২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রিয়জনদের ফেরার অপেক্ষায় আছেন যে কাশ্মিরিরা

- ছবি : সংগৃহীত

গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতের সরকার জম্মু এবং কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করেছিল। এই সাংবিধানিক ধারা বলে কাশ্মির যে আধা-স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো, সেটি কেড়ে নেয়া হয়।

বিতর্কিত এই পদক্ষেপের আগে ভারত সরকার কাশ্মিরে হাজার হাজার মানুষকে আটক করে। এদের অনেকেই ভারতের নানা জায়গায় জেলে এখনো বন্দী। তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে গুরুতর সব অভিযোগ।

৬ আগস্ট রাতে তাসলিমা ওয়ানি আর তার পরিবার ছিলেন গভীর ঘুমে। হঠাৎ দরোজায় জোরে জোরে ধাক্কার শব্দে তারা জেগে উঠলেন।

তার আগের দিন দিল্লিতে ভারত সরকার এমন এক ঘোষণা দিয়েছেন, যা পুরো দেশকে স্তম্ভিত করেছে। যে সাংবিধানিক ধারাবলে জম্মু এবং কাশ্মিরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিল, সেটি সরকার বাতিল করে। জম্মু এবং কাশ্মির রাজ্যকে দুই ভাগে ভাগ করে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। পুরো কাশ্মির উপত্যকা জুড়ে এক অভূতপূর্ব কারফিউ জারি করে বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা।

তাসলিমা ওয়ানির বাড়িতে যারা এসেছিল, তারা সেনাবাহিনী আর পুলিশের এক যৌথ দল।

"ওরা চিৎকার করে আমাদের দরজা খুলতে বলছিল। আমরা ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম", বলছিলেন তিনি।

"ওরা আমাকে ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে দিল। তারপর আমার দুই ছেলেকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল। ওদের ১৫ মিনিট ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তারপর ওরা চলে গেল।"

কিন্তু পরে আবার তারা ফিরে এলো। এবার তারা বড় ছেলে ১৯ বছরের নাদিমকে বললো, এক প্রতিবেশির বাড়ি চিনিয়ে দেয়ার জন্য তাদের সঙ্গে যেতে হবে। সেটাই ছিল ছেলের সঙ্গে তাসলিমা ওয়ানির শেষ দেখা।

নাদিমকে একটি পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে আটক করা হয়। এরপর পাঠিয়ে দেয়া হয় এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের এক জেলখানায়।

নাদিম ওয়ানি সম্পর্কে ভারতীয় পুলিশের একটি গোপন ফাইল বিবিসি দেখেছে। এটিতে নাদিম ওয়ানিকে একজন 'ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার' বা প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কাশ্মিরের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর যেসব সদস্য সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত নয়, কিন্তু অন্যান্য কাজে সাহায্য করে, তারাই হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর ভাষায় 'ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার।'

নাদিম ওয়ানির বিরুদ্ধে আরও যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে আছে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে পোস্টার লাগানো। সেসময় নাদিমের বয়স ছিল ১৫।

তাসলিমা ওয়ানি বলেন, "আমি আমার ছেলেকে জানি। ও চরমপন্থী নয়। ও কখনো কোন বেআইনি কাজে অংশ নেয়নি। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, দয়া করে আমার ছেলেকে মুক্তি দিন।"

তাসলিমা ওয়ানির স্বামী মোহাম্মদ আশরাফ ওয়ানি গত এক বছরের মধ্যে মাত্র একবার জেলে তার ছেলেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন।

নাদিমের মতো আরও হাজার হাজার কাশ্মিরি এভাবে জেলখানায় বন্দী হয়ে আছে। গত বছরের ৫ আগস্টের আগে শুরু হওয়া এক ব্যাপক নিরাপত্তা অভিযানে তাদের ধরা হয়। এই অভিযান অব্যাহত ছিল কয়েক সপ্তাহ ধরে।

রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট থেকে শুরু করে যাদের বিরুদ্ধেই কোন প্রতিবাদ-বিক্ষোভে যোগ দেয়ার অভিযোগ আছে, বা চরমপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করা হয়, তাদেরকেই ধরা হয়েছে। কাউকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেককে গৃহবন্দী করা হয়েছে।

কাশ্মিরের তিনজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রীকেও আটক করা হয়। তাদের একজন এখনো গৃহবন্দী।

ভারত সরকারের এই পদক্ষেপ স্বদেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। কিন্তু ভারত সরকার দাবি করে, কাশ্মির অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এর দরকার আছে। কারণ সেখানে সম্প্রতি চরমপন্থীদের তৎপরতা বেড়েছে।

নাদিম সহ অনেক কাশ্মিরিকেই আটক করা হয়েছিল বিতর্কিত এক জননিরাপত্তা আইন, পাবলিক সেফটি এ্যাক্টে (পিএসএ)। এই আইনে কোন অভিযোগ না এনেই কাউকে দুবছর পর্যন্ত আটক রাখা যায়।

এই ব্যাপক অভিযানে কত কাশ্মিরিকে আটক বা কারাবন্দী করা হয় তা স্পষ্ট নয়। গত বছরের ২০ নভেম্বর সরকার পার্লামেন্টে জানিয়েছিল, আগস্টের ৪ তারিখ হতে তারা মোট ৫ হাজার ১৬১ জনকে গ্রেফতার করে। এদের কতজনের বিরুদ্ধে পাবলিক সেফটি অ্যাক্টে অভিযোগ আনা হয়েছে বা কতজন এখনো বন্দী তা জানা যায়নি।

'নিখোঁজ' হয়ে যাওয়া কাশ্মিরিদের বাবা-মায়েরা মিলে গড়ে তুলেছেন একটি নাগরিক সংগঠন । আদালতের যেসব নথি তারা সংগ্রহ করেছেন, তাতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে পাবলিক সেফটি অ্যাক্টে আটক কাশ্মীরিদের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে মোট ৬৬২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪১২টিই করা হয় ৫ আগস্টের পর।

কাশ্মির পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল বিজয় কুমারের কাছে এধরণের গ্রেফতারের তথ্য জানতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন, 'এরকম স্পর্শকাতর তথ্য' তার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।

কাশ্মিরের মানবাধিকার কর্মীদের ধারণা, এসব গণগ্রেফতার এবং আটক করার ঘটনা সেখানকার মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে করা।

শ্রীনগরের একজন মানবাধিকার কর্মী পারভেইজ ইমরোজ বলেন, "এসব গ্রেফতারের উদ্দেশ্য জনগণকে চুপ করিয়ে দেয়া। অনেককেই ধরা হয়েছে পাবলিক সেফটি অ্যাক্টে। কাউকে কাউকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ভয় ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। সরকার এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল কেউ যেন তাদের বাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে নতুন আইনের প্রতিবাদ না করে।"

একই কথা বললেন শ্রীনগরের সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার হারুন রেশি।

"৫ আগস্ট যা করা হয়েছিল, তা এক বিরাট ঘটনা। ভারত সরকার জানতো এটা কাশ্মিরে গণঅসন্তোষ তৈরি করবে। তারা এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিক্রিয়া শোনা যাক, সেটা তারা চায়নি", বলছেন তিনি।

বন্দী দশা থেকে যারা মুক্তি পেয়েছেন, তারা বলছিলেন, আটক থাকার সময় তাদের কী যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।

কাশ্মীরের একটা আঞ্চলিক অনলাইন পত্রিকা 'কাশ্মীরিয়াত।' এটির সম্পাদক কামার জামান কাজি জানান, কয়েকটি 'টুইট‌' করার ব্যাখ্যা চেয়ে তাকে একবার তলব করা হয়। এর কদিন পর তাকে গ্রেফতার করা হয়।

৫ আগস্টের আগে পুরো কাশ্মির অঞ্চলে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হচ্ছিল। সরকার তখনো কোন ইঙ্গিত দেয়নি, কী ঘটতে চলেছে। পুরো অভিযানটির প্রস্তুতি চলছিল খুবই গোপনে।

২৬ জুলাই কামার জামান কাজি একটি টুইট করেন, যাতে তিনি এই সৈন্য চলাচল নিয়ে কথা বলেন। তার টুইটটি স্থানীয় পুলিশের নজরে পড়ে। এরপর তাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন তাকে আটক করা হয়।

৮ আগস্ট তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারত শাসিত কাশ্মিরের রাজধানী শ্রীনগরের কেন্দ্রীয় জেলে।

"সেখানে আমাদের উলঙ্গ করে করে রাখা হয়। আমরা বাধা দেয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনি", বলছিলেন তিনি।

তিনি জানান, সেখানেই তাকে বলা হয়েছিল, পাবলিক সেফটি অ্যাক্টে তাকে আটক করা হয়েছে। তাকে এখন উত্তর প্রদেশের বেরিলি জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

"ওরা যখন আমাদের সামরিক বিমানে তুলছিল, তখন আমরা উর্দূ কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সেই প্রতিরোধের কবিতা আবৃত্তি করছিলাম, 'হাম দেখেঙ্গে।'

তার পরিবার জানতেন না, তাকে কোথায় রাখা হয়েছে। তারা কাশ্মিরের চারটি জেলখানায় ঘুরে তার খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাদের ৫২ দিন লেগেছিল তার হদিস পেতে। যখন তারা কামার জামান কাজিকে খুঁজে পেলেন, দেখলেন, তার পরনে তখনো সেই শার্টটি, যেটি পরে তিনি থানায় পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন।

একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তার বিরুদ্ধে জারি করা আটকাদেশটি প্রত্যাহার করে নেয়ার পর তিনি মুক্তি পেয়েছেন। তিনি আমাকে জেলখানায় পরা সেই টি শার্টটি দেখাছিলেন। সেটির জীর্ণ অবস্থা, ১১৯ টি ছিদ্র সেটিতে।

"সবচেয়ে বাজে ব্যাপার ছিল, আমি বার বার অনুরোধ করার পরও জেলখানায় ওরা আমাকে কোন কাগজ-কলম দেয়নি। নয় মাস ধরে যে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি, সেগুলো আমি লিখতে চেয়েছিলাম।"

এ সপ্তাহের শুরুতে আবার তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে একটি রিপোর্ট লেখার জন্য। কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে বলেছে, ৬ আগস্টের পর যখন কারফিউ তুলে নেয়া হবে, তখন যেন তারা জামিনের আবেদন করে।

পুরো কাশ্মির জুড়ে হাজার হাজার পরিবার তাদের প্রিয়জনের নিরাপত্তা নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারির পর।

এরকম একটি পরিবারের মা সারা বেগম। তার ছেলে ওয়াসিম আহমদ শেখ গত বছরের ৮ আগস্ট হতে জেলে বন্দী। সেদিন তিনি থানায় গিয়েছিলেন পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে। তার আগের দিন পুলিশ ওয়াসিমদের বাড়িতে এসেছিল তার সন্ধানে।

তার বিরুদ্ধে পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়া এবং চরমপন্থীদের সাহায্য করার অভিযোগ আনা হয়।

আটক করার পর ওয়াসিমকেও বহু দূরে উত্তর প্রদেশের এক জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত পরিবারের কেউ ওয়াসিমকে দেখেননি।

মা সারা বেগমের আশংকা, তিনি বা তার ছেলে দুজনের কেউ একজন হয়তো করোনাভাইরাসে মারা যাবেন, তার আগে মা-ছেলের মধ্যে আর দেখা হবে না।

"আমরা দুজন এক সঙ্গে মরতে চাই। আমার আদরের সন্তানকে আমি গত ১১ মাসে একবারও দেখিনি", কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন তিনি।

"আমি সরকারের কাছে আবেদন করছি, তারা আমার ছেলেকে যদি মুক্তি দিতে নাও চায়, তাকে যেন অন্তত কাশ্মিরের কোন জেলখানায় নিয়ে আসে।" বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement