১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
তৃতীয় নয়ন

ভাবী : তার মা, বাবা ও ফুফা

ভাবী : তার মা, বাবা ও ফুফা - নয়া দিগন্ত

ভাবী বিলকিস রহমান (মালা) মারা গেলেন ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর। তিনি কিডনির রোগে ভুগছিলেন। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৮ বছর। তিনি ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক বজলুর রহমানের কন্যা। মরহুম বজলুর রহমান তদানীন্তন ‘দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার’-এর Roving Correspondent ছিলেন। পরে দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সাব-এডিটর অর্থাৎ শিফট ইনচার্জ হয়েছিলেন। তদানীন্তন দৈনিক সংবাদেও কাজ করেছেন। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তাকে ইত্তেফাকের জেনারেল ম্যানেজার পদে নিয়োগ করেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত পটভূমির পর তাকে সরে যেতে হয়। তিনি শেষজীবনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত ও বিএনপির মুখপত্র, ‘দৈনিক দেশ’-এর অন্যতম সহকারী সম্পাদক ছিলেন।

ভাবীর মা রাজনৈতিক আলাপ করতে ভালো বাসতেন। তিনি আমার সাথে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মিরপুরে সংঘটিত ঘটনাগুলো নিয়ে বারবার আলোচনা করেছেন।

তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন মরহুম কবি কাজী রোজী। কাজী রোজী ছিলেন মরহুম কবি সিকান্দার আবু জাফরের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপি। এখনো তাদের বাসা কাছাকাছি। ভাবীর মা ছিলেন ঘোরতর আওয়ামী লীগার। কিন্তু তিনি কোনো দিন আব্দুল কাদের মোল্লার নামও উচ্চারণ করেননি। কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে যুদ্ধাপরাধের কারণে। ভাবীর মায়ের জানা থাকলে তিনি নিশ্চয়ই কাদের মোল্লার নাম একবার হলেও আমার কাছে উচ্চারণ করতেন।

ভাবীর আব্বা মরহুম বজলুর রহমানকে দেখেছি অসুস্থ অবস্থায়ও ‘দৈনিক দেশ’-এ সম্পাদকীয় লেখা পাঠাতেন। তিনি ভুগছিলেন উচ্চ রক্তচাপে । ১৯৮৭ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন। তার কাছে নেতার চেয়েও নীতি বড় ছিল। এ কারণে জিয়াউর রহমানকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। তখন ‘দৈনিক দেশ’ চালাতেন মরহুম ‘স্পষ্টভাষী’ খন্দকার আবদুল হামিদ।

ভাবীর ফুফা সম্প্রতি মারা গিয়েছেন ফেনীতে। ফুফু আগেই মারা গিয়েছিলেন ঢাকার বারডেম হাসপাতালে। ফুফা ডা: জুলফিকার ইসলাম ফেনীর নামকরা চক্ষু চিকিৎসক ছিলেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কখনো সার্টিফিকেটের কাঙাল ছিলেন না। ডা: জেড ইসলাম ৮ মার্চ শুক্রবার বিকেলে ফেনীতে ইন্তেকাল করেন। ওই দিন রাত ১০টায় ফেনীর ঐতিহাসিক মিজান ময়দানে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর তাকে ধর্মপুর বা জোরকাছাড়-এর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি ১৯৭১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের চোত্তাখোলা ইয়ুথ ক্যাম্পের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো দিন মুক্তিযোদ্ধা সনদের পিছে ঘোরেননি। এ জন্য তাকে দাফন করা হয়েছে একজন অমুক্তিযোদ্ধা সাধারণ মানুষের মতো।

ডা: জেড ইসলাম জীবনকে উৎসর্গ করেছেন ইসলামের জন্য। তিনি তাবলিগ জামাতের একজন সংগঠক ছিলেন এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ ফিজি পর্যন্ত সফর করেছেন। অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি ইসলামের জন্য কাজ করা থেকে বিরত থাকেননি। তিনি ফিজিতে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের প্রশংসা করেন এবং বলেন, ফিজিতে হিন্দুরা অনেক দিন ধরে থাকলেও তারা মুসলমানদের বিরোধী নয়। পাশাপাশি ঘরে এই দুই সম্প্রদায় বসবাস করছে শান্তিপূর্ণভাবে।

ভাবীর আব্বার ট্র্যাজেডি হচ্ছে- অনেকেই ‘বজলুর রহমান’ বলতে সংসদীয় উপনেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর স্বামী, ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সাবেক সম্পাদক বজলুর রহমানকে স্মরণ করেন। কিন্তু সিনিয়র বজলুর রহমানকে চেনেন না। আত্মপ্রচারবিমুখ এই মানুষটি ছিলেন উদার ও সহনশীল। তিনি একদিন খাওয়ার সময় তার বাসায় আমাকে বলেছিলেন, ‘মীযান, যুদ্ধের সময় প্রথমে সত্যকে হত্যা করা হয়।’ আমি কথাটা তুলেছিলাম ১৯৭১ সালে দুই পক্ষের প্রচারণা সম্পর্কে।

তিনি জবাবে বলেছিলেন, যুদ্ধের সময় সত্যকে হত্যা না করলে কারো স্বার্থসিদ্ধি হয় না। তিনি চলাফেরায়ও ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ। ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি হঠাৎ মারা যান তার বাসায়। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান দু’টি কন্যা, এক পুত্রসন্তান ও স্ত্রীকে। ঢাকার মিরপুরে তার কবর রয়েছে। তিনি দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু কোনো নামকরা সাংবাদিক তাকে দেখতে যাননি। এ নিয়ে তার পরিবারের মনে ক্ষোভ রয়েছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৬২ বছর।


আরো সংবাদ



premium cement