১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জিয়াউর রহমান, মেজর থেকে রাষ্ট্রপতি

জিয়াউর রহমান - ছবি : সংগৃহীত

১. পৃথিবীতে মাঝে মধ্যে এমন নেতার আগমন ঘটে যারা ইতিহাসের পাতা রাঙিয়ে মানুষের কাছে চিরস্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকেন। ঠিক এমনই একজন নেতা এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

সততার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন, তীক্ষ্ণ মেধা ও দেশপ্রেমের অনুপম উদাহরণ সৃষ্টি করে যিনি তার সারাজীবন দেশ ও মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে উৎসর্গ করেছিলেন।

২. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ১৯৬৫ সালের আগে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রবেশাধিকার ছিল খুবই সীমিত। ক্যাডেট কলেজ থেকে অ্যাকাডিমেক রেজাল্টের মেধা তালিকার শীর্ষস্থান অধিকারীদের অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই ও সর্বদিক বিচার বিবেচনা করে সামরিক বাহিনীতে নির্বাচিত করা হতো। আর ১৯৫৩ সালে তো সেটা আরো কঠিন ছিল। কিন্তু অসাধারণ মেধাবী ও চৌকস হওয়ার কারণে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমির ১২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে জেনারেল জিয়া, জেনারেল সফিউল্লাহ, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান, মেজর জেনারেল এফ আর আল মামুন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল হামিদ, প্রাক্তন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ হায়দার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ আব্দুল হান্নান নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৫ সালে তারা কমিশন লাভ করেন। কমিশন প্রাপ্তির সময় জিয়ার পাকিস্তান আর্মি (পিএ) নম্বর ছিল ৫১১৫, আর সফিউল্লাহর পিএ নম্বর ছিল ৫১২১। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়া পেশাগত সুদক্ষ চৌকস অফিসার হিসেবে দাপটের সাথে চাকরি করেছেন। তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের কারণে জিয়া তখন হতেই সিনিয়র-জুনিয়র সবার কাছে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন।

৩. পেশাগত দক্ষতা ও অন্যান্য সব যোগ্যতার মাপকাঠিতে জিয়ার অবস্থান অনেক উপরে ছিল বলেই তিনি ভালো ভালো পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি সামরিক দক্ষতার অনন্য নজির স্থাপন করেন। ফলে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যোগ্যতার কারণে তার অনেক সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে উচ্চতর পেশাগত প্রশিক্ষণ অর্জনের সুযোগ পান। ১৯৭০ সালেই জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতির জন্য প্রথমে ২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পরে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে উপ-অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করেন। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা অত্যন্ত সূক্ষ্ম; তিনি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার মতো একজন অসাধারণ দুঃসাহসী যোদ্ধাকেই বেছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য। আর এ জন্যই হয়তো তিনি বদলি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম সেনাবিনাসে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে। দেশের স্বার্থে তার অধিনায়কের মতো সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও তিনি পিছপা হননি। এটা যে কত বড় দুঃসাধ্য কাজ তা সামরিক বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কারো বোঝা কঠিন।

৪. দেশের সেই দুঃসময়ে জিয়া আরো দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে প্রথমে বললেন, ‘উই রিভোল্ট’ এবং পরাধীনতার নাগপাশ ভেঙে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন দেশের স্বাধীনতা। যে ঘোষণা শুনে হতভম্ব জাতি দিশা খুঁজে পেল, সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ হলেন উজ্জীবিত। একের পর এক বিদ্রোহ ঘোষণা শুরু করল পূর্ব পাকিস্তানের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ইউনিট ও সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তখন থেকেই দুই অক্ষরের ‘জিয়া’ নামটি সামরিক বাহিনী সদস্য ও বাঙালিদের মুখে মুখে। জিয়া ছিল এমন এক দুঃসাহসী পিলে চমকানো নাম, যে নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হৃদয় প্রকম্পিত হতো। একইভাবে বাঙালিদের কাছে ছিল অতিপ্রিয় একজন সামরিক নেতা জিয়া। রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমান শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, একজন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স প্রধান। এভাবেই হয়তো মহাপরিকল্পনাকারী মহান আল্লাহ জিয়াকে প্রস্তুত করেছিলেন সবচেয়ে সঙ্কটময় সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শহীদ জিয়া দেশের জনগণের কাছে সশস্ত্রবাহিনীর সক্ষমতা, সম্মান ও মর্যাদাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, এখনো যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে বা সঙ্কটের সময় দেশের মানুষ সামরিক বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

৫. ১৯৭২ সালে সিনিয়র জেনারেল জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে তার জুনিয়র জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হলেও সামরিক বাহিনীতে জিয়া ছিলেন অধিক পরিচিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয়। জেনারেল সফিউল্লাহও তাকে সম্মান করতেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের যখন টালমাটাল অবস্থা তখন ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সরকার জিয়াউর রহমানকে সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাসের মাথায় সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা। জিয়াউর রহমান তখন এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, সামরিক বাহিনীর সব সদস্য এবং রাজনীতিবিদ ও তাদের কর্মীগণও জিয়াউর রহমানকে দেশের সরকার পরিচালনার শীর্ষপদে আসীন করান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করায় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।

৬. দেশ ও জনগণের স্বার্থকেই রাষ্ট্রপতি জিয়া সর্বাধিক প্রাধান্য দিতেন। তিনি রাষ্ট্রীয় অপচয় বরদাশত করতেন না। সম্পূর্ণ আড়ম্বরহীনভাবেই এ বিশাল দায়িত্ব পালন করতেন। তার ক্যাবিনেটের সদস্য এ কে এম মাঈদুল ইসলাম মুকুল তার ‘আত্মসত্তার রাজনীতি এবং আমার ভাবনা’ বইতে উল্লেখ করেন, ‘একদিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব ক্যাবিনেট মিটিংয়ে মন্ত্রীদের উদ্দেশে বললেন, দেখেন আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। আমার দেশ খুবই গরিব। পৃথিবীর সবাই তা জানে। আমাকে সি অফ (ংবব ড়ভভ) করার জন্য বা রিসিভ করার জন্য এতগুলো লোক এবং এত গাড়ি বিমানবন্দরে আসা যাওয়ার দরকার হয় না। এসব অপব্যয় বিদেশীরা কিন্তু দেখেন ও রিপোর্ট করেন এবং তারা মনে করেন তাদের দেয়া ঋণের টাকা দিয়ে এসব অপব্যয় করা হচ্ছে। রাত্রিবেলা আপনারা যখন আমাকে রিসিভ করে ফেরেন তখন মনে হয় যেন বিমানবন্দরে আগুন লেগে গেছে। সব লোক পালাচ্ছে। গাড়ির বহর একসাথে বের হচ্ছে। সুতরাং এখন থেকে শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব যাবেন এবং এটাই যথেষ্ট।’

৭. এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার নিজ মেধা, কর্মধারা, দায়িত্ববোধ, সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহস ও নিখাদ দেশপ্রেমের সাথে দেশ পরিচালনা করে আপামর জনসাধারণের কাছে অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। দেশ ও জাতির নির্ভরযোগ্য অভিভাবক হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতিতে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনে দেশকে বিশ্বের দরবারে এমন এক উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন যে, জনগণ ফিরে পায় তাদের জীবনের নিরাপত্তা, কথা বলার স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা করার অধিকার, আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধ। কিন্তু শত্রুরা চুপ করে বসে থাকেনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি-মাতৃভূমি বাংলাদেশের এ অকল্পনীয় উন্নয়নের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সহ্য করতে না পেরেই দেশ-বিদেশের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন।

৮. একটা বিষয় লক্ষ করার মতো এই যে, মুসলিম দেশগুলোতে যে নেতা বা সরকারপ্রধান জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন তাকেই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীরা জিয়াউর রহমানের মতো মহান জাতীয়তাবাদী নেতার বিপুল জনপ্রিয়তা ও দেশের উন্নয়ন মেনে নিতে পারেনি। তাই চক্রান্তকারীদের হাতে ১৯৮১ সালের ৩০ মে শাহাদত বরণ করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। একজন মহান দেশপ্রেমিক নেতাকে হারায় বাংলাদেশ। প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার মধ্য দিয়ে একটা উদীয়মান স্বাধীন সার্বভৌমত্ব দেশকে শত বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়।

৯. শহীদ রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াকে হেয় করার জন্য তার বিরুদ্ধে যারাই যত অপচেষ্টাই করুক না কেন, তাতে তার বিন্দুমাত্র অসম্মান হবে না। কেননা ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৭ এর ৩১ মে পর্যন্ত যারা এদেশে ছিলেন তারা তার কর্মকাণ্ড দেখেছেন- উপলব্ধি করেছেন, দেশকে একটা বিশৃঙ্খল, পর্যুদস্ত অবস্থা থেকে সুশৃঙ্খল, স্থিতিশীল ও উন্নতির সোপানে চড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে। শহীদ জিয়ার অন্তিম যাত্রায় ঢাকার নামাজে জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি, আর সাধারণ মানুষের কান্নার রোল স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘শহীদি মৃত্যু নহেকো মৃত্যু, নবজীবনের অভ্যুদয়’।

ইতিহাস সৃষ্টিকারী দূরদর্শী চিন্তাচেতনার অধিকারী অসাধারণ প্রতিভাবান কালজয়ী পুরুষ জিয়াউর রহমানের বারবার জন্ম হয় না। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে ধূমকেতুর মতো এদের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যত দিন টিকে থাকবে, জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকবেন এ দেশের মাটি ও মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে।

লেখক : নিরাপত্তা ও ইতিহাস বিশ্লেষক, সমাজসেবক
Email: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement