১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দৃষ্টি নিজের দিকেই ফেরাতে হবে

দৃষ্টি নিজের দিকেই ফেরাতে হবে - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশকে কে কার দৃষ্টিতে দেখছে এবং কিভাবে মূল্যায়ন করে সেটিই এখন অনেকের আলোচনার বিষয়। তবে এটি এখন আর বাংলাদেশের কাছে ধর্তব্যের বিষয় হতে পারে না। বরং বিষয়গুলো গৌণ হিসেবে সাব্যস্ত হচ্ছে। এগুলো একান্তই সংশ্লিষ্টদের ব্যাপার।

বাংলাদেশের মানুষ এখন নিজের দৃষ্টিতে সবকিছু দেখতে চায়। আশপাশে দূরে কাছের দেশগুলোকে। এই জনপদের মানুষ হয়তো এতকাল তাদের দৃষ্টি কুঞ্চিত করে রেখেছিল। তবে এখন তারা চোখ প্রসারিত করে দেখবে। অতি নিকট, দূর, দূর পশ্চিমে এবং উত্তরে কে তার সত্যিকার বন্ধু সুহৃদ ও মিত্র। কে তার ছদ্মবেশী বন্ধু। এখান থেকে যারা কেবল তার স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত তৎপর। সেগুলোর চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করবে দেশের মানুষ। এখন নিজের স্বার্থকে শুধু প্রথম নয়, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নেবে। কেউ মনে করবেন না নিজের দিকে তাকানো। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়। ইংরেজিতে একটি শব্দ হচ্ছে চুজি হওয়া। এ দেশ বন্ধু বানাতে এখন থেকে চুজি হবে।

ধন্যবাদ জানাই তাদের, যাদের অতি উৎসাহ অতি আকাক্সক্ষা এ জনপদে লক্ষ্য করা গেছে এবং সেটাই জনপদের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে তারা আমাদের সাহায্য করছে। এমন বোধ জাগাতে, থেকে ঘুরে দাঁড়াতে এবং আত্ম আবিষ্কারের চেতনাকে জাগাতে হবে। মানুষ বিবেচনা করছে, কোন ‘মিত্র’ কিভাবে কেবল নিজের স্বার্থ হাসিলে তৎপর। এই তারাই এই ভূভাগ থেকে সব সার নির্যাস শুষে নিতে চায় এবং এই দেশকে ছোবড়া করে দিতে চায়। এমন সব কুকর্ম সুচারুভাবে সমাধান করতে এক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। দেশের মানুষের গাটের পয়সা খরচ করে ওই নেটওয়ার্ক তৈরি করে দিতে তৎপর কর্তৃপক্ষ। মানুষ এসব গভীরভাবে লক্ষ্য করছে। কিছুটা দেরি হয়েছে বটে। তবে দেরি হলেও মানুষ হুঁশ ফিরে পেতে শুরু করেছে।

সব কিছু রিভার্স করতে অর্থাৎ বিপরীতমুখী করতে অবশ্যই কিছু সময় লাগবে, বাধার সম্মুখীন হতে হবে। লক্ষ্য স্থির করে দূর প্রতিজ্ঞা থাকলে সব বাধা অতিক্রম করার সুযোগ অবশ্যই সৃষ্টি হয়। যারা এই ক্রান্তিকালকে উপলব্ধি করছেন তাদের সবাইকে সব ভেদাভেদ ঘুচিয়ে অগ্রসর হওয়া জরুরি। আর পথে নামলেই পথ বলে দেবে কোন সে পথে দিগন্তে পৌঁছাতে হবে। ঐক্যের অটুট দেয়াল নির্মাণ এমন দেশ ও দশের দাবি। ব্যক্তি নয়, দল নয়, কোন গোষ্ঠীবিশেষ নয়, সর্বত্র সবাই একই বন্ধনে জড়িয়ে হাতে হাত ধরে মিছিলে নামতে হবে। লক্ষ্য শুধু জাতীয় স্বার্থকে উচ্চকিত করা। অবশ্যই এ জন্য এই জনপদের ‘অনেকেই’ ওই ছদ্মবেশী বন্ধুদের জন্য এখানে শেকড় গাড়তে সহায়তা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। তাদের এ দেশের মানুষ চেনে জানে এবং তাদের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখছে। তবে এসবের প্রতিবিধান করার যাবতীয় কলকব্জা ‘সেই অনেকেরই’ কাছে এখন জব্দ। সেই কলটি হচ্ছে ভোটের অধিকার। সেই অধিকার ফিরে পেতে এই মুহূর্ত থেকে মরিয়া হতে হবে।

‘সেই অনেক’ এখন তাদের দল ভারী করার জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদকে অকাতরে বিলিবণ্টন করছে এখানে সেখানে। সেই ‘অনেক’কেই দেশের মানুষ ‘খল’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে। সেই ‘অনেক’ কিন্তু বসে নেই। তারা দেশের মানুষকে উপেক্ষা আর অবহেলা করে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তারা জীবন্মৃত হয়ে গেছে। কিন্তু এতে তাদের কিছুই এসে যায় না। এমন মৃতপ্রায় মানুষই তাদের কাম্য। অথচ এ দেশের মালিক মোক্তার এই ভূখণ্ডের ১৮ কোটি মানুষ। এই মালিকরা বিধিবদ্ধ। অথচ তারা এখন অনেকটা যেন নিজের দেশেই উদ্বাস্তু। জাতিকে সেই মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে হবে। আর বলতে হবে ‘বল বীর চির উন্নত মম শির/শির নেহারি আমারই/নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।’ লক্ষ্য হবে বিজয় না হওয়া পর্যন্ত কেউ আর ঘরে আর ফিরবো না। শুধু রাজনীতিকে এভাবে বিন্যাস করলেই চলবে না। আরো বহু নতুন বাস্তবতায় এই বোধকে সঞ্চারিত করতে হবে। যারা জাতিসত্তার অনুসন্ধানে নিবেদিত এবং নিজেদের শেখড় সন্ধানে ব্রতী। তাদের এই মিছিলে শামিল করতে হবে।

কেউ কেউ একে সুনজরে দেখবে না বরং অভিহিত করতে চাইবে এমন বোল উচ্চারণ করে বলবে- এ তো সাম্প্রদায়িকতা। অথচ যিনি এই বোল উচ্চারণ করে গালমন্দ করছে তারাও কি একটি ছোট কোনো বলয়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা এ দেশে লাখো কোটি মানুষের চিন্তাচেতনার অবশ্যই প্রতিপক্ষ, তা নয় কি! তাহলে তারা একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সদস্য! এ দেশের মানুষের চিন্তাচেতনা, মন-মানসের বিপরীতে কি অবস্থান করছেন না তারা। এরা আসলেই ‘মাইক্রোস্কপিক মাইনোরিটি’। এরাও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সাথে অঙ্গীভূত বললে ভুল হবে না। তাদের দৃষ্টি মন-মানস ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাইরে অবস্থান করে।

মনে রাখা দরকার, শাক দিয়ে কখনো মাছ ঢাকা যায় না। সবাই জানেন, যারা এমন সব বাক্য বাচন নিয়ে উল্লম্ফন করেন, তারা কিন্তু কখনোই স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না। যখন যেখানে কিছু প্রাপ্তির গন্ধ পায় সেখানেই সারিবদ্ধ হয়। আসলে এরা সব স্রোতের শ্যাওলা। স্রোত যখন যেদিকে নিয়ে চলে তখন সে দিকেই ছোটে। এরা জাতির মূল শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। এরা আসলে উচ্ছিষ্টভোগী।

উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের পুনর্বিন্যাস করা প্রধান কলকব্জা তথা নির্বাচনের পথ পদ্ধতি মানুষের হাত থেকে ছিনতাই করা হয়েছে। ছিনতাইকারীর এ কাজে মদদ দিয়েছে বহু পক্ষ। পাশের, দূরের, উত্তরের, পশ্চিমের সবাই। তবে তাদের অনেকের জন্যই সেটি হয়েছে বুমেরাং। বিশেষ করে নিকটের, পশ্চিমের এবং উত্তরেরও সেই ‘বন্ধুরা’ প্রমাণ করেছেন তারা নীতিভ্রষ্ট। তারা নিজেদের ঘোষিত নীতি থেকে কত দ্রুত সরে যেতে পারে সেটি দেখেছে মানুষ। অদ্ভুত সেই পশ্চাদপসরণে এ দেশের মানুষ হতবাক হয়েছে। পশ্চিম মই দিয়ে গাছে তুলে দিয়ে মইটা সরিয়ে নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার সব স্তর থেকে হারিয়ে গেল। উত্তরের একটি বড় এক দেশ এখান থেকে ক্ষীর মাখন খেতে পারবে। এই ভাবনায় ছিল বিভোর। তাই এখানে পক্ষ শক্তির সুহৃদ সেজে তাদের তুলকালাম কাণ্ডে ছিল নীরব। খেলা শেষে এখন দেখা গেল তাদের হাতে কাঁচা কদলি তুলে দেয়া হয়েছে। এতে নিজেদের এমন মূঢ়তার কথাই এখন তাদের ভাবতে হবে।

যারা জন্ম থেকেই এ ভূভাগের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে স্বীকার করে নিতে ছিল নারাজ। তারা হয়তো কৌটিল্য কৌশলের সুবাদে নিজেদের সাময়িককালের জন্য লাভবান ভাবছেন। এই ভাবনা একেবারের সাময়িক বজ্র আঁটুনিতে ফসকা গেরোর মতো। কথাটি সবার মনে রাখা দরকার। এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ এখন মনে চিন্তা-চেতনা ধ্যান-ধারণা এবং সিদ্ধান্ত যেখানে এসে পৌঁছেছে। কেউ কি কল্পনা করেছিল এমনটি। হয়তো বিস্মিত করছে কাছের ‘বন্ধুকে’। দেশের মানুষ আবার এ ভূভাগের ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখতে শুরু করেছে। অতীতে এই উপমহাদেশের কার কেমন ভূমিকা ছিল। যশোবন্ত সিংয়ের বিখ্যাত পুস্তক ‘জিন্নাহ, ভারত দেশ ভাগ স্বাধীনতা’ শেষ চরণটা হচ্ছে ‘এবং এ থেকে তৈরি হওয়া একটা গল্প : তবে আল্লাহ তো নিজেই সব জানেন!’ হ্যাঁ এ দেশের ৯৫ ভাগ মানুষও একটাই বিশ্বাস করেন, আল্লাহ সব জানেন এবং সব দেখেন। আজ না হয় কাল তিনি তাঁর এই ভূভাগের দাসদের পাশে অবশ্যই দাঁড়াবেন। যারা নিছক বাস্তবতা দিয়ে সব বিচার করে তারা এই বিশ্বাসকে পলায়নপর মনোভাব বলে মনে করতে পারেন। এটি মনকে প্রবোধ দেয়া মনে করতে পারেন। কিন্তু যারা ওই বিশ্বাস নিয়ে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াতে পারেন- অবশ্যই পুরস্কার একদিন তারা পাবেন। ইতিহাস বারবার বহুবার সেটা প্রমাণ করেছে। অবশ্যই কিছু পেতে হলে দিতে হয়। সেটা ধৈর্য হতে পারে, পরিশ্রমও হতে পারে, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ হতে পারে। গত দেড় যুগ থেকে এ দেশের মানুষ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ধৈর্য এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছে। সে জন্য অদূরভবিষ্যতে তাদের জন্য পুরস্কার হয়তো মোড়কে বাঁধা হচ্ছে।

[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement