১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যে চা পান ক্ষতিকর

লেখক ইকতেদার আহমেদ। - ছবি : নয়া দিগন্ত

চা প্রাচীন কাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব চীনে ভেষজ পানীয় হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় ছিল। সে সময় তারা প্রত্যুষে কাজের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পাত্রে পানীয় হিসেবে সাথে চা রাখত এবং তারা একটু পরপর কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনব্যাপী তা পান করত। সে সময় তাদের মধ্যে চা নিয়ে এই বিশ্বাস কাজ করত যে, চা পান করলে ক্লান্তি দূর হয়ে শরীরে সতেজতা আসে। দক্ষিণ-পূর্ব চীনের জনমানুষ সে সময় যে চা পান করত তা ফুটন্ত পানিতে শুকনো চা পাতা হতে নির্গত নির্যাস। দক্ষিণ-পূর্ব চীন হতে ক্রমান্বয়ে চা চীনের অপরাপর অংশসহ কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের কাছে ভেষজ পানীয় হিসেবে মানবদেহের জন্য উপকারী বিবেচনায় পরিচিতি পায় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে পদ্ধতিতে তাদের পূর্ব-পুরুষরা চা পান করত তা এখনো তাদের মধ্যে অক্ষুণ্ন রেখেছে। এসব অঞ্চলের কর্মজীবী খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ তাদের পূর্ব-পুরুষদের ন্যায় সকালে ঘর হতে বের হওয়ার সময় প্লাস্টিকের বোতলে করে পানীয় হিসেবে চা সাথে নিতে কখনো ভুল করে না। এদের চা পান ও দক্ষিণ-পূর্ব চীনের জনমানুষের ন্যায় ফুটন্ত পানির মধ্যে চা পাতার নির্যাস ছাড়া অন্য কিছু নয়। ভেষজ পানীয় হিসেবে চা পান করার কারণে ধারণা করা হয় চীন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের কর্মজীবী খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সমশ্রেণীর মানুষের তুলনায় রোগ বালাইয়ের প্রকোপ অনেক কম।

পর্তুগিজ যাজক ও বণিকদের মাধ্যমে ষোড়শ শতকে ইউরোপের বাজারে চায়ের প্রবেশ ঘটে। এরপর সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশদের মধ্যে ব্যাপকভাবে চা খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম বৃহদাকারে বাণিজ্যিক উদ্দেশে তাদের তৎকালীন উপনিবেশ ভারতে চায়ের চাষ শুরু করে। আরব বণিকদের মাধ্যমে চা আরব দেশগুলোতে প্রবেশ করে। পর্তুগিজ ও আরব বণিকরা স্ব স্ব দেশে চা নিয়ে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে এটিকে জনপ্রিয় করতে এর মধ্যে চিনি, লেবু, মসলা প্রভৃতির সমারোহ ঘটায়। ব্রিটিশরা তাদের চেয়েও আরো একধাপ এগিয়ে চায়ের সাথে চিনি ও দুধ মিশিয়ে এটিকে অধিকতর সুস্বাদু পানীয় হিসেবে প্রচলনের প্রয়াস নেয়। ব্রিটিশদের এ প্রয়াসের অংশ হিসেবে দেখা যায় আমাদের উপমহাদেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশে চা উৎপাদন পরবর্তী ব্রিটিশরা ভেষজ পানীয় হিসেবে সাধারণ জনমানুষের মধ্যে চা জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে কোনো সফলতা পায়নি। এরপর তারা চায়ের প্রতি মানুষের আসক্তি সৃষ্টিতে বিনা পয়সায় দুধ ও চিনিমিশ্রিত চা বিভিন্ন হাট-বাজারে সাধারণের মাঝে এটি পানের ব্যবস্থা করে। এতেও যখন তারা চায়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আসক্তি সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় তখন তারা এক কাপ চায়ের সাথে বিনামূল্যে একটি করে বিস্কুট দেয়ার প্রচলন ঘটায়। তাদের এ উদ্যোগ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সফলতা পায়। এ সফলতা পুঁজি করে ব্রিটিশরা এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের বিভিন্ন উপনিবেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চা চাষ করে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। কিন্তু তারা এশিয়া ও আফ্রিকার সাধারণ জনমানুষের মধ্যে যে পদ্ধতিতে অর্থাৎ দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা পানের অভ্যাস গড়ে তুলেছে; তাতে ভেষজ চা পানের মাধ্যমে মানুষ যে উপকার পেত তার পরিবর্তে অপকারের প্রবণতা দেখা দেয়।

আমাদের দেশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা কোনো ধরনের কায়িক পরিশ্রম করে না অথচ দিনে বেশ কয়েক কাপ দুধ ও চিনিমিশ্রিত চা পান করে। এসব মানুষের মধ্যে শরীরের ওজন ও মেদ বৃদ্ধির প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যা তাদের জন্য বিভিন্ন রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। এমনকি যারা কায়িক পরিশ্রম করে এমন মানুষের জন্যও দিনে একাধিক কাপ দুধ ও চিনিমিশ্রিত চা পান করা নিরাপদ নয়। কিন্তু যথাযথ সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে কিছুতে প্রতিদিন দুধ ও চিনিমিশ্রিত একাধিক কাপ চা পান করা হতে নিবৃত রাখা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে গৃহে বা অফিসে অতিথি এলে তাদের আর কিছু না হলেও চা দিয়ে আপ্যায়ন একটি সাধারণ রেওয়াজ। বন্ধুবান্ধবের ক্ষেত্রেও দেখা যায় চলাফেরায় একে অপরকে বিভিন্ন স্থানে আপ্যায়নের সময় অপর কিছু থাকুক বা না থাকুক চা যেন না থাকলে নয়। আজ থেকে তিন যুগেরও অধিক সময় আগে চা দিয়ে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে সর্বত্র দুধ ও চিনিমিশ্রিত চায়ের প্রাধান্য ছিল। দুধ ও চিনিমিশ্রিত চায়ের ক্ষতিকারক প্রভাব বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি পরবর্তী সময় দেখা যায় ধীরে ধীরে মানুষ প্রথমে দুধমিশ্রিত চা পানের পরিবর্তে চিনিমিশ্রিত চা পান শুরু করে এবং এরপর চিনিমিশ্রিত চা পান ত্যাগ করে শুধু লিকার চা পান করার অভ্যাস গড়ে তোলে। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি বা আধাসরকারি খুব কম অফিস পাওয়া যাবে যেখানে অতিথিদের দুধ চা দ্বারা আপ্যায়নের প্রচলন রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সভা ও মতবিনিময়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, বানানো চা পরিবেশনের ক্ষেত্রে সচরাচর তা লাল চা বা লিকার চা হয়ে থাকে। এখানে চায়ের সাথে একজন ব্যক্তি চিনি মিশিয়ে চা পান করবেন কি করবেন না তা তার একান্ত ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। একজন মানুষের একান্ত ইচ্ছা যাতে কোনোভাবে প্রভাবিত না হয় এ কারণে বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠানে চা পরিবেশন ব্যবস্থায় গরম পানি, টি ব্যাগ, চিনি ও দুধ আলাদাভাবে দেয়া থাকে। এ ধরনের পরিবেশনায় দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ দুধ ও চিনি মিশ্রণ ব্যতীত লিকার চা পানে অধিক আগ্রহ দেখায়।

আমাদের দেশে বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিদিন সকাল ও বিকালে দু’কাপ চা পান যেন জীবনের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। এ দু’কাপ চা পানের ক্ষেত্রেও অনেকের মধ্যে লিকার চা বা লাল চা পানের প্রতি আগ্রহ স্বাস্থ্য সচেতনতা দিক থেকে উৎসাহব্যঞ্জক হলেও চিনিবিহীন লিকার চা যে অধিক ফলপ্রদ সে বিষয়টি নিয়ে সবার ভাববার প্রয়োজন রয়েছে।

আমাদের দেশের সাধারণ জনমানুষের মধ্যে চা পানের প্রতি যে প্রবণতা তা বোধকরি এত বেশি হতো না যদি না বাণিজ্যিক উদ্দেশে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকরা এ উপমহাদেশে চা আবাদের প্রচলন না ঘটাতো। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে আমাদের এ অঞ্চল অর্থাৎ আগেকার পূর্ব-পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে যে সংখ্যক চা বাগান ছিল তাদের বিদায় পরবর্তী বাগানের সংখ্যা না বাড়লেও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সে উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে হয়ে উঠতে পারছে না।

পৃথিবীর অনেক দেশে পানীয় হিসেবে চায়ের বিকল্প কফি জনপ্রিয়। চা আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হওয়ার কারণে কফি যেন চায়ের ন্যায় সাশ্রয়ী না হয় সে কারণে এটি আমদানির ওপর উচ্চ করারোপ হয়ে থাকে। যেসব দেশে কফি জনপ্রিয় সেসব দেশের জনমানুষের মধ্যে চায়ের ন্যায় দুধ-চিনিমিশ্রিত কফি পানের প্রবণতা থাকলেও সচেতন মানুষ নিজেদের দুধ-চিনির ক্ষতিকর প্রভাব হতে রক্ষার বিষয়টিকে মাথায় রেখে লিকার কফি অর্থাৎ দুধ-চিনি মিশ্রিতবিহীন কফি পান বেছে নেয়।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মাঝারি আকারের কাপে চা পান করে থাকে। বিভিন্ন চায়ের দোকানে চা পান করতে গেলে সচরাচর অর্ধেক অথবা কাপের দু’তৃতীয়াংশ পরিমাণ পানীয় থাকে। কিন্তু শীত প্রধান দেশের ক্ষেত্রে সেখানকার মানুষ মগে কফি পান করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং এ সব মগে কফির পরিমাণ আমাদের দেশের তুলনায় দু’তিনগুণ বেশি হয়ে থাকে। সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রচেষ্টায় বান্দরবান জেলার কিছু অঞ্চলে কফি চাষে সফলতা পাওয়া গেলেও প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে এটি চাষে ভাটা পড়ার বিষয়টি লক্ষণীয়। চায়ের ন্যায় এটির চাষ সম্প্রসারণ এবং উৎপাদকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে পতিত অনাবাদি জমিতে কফির চাষে যে বিস্তৃতি ঘটবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বর্তমানে আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ কফির চাহিদা আমদানির মাধ্যমে মিটানো হয়। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমেই চাহিদার সম্পূর্ণটুকু মিটানো সম্ভব এমনই আশাবাদ উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের।
বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পূর্ববর্তী পূর্ব-পাকিস্তান হতে ব্যাপক হারে চা রফতানি হতো। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরও সে প্রবণতা অব্যাহত আছে যদিও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ক্রমান্বয়ে চা রফতানি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আধুনিক চাষপদ্ধতি প্রবর্তন পরবর্তী অন্যান্য ফসলের উৎপাদন যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে চায়ের ক্ষেত্রে তা এখনো প্রত্যক্ষ করা যায়নি; তবে বিজ্ঞানীদের আশাবাদ অচিরে তারা অধিক উৎপাদনশীল চা গাছ উদ্ভাবনে সফলতা পাবেন, যা চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাবে।

বর্তমানে সারা বিশ্বে চা এমন একটি পানীয় যার সাথে বয়স নির্বিভেদে সবার পরিচয়ের পাশাপাশি পানের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুধ ও চিনিমিশ্রিত চা ভেষজ পানীয় হিসেবে আখ্যা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভেষজ চা যেখানে বিভিন্ন রোগের উপসমের কারণ; ঠিক এর বিপরীত দুধ ও চিনিমিশ্রিত চা পান দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন ও মেদ বৃদ্ধির পাশাপাশি মূত্র বৃদ্ধিকারক। দুধ ও চিনিমিশ্রিত চা ক্ষতিকরভাবে স্নায়ু উদ্দীপক। অপর দিকে ভেষজ চা ক্ষতিহীনভাবে স্নায়ু উদ্দীপক। চায়ের মধ্যে যে উপাদানের কারণে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় সেটিকে বলা হয় ক্যাফেইন। ক্যাফেইনের সাথে দুধ ও চিনির মিশ্রণ সবসময় ক্ষতির কারণ। অপর দিকে ভেষজ চা হিসেবে তাতে ক্যাফেইনের উপস্থিতি ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত। সার্বিক বিবেচনায় দুধ ও চিনিমিশ্রিত চা ভেষজ চা বা লিকার চায়ের তুলনায় ক্ষতিকর বিধায় কালেভদ্রে দুয়েক কাপ পান করা যেতে পারে। কিন্তু এ দুয়েক কাপ যেন কোনোভাবে আসক্তি হিসেবে দেখা দিয়ে অভ্যাস গড়ে না তোলে সে বিষয়ে সবার সজাগ হওয়া জরুরি। আর এর গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের সবাইকে দুধ-চিনি মিশ্রিত চা-কে ‘না’ বলে এর ক্ষতিকর দিক হতে নিজেদের রক্ষা করতে হবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement