিন সিআইএকে ব্যবহার করা হয়েছে।’
মুর্শিদাবাদ জেলার এমপি ও লোকসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরী সরাসরি বলছেন না ধৃতরা কেউ আল কায়দার সঙ্গে জড়িত নন - তবে তার বিবৃতিতেও এনআইএ’র প্রতি কটাক্ষের সুর ছিল।
তার কথায়, ‘ভারতে বিভিন্ন উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় এর আগেও মুর্শিদাবাদের নাম এসেছে। বাংলাদেশের জামায়েতুল মুজাহিদিন বা জেএমবিরও এই জেলায় ঘাঁটি ছিল।’
‘কিন্তু আল কায়দার মতো সংগঠন, ওসামা বিন লাদেন যার নেতা ছিলেন বা যারা আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেছে - এরকম একটা ভয়ঙ্কর, ভয়ানক সংগঠনের সাথে মুর্শিদাবাদের যোগসূত্র? আমার কাছে এটা কিন্তু অত্যন্ত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে’, মন্তব্য করেছেন তিনি।
অধীর চৌধুরীর দাবি, বর্তমান ভারত সরকার যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে তাতে দেশের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে সঠিক বার্তা যাচ্ছে না।
আর বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠন হয়তো সেটারই সুযোগ নিয়ে লোকজনকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে।
সূত্র : বিবিসি