১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`

দুই কাঁধে দুই মুহুরি লিখতে আছেন ডায়েরি

দুই কাঁধে দুই মুহুরি লিখতে আছেন ডায়েরি - নয়া দিগন্ত

সক্রেটিস-প্লেটো-গং রাষ্ট্রের বা রাজ্যের ভালো-মন্দ বিচার বিশ্লেষণের ফর্মুলা চেকলিস্ট আকারে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক করে যাননি বটে কিন্তু তারা সব বিষয়ে নীতিগত অবস্থান সমীক্ষণ ও অনুসরণে যথার্থ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। আজকাল দেশে ও বিদেশে নীতিগত অবস্থান দিব্যি ধাক্কা দিয়ে ন্যায়নীতিনির্ভরতা এড়িয়ে মাড়িয়ে চলতে অনেকে কসুর করছেন না। তারা নীতিনৈতিকতার অবজ্ঞা সাফল্য এমনকি রোলমডেল হিসেবে ভাবতে বা এ নিয়ে আত্মতুষ্টি প্রকাশ করেন।
মোগল সম্রাট হুমায়ুনের পুত্র আকবরের ১৩ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ, বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্বে তার বড় হওয়া শেষমেশ ভারতেশ্বর হতে পারার রোলমডেলের সূচনা হলেও তার সময় সাম্রাজ্য পরিচালনার ব্যালান্সশিট তৈরির প্রথা শোনা যায়নি, কেননা প্রজাকুলের কাছে তার জবাবদিহির কোনো ব্যাপার ছিল না। যদিও তার দরবারে নবরত্ন সভায় আবুল ফজলের মতো প্রাজ্ঞ প্রধান উজির, টোডরমলের মতো রাজস্ববিদ্যা বিশারদ, মোল্লা দোপিয়াজার মতো রসতত্ত্বের ভাণ্ডাররা ছিলেন তথাপি ব্যালান্সশিট কষার কোনো প্রমাণ ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ, যদুনাথ সরকার, আরসি মজুমদার এমনকি হাল আমলের মোগল শাসন প্রশাসন ও আর্থসামাজিক ইতিহাসবেত্তারা প্রক্ষেপণ করতে পারেননি এই আকবর দ্য গ্রেটকে। আকবর-দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, তার ছিল বিভিন্ন ধর্মের তিন স্ত্রী; প্রভৃতি নিয়ে কিছু কৌতুকপ্রদ তথ্য ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেলেও তার সামরিক শক্তি, ব্যক্তিগত কূটকৌশল সম্পর্কে এমন কিছু উপাদান এখনো মেলে না বলে সম্প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মোগল শাসনামলকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস পাচ্ছেন। ইতিহাস নির্মাণ এবং ইতিহাস রচনাকে ইদানীং এমনভাবে ওলটপালট হতে শুরু করেছে যে, পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজনে সত্য ও মিথ্যাকে চাটুকারদের দ্বারা তিলকে তাল বানানোর খাসলত কমছে না, বরং বাড়ছে।

যা হোক হাল আমলে আড়াইহাজার উপজেলার জনৈক আকবর আলীর নির্বাচকমণ্ডলীরা চেয়ারম্যান হিসেবে তার কার্যকলাপের ব্যালান্সশিট বোঝানোর প্রয়োজনীয়তা-প্রত্যাশারা পান তামাক খেয়ে তাড়া করছে। হোক না এ আকবর আলীর ব্যালান্সশিট চর্চা মাইক্রোলেভেলের তবে এর মধ্যে ম্যাক্রো পরিস্থিতির পরিচয় প্রকাশ পেতে পারে। কুলতলী গ্রামের কুলীন কুটি কুশলী শহরালী মাদবরের ছেলে আকবর লেখাপড়ায় না হোক প্রতিশোধপরায়ণতার প্যাঁচপোচে পরিপক্ব। শহর আলী জমিজমার পাহাড় গড়েননি; তবে তার গ্রামবাসীকে জমিদারের হাত থেকে মুক্ত করতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার চাটুকার ও লেঠেল লোক-লস্কর পুষে সবাইকে হাত করার বুদ্ধিতে ব্যস্ত থাকায় তাদের হাতে তিনি দুঃখজনক পরিণতি লাভ করেন ।

এদিকে আকবর আলী পিতৃ পরিণতির প্রতিশোধ নিতে বেশ ব্যতিক্রমী অবস্থান নেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সব পদক্ষেপ তার। তিনি এখন কুলতলী গ্রামের মাথা। জমিজমা বিদ্যা-বুদ্ধি সম্পদ প্রশাসন নায়েব লোকবলের শক্তি সব তার আয়ত্তে। আশপাশের মোড়ল মাদবরদের সাথে তার দহরম মহরম, দূরের কাছের সবার সাথে সম্পর্ক তলে তলে ঠিকঠাক রাখার ব্যাপারে আকবর আলীর চেলা চামুণ্ডারা তার চেয়ে মেধাবীয়ানায় অগ্রগামী। গ্রামে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে তার সবতে আকবর আলীর হাত আছে বলে তার লোকেরা প্রচার করে বেড়ায়।

আকবর ইউটিউবে শুনেছিলেন মান্নাদের সেই গানটি ‘যদি কাগজে লেখ নাম ...’ পুরো গানটি কেন জানি আকবর আজো শুনতে পারেননি। একনাগাড়ে শুনতে পান না কারণ আকবরের স্বপ্নেরা তার চেয়ে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গেঁয়ো মাদবর হয়ে ক্ষ্যান্ত হয়নি, তার চাহিদা এ গ্রামে তারা ছাড়া আর কেউ নতজানু হয়ে থাকতে পারবে না- তারা মন খুলে কথা বলতে পারবে না, বিপরীতে আকবর আলী বলে বেড়াবে বড় গলায় তার সাফল্য। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাদের থামানো বা ঠাণ্ডা করতে তার বশংবদ লেঠেল বাহিনী অসংখ্য ধারায় আটকানোর নানান পথপন্থা, স্বরচিত আইনকানুন নিয়ে লোক লস্কর তার রেডি।

আকবরের সাফ কথা গ্রামের সবার জন্য (থুক্কু তার খয়ের খাদের সাথে ভাগবাটোয়ারার ভিত্তিতে গৃহপালিতরা বাদে) সে যত কাজ করেছে তার প্রচার চাই, স্বীকৃতি চাই, স্মরণ চাই। এর জন্য তার যে অ্যাজেন্ডা আছে তার গৃহপালিত লেখক বুদ্ধিজীবী, ইতিহাস নির্মাণকারী, ওগায় ওগায়রা আছে অনেক। নিজের গ্রামে তার এ দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখিয়ে আশপাশের গ্রামে এমনকি অনেক দূরের লোকজনের সাথে আত্মীয়তা পাতাতে, সখ্য গড়ে তুলতে নিজের পুকুরের মাছটা, ক্ষেতের ফসলটা, মাথার বুদ্ধিটা পর্যন্ত বন্ধক দিতে রাজি। আকবর এটিও মনে করেন ঘরের নিজের গ্রামের লোকের সাথে মুখে মুখে নির্ভার ওরফে থোড়াই কেয়ার করা ভাব ভাবনা প্রকাশ করলেও বাইরের গ্রামের চাচা ভাতিজাদের সাথে আর কিছু লাগবে নাকি এমনতরো তেলেসমাতিতে মেতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাদের কারো সাথে তার খোলসে থেকে সমালোচনা করে নিজের শক্তিমত্তা প্রকাশ করে তলে তলে তাদের সাথে লাইন ঠিক রাখার চাণক্যীয় নীতি অবলম্বনে আকবর আলী সিদ্ধহস্ত। আকবরের ছেলে আসিফ ম্যাকিয়াভেলির ওপর গবেষণা করে। মাঝে মধ্যে আকবর ম্যাকিয়াভেলির ভান রপ্ত করতে চায়। পাশের গ্রাম থেকে বাস্তুভিটাচ্যুত লোকদের আশ্রয় দিয়ে বড় পুরস্কার পাওয়ার খায়েশ আকবর অনুভব করেন, স্বপ্ন দেখেন।

এহেন আকবর আলীর সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান ওরফে ব্যালান্সশিট কষার উদ্যোগ নেয় তার এক তল্পিবাহক যেহেতু গ্রামে তাকে টেক্কা বা পাল্লা দেয়ার প্রতিপক্ষ স্থানীয় কেউ নেই, তাই তুলনামূলক ব্যালান্সশিট কষার প্রসঙ্গ উঠছিল না। তথাপি আকবর আলীর সম্পদ ও দায়দেনার, তার লাভ ও ক্ষতিয়ান কষায় মন দিতে চায় তার হিসাব মহা-অধিকারীরা। তারা দেখান আকবরের জনপ্রিয়তার অ্যাসেট অনেক। সংসারের টাকা বুদ্ধি ও চাতুর্যের সাথে ব্যবহার করে সবাইকে দেখাবার, নাম কেনার সুযোগ তার সুপ্রচুর।

দায় খাতে ১. চাটুকার তৈরি; ২. পোষ্য তোষ্যদের নামে বেনামে সম্পদ কুক্ষিগত; ৩. ক্ষমতার ব্যবহার করে সংসারের সবার টাকা নিজের নামে ও কামে ব্যবহার করে নিজের নাম কেনার কাজটি তার জন্য সম্পদের ওপর এ দায় ক্যারিড ওভার হওয়ার উপযুক্ত; ৪. গ্রামে যারা ভালো মুনশী ছিলেন তাদের ঝেঁটিয়ে বের করে দিয়ে চাটুকারদের সামনে সম্পদের সুগার বাড়িয়ে দিয়ে তাদের ডায়াবেটিসের খাতায় নাম লেখানোতে ব্যস্ত সবাই; ৪. চোরকে চুরি করার সুযোগ দিয়ে নিজে গেরস্থ সেজে এমন উদাসীন ভাব দেখানো তার স্বভাব যে, সব কিছু হচ্ছে তার চাটুকাররা নিজেরা করেও বেচারা আকবরের নামে তা চালিয়ে দেয়। এতে দোষত্রুটি যা হয় সব তার নামের জাবেদা বইয়ে জমা হয়।

সম্রাট আকবরের পিতা হুমায়ুন যেমন এমন মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়েছিলেন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে চাটুকাররা অন্যায় করে আর তার বদনামের এন্ট্রি হয় হুমায়ুনের খাতায়। কুলতলীর আকবর আলী এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। চাটুকারদের চাটুকারীর ভাষায় ও মৌমাছিদের মৌরক্ষীদের গায়ে মৌমহারানীর নিরাপত্তার ভার অর্পিত থাকায় তিনি বহাল শক্তিতে শক্তিমান। চাটুকাররা তার কাছে ধরা খায়, ধরা খায় কেননা, তাদের কলকাঠি তার হাতে, কেউ সহজে বিদ্রোহী হতেও সাহস পায় না। কিন্তু আকবর আলীর একবারও মনে আসে না তার দুই কাঁধে কেরামান কাতিবিন (দুই বিজ্ঞ মুহুরি) আছেন যারা অনুক্ষণ রেকর্ড করে চলেছেন তার কর্মকাণ্ড। এখানে রাজনৈতিক উৎকোচ (টাকা পয়সা) দেয়ার কোনো কারবার নেই। সুযোগ নেই।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement
১৫ বছরে রাজনৈতিক পরিচয়ে পুলিশে নিয়োগ ৯০ হাজার চবি ভাষা ইনস্টিটিউটের সাথে ফ্রান্স দূতাবাসের ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা অবকাঠামো খাতে ১০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এডিবি অর্ধশত বিচারক ও কর্মকর্তার দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে রিট বিনিয়োগের অভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না : উপদেষ্টা হাসান আরিফ এখন কোনো দেশই ভারতের সাথে আপস করছে না : গয়েশ্বর চন্দ্র বিজিবির অভিযানে নভেম্বরে ১৭২ কোটি টাকার বেশি চোরাচালান পণ্য জব্দ ভারতে ধর্ষণ মামলায় সিলেটের ৪ আ’লীগ নেতা আটক বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ‘জেড ক্যাটাগরি’ ইস্যুতে বিএসইসি অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা পূরণে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই : মান্না বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করবে : আমানউল্লাহ আমান

সকল