২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ডলার কি আধিপত্য হারাচ্ছে

ডলার কি আধিপত্য হারাচ্ছে। - ছবি : সংগৃহীত

বহু বছর ধরে, বিশ্বের অনেক দেশ ডলারকে ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল। এই নিষেধাজ্ঞার হাতিয়ারের সফল প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনতে প্ররোচিত করেছিল। এ ছাড়াও ডলার লেনদেনে মার্কিন ব্যাংকিং সেক্টরের একচ্ছত্র এখতিয়ার থাকায় অনেক দেশে বছরের পর বছর ধরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের রাশিয়ার ওপর সার্বিক নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকিয়ে দেয়ায় ডলারের আধিপত্যকে দুর্বল করার জন্য ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইন (ডিডিসি) প্রচেষ্টার পুনরুত্থান শুরু হয়েছে আগের চেয়ে আরো বেশি ক্ষোভের সাথে।

অতীতে বিক্ষিপ্তভাবে ইউরো, ইউয়ান ও রুবলের দ্বারা ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইনের ঝাঁকুনি দেয়া সত্তে¡ও ডলার তার বিশ্বব্যাপী আধিপত্যকে ধরে রাখতে পেরেছে। ইউরোর আবির্ভাব হয় ১৯৯৯ সালে। ইউরোজোনের ২০টি দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি একক মুদ্রা, দীর্ঘ প্রায় ২৩ বছরের প্রবল যুদ্ধের পর ডলারাইজড গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সির (জিআরসি) ২০ শতাংশ শেয়ার লাভ করতে পেরেছে। চীনের ইউয়ান, কয়েক দশক ধরে ডলারের বিরুদ্ধে অবিরাম বিতর্কিত প্রচারণার পরে, ইয়েন (৫.২ শতাংশ) এবং পাউন্ড স্টার্লিং (৪.৯ শতাংশ) এবং জিআরসি মাত্র ৩ শতাংশ শেয়ার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ইউরোর অপ্রতুল সাফল্যের কথা উল্লেখ করে, নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট মুণ্ডেল তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে, ইউরোজোনের দেশগুলোর একটি সমন্বিত সাধারণ মুদ্রাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, তাদের একই ধরনের ব্যবসায় চক্র, বিরোধহীন শ্রমব্যবস্থা ও পুঁজির গতিশীলতা এবং ঝুঁকি শেয়ার করার মেকানিজম থাকতে হবে।

গত ক’বছর ধরে ডলার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইন (ডিডিসি) শুরু হয়েছে নতুন উদ্যমে, ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংক্ষিপ্ত রূপ) নেতৃত্বে। প্রশ্ন হলো- ব্রিকসের মাধ্যমে ডিডিসি প্রচেষ্টা কতটা সম্ভব এবং কত দ্রুত সফল হবে? তবে বিগত দিনের ডলার পতন আন্দোলনের ইতিহাসের ভিত্তিতে বলা যায়, ডলারের আধিপত্য এত তাড়াতাড়ি এবং এত সহজে পতন ঘটানো সহজ নাও হতে পারে। কারণ প্রথমত, ব্রিকস হলো এমন কিছু দেশের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা যার দেশগুলোর পরস্পরের সাথে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। দেশগুলো যেন মুক্তবাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদ, মিশ্র অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সাথে গণতন্ত্রী ও স্বৈরচারী কিছু দেশের একটি ককটেল। এই দেশগুলোর বেশির ভাগ তাদের নিজেদের মধ্যে যতটা না ব্যবসায় করে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের সাথে। চীন ও ভারতের বর্ডার নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী এবং বর্তমানে তা বহুগুণে বাড়ছে। রাশিয়া অর্থনৈতিক ও আর্থিকভাবে স্ব-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্রাজিল এক দশক পিছিয়ে পড়েছে; দক্ষিণ আফ্রিকা করোনা মহামারীর আগেও মন্দার খাদে আটকে গিয়েছিল। এ ছাড়াও ডলারাইজড গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি (জিআরসি) হিসেবে কাজ করার জন্য যথেষ্ট কার্যকর মুদ্রা তৈরি করার জন্য ব্রিকস দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় স্তরের আস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। এমনকি চীনের রয়েছে অনেক ঘাটতি, যেমন- তাদের অর্থনীতি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো মুক্ত, লিক্যুইড ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত পুঁজিবাজার নেই।

এ ছাড়াও চীনের ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির বিপরীতে মার্কিন অর্থনীতি প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের, যা সর্ববৃহৎ অর্থনীতি, সবচেয়ে নমনীয় এবং ডলারের পূর্ব প্রাধান্যপূর্ণ অবস্থার কারণে সৃষ্ট বৃহৎ বাণিজ্য ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য যথেষ্ট উন্মুক্ত। এ ছাড়াও আইনের শাসন, কার্যকর ভারসাম্য এবং মুক্ত মিডিয়াসহ সবচেয়ে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অর্থনীতি এবং দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বৃহত্তম আর্থিক বাজার হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ ডলারে হয় এবং সমস্ত আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক ঋণ সিকিউরিটিগুলোর প্রায় সমান শতাংশ ডলারে সংরক্ষিত হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে মুদ্রার লেনদেন মোট লেনদেনের প্রায় ৯০ শতাংশে ডলারে হয়। উল্লেখ্য, বিশ্বে প্রায় ১.৭৪ ট্রিলিয়ন ডলারের পেপার সার্কুলেশন রয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৭২ শতাংশ সার্কুলেশন আমেরিকার বাইরে।

ডলার বিশ্বের ১৮৫টি মুদ্রার মধ্যে মাত্র একটি। কিন্তু বাকি ১৮৪টি দেশের বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করলেও ডলারও ব্যবহার করে। ঐতিহাসিকভাবে শীর্ষ রফতানি হিসেবে মার্কিন বাণিজ্যের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ডলার অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি অন্য কোনো পণ্যের মতো বাণিজ্যের ভারসাম্যকে মার্কিন অনুকূলে ঝুঁকিয়ে দেয়। এভাবে ডলার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগ পর্যন্ত সামান্য চ্যালেঞ্জের সাথে রাজত্ব করে আসছে। প্রশ্ন হলো- অন্য কোনো দেশের মুদ্রিত কাগজি মুদ্রাটি অন্য সমস্ত দেশের ভৌত পণ্য এবং পরিষেবাগুলো কিনতে পারার শক্তি রয়েছে? অথবা বিশ্বজুড়ে অন্য দেশ তার পণ্য এবং সেবা ক্রয়ের জন্য আপনার কাগজের মুদ্রা ব্যবহার করে? উত্তর যদি না হয় তাহলে কেন এত সহজে এবং এত তাড়াতাড়ি ডলার আত্মসমর্পণ করবে?

একটি মুদ্রাকে ডলারাইজড গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি (জিআরসি) হিসেবে যোগ্যতা অর্জনের জন্য হোল্ডিং দেশকে অবশ্যই চারটি পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে। যেমন- ক. একটি বৃহৎ ও উন্নত অর্থনীতি থাকতে হবে; খ. স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি উভয় ধরনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ধাক্কা সহ্য করতে সক্ষম হতে হবে; গ. দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপী আস্থা থাকতে হবে; ঘ. অবশ্যই তরল ও স্বচ্ছ আর্থিক পুঁজিবাজার থাকতে হবে।

বর্তমানে ইউরো বা ইউয়ান কোনোটি এই চারটি মৌলিক শর্ত সন্তুষ্ট করে না। এমনকি যদি ব্রিকস দেশগুলো জিআরসি চালু করে, তবুও তারা তাদের রিজার্ভ হিসেবে ডলার, এমনকি বাণিজ্য করার জন্য তাদের সম্পদের একটি বড় অংশ ডলারে ধারণ করবে। উল্লেখ্য, ডলার শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মুদ্রা নয়, এটি পাঁচটি মার্কিন অঞ্চল এবং সাতটি সার্বভৌম দেশের সরকারি মুদ্রাও বটে। উপরন্তু এটি অন্য অনেক দেশেরই আধা-সরকারি মুদ্রা যা সাধারণত স্থানীয় মুদ্রা ছাড়াও ডলার গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ- ২০২১ সালে, সারা বিশ্বে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ সম্মিলিতভাবে ডলারকে তাদের বিনিময়ের সরকারি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করেছিল, যা ছিল ২০ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

এ ছাড়াও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন বিদেশী দেশগুলো অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলা করার জন্য তাদের দেশীয় মুদ্রাকে ডলারে রূপান্তর করে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ক্রমেই একীভ‚ত ও পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। একজন অর্থনীতিবিদ যুক্তি দেবেন যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং লেনদেনগুলো আরো দক্ষতার সাথে পরিচালিত করার জন্য এবং ডলারের একচেটিয়া কর্তৃত্ব কাটানোর জন্য একাধিক কার্যকর এবং স্থিতিশীল রিজার্ভ মুদ্রা থাকতে হবে। যাই হোক, এটি সম্ভব হবে যদি কোনো রিজার্ভ মুদ্রা চারটি পূর্বশর্তের লিটমাস পরীক্ষা পাস করে।
উপরের আলোচনা থেকে মনে হয়, ডলারকে বিতাড়িত করা এত সহজ না হলেও বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই করতে চায়; ইদানীং তার আলামতও দেখা যাচ্ছে। বিশেষ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিকল্প ব্যবস্থায় চীন ও ভারত মস্কোর সাথে বাণিজ্য সচল রাখে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ জ্বালানি বিক্রির ক্ষেত্রে ডলার-নির্ভরতা কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দেয়। আরো অনেক দেশ ডলারের পরিবর্তে অন্য দেশের মুদ্রা রিজার্ভ আকারে রাখছে। এসব থেকে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে রিজার্ভের প্রভাব হয়তো আরো কমে আসবে। কতটা কমে আসবে তা এখন স্পষ্ট না হলেও অনেকটাই কমে আসছে তা সত্য। ২০০১ সালে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের অংশ ছিল ৭৩ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২২ সালে তা ছিল ৪৭ শতাংশ। বৈশ্বিক লেনদেনেও ডলারের ভ‚মিকা দ্রæত কমে আসছে। ফলে ২০২৪ সালের শেষের দিকে ডলারের অংশ ৩০ শতাংশে নেমে আসা অবিশ্বাস্য নয়।
উল্লেখ্য, মার্কিন ডলারের সবচেয়ে বেশি পতন ঘটে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ফলে রাশিয়ান রিজার্ভের ৩০০ বিলিয়ন ডলার পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ফ্রিজ করার মধ্য দিয়ে। তখন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ বিদেশে থাকা তাদের নিজস্ব ডলার রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। রাশিয়া ও চীনের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের ৭০ শতাংশ হয় রুবল, না হয় ইউয়ানে। রাশিয়া ও ভারত রুপিতে তেলের ব্যবসায় করছে। ক্রস বর্ডার লেনদেনের জন্য সুইফটের বিকল্প হিসেবে সিআইপিএস সিস্টেমে নিবন্ধন করেছে। এই সিআইপিএস পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক মেসেজিং সিস্টেম সুইফটের চীনা বিকল্প। দেখা যাচ্ছে, সুইফটের বদলে চীনের বিকল্প ব্যবস্থার দিকে বিশ্বের অনেক দেশ ঝুঁকছে। আগে ইরান বা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলো এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখন ব্রাজিলের মতো দেশের অংশগ্রহণের তাৎপর্য কম নয়।

চলমান চীনের নেতৃত্বে ডিডিসি ব্রিকস ব্যানারে নতুন গতি অর্জন করছে বলে মনে হচ্ছে। চীন ও ফ্রান্সের পেট্রোলিয়াম কোম্পানি সাংহাই পেট্রোলিয়াম ও ন্যাচারাল গ্যাস রফতানির বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারতের সাথে তাদের রুপি ও টাকায় বাণিজ্য নিষ্পত্তির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ তারা মনে করে, এ ব্যবস্থাটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমিয়ে দেবে এবং বাণিজ্যকে উৎসাহিত করবে। চীন ও ব্রাজিল তাদের সাম্প্রতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মার্কিন ডলারকে বাইপাস করে সরাসরি স্থানীয় মুদ্রায় পারস্পরিক বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়েছে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সদস্যদের বৈঠকে কীভাবে ডলার, ইউরো, ইয়েন ও পাউন্ড স্টার্লিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের ওপর নির্ভরতা কমানো যায় এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য দেশীয় মুদ্রা আরো বেশি ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত ও মালয়েশিয়া তাদের পারস্পরিক ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য রুপি ব্যবহার করতে সম্মত হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া ও বাংলাদেশের চুক্তি হয়েছে মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে। প্রথম ৩০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ ইউয়ানে হবে; তবে রাশিয়া পরেরটি রুবেলে পরিশোধ করার চেষ্টা করবে। রাশিয়া ও বলিভিয়ার বাণিজ্য চুক্তি এখন বলিভিয়ার মুদ্রায় হবে। লক্ষ করার মতো যে, ডলারের বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে ব্রিকসের অনেক দেশ এখন জড়িত। এই ব্রিকসের সাথে যোগ দিতে চাচ্ছে আরো অন্তত ১৯টি দেশ। ব্রিকস এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে জি-সেভেনের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুসারে, ব্রিকসের পাঁচটি বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ৩২.৫ শতাংশ অবদান রাখবে। আর সেখানে জি-সেভেনের হার ২৯.৯ শতাংশ। সৌদি আরব, ইরান ও মিসরের ব্রিকস রথের ওপর চড়ার প্রস্তুতির কারণে প্রচারটি আরো উৎসাহিত হয়েছে এবং গুরুত্ব পেয়েছে। হাইপার ইনফ্লেশনের সাথে লড়াইরত আরো দু’টি দুর্বল অর্থনীতি, তুরস্ক ও আর্জেন্টিনাও এই মিশনে যোগদানের জন্য সারিবদ্ধ হয়েছে। এসব দেশ যোগ দেয়ার সাথে সাথে বিশ্ব অর্থনীতি এক নতুন মেরুকরণে রূপ নেবে।

পরিশেষে বলতে হয়, ডলারের শোষণ ও শাসন থেকে মুক্তির জন্য অতীতে বিক্ষিপ্তভাবে ইরাক, লিবিয়াসহ বেশ কিছু দেশ চেষ্টা করেছিল যার পরিণতিতে ওই দেশের অবস্থা বিশ্ব দেখেছে। তবে এবারের প্রচেষ্টা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জোরালো ও অর্গানাইজড। গ্লোবাল সাউথের মূল খেলোয়াড়রা পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে সক্ষম বহুমুখী প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিচ্ছে যার মধ্যে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়ার অনেক দেশ রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর কাছে পণ্য রয়েছে। অন্য দিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জি-সেভেন নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ। জি-সেভেন পণ্য তৈরি করতে পারে না, তবে ব্রিকস মুদ্রা তৈরি করতে পারে। এই মুদ্রার সাথে সংযুক্ত রয়েছে স্বর্ণ, তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদ। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো তেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা ওপেক প্লাসকে হুমকি দিয়েছিল যে, তারা যেন রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু তাদের কথা কেউ শুনেনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু তেল উৎপাদনকারী দেশ ডলার মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের কারণেই ডলার পেট্রোডলার নাম ধারণ করেছে, যার কারণেই ডলার এতটা শক্তিশালী। ফলে ডলার যদি পেট্রোডলারের মর্যাদা হারায় তাহলে একটা কিছু হতেও পারে।

তবে ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইন (ডিডিসি) আন্দোলনে সফলতার জন্য ডলারের একটি পরিষ্কার বিকল্প থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো- বিকল্পটি কী? যদি ডলারের বিকল্প হয় রুবল অথবা ইউয়ান অথবা রুপি তাহলে কালের বিবর্তনে ডলারের মতো এই মুদ্রাগুলো বিশ্বকে শোষণ করতে থাকবে। অন্য বিকল্প হতে পারে- যার যার মুদ্রা সে সে ব্যবহার করবে, কোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রা থাকবে না; দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে লেনদেন হবে। এই বিকল্পটি বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে খুবই বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে অবাস্তব। ক্রিপ্টোকারেন্সিও একটি বিকল্প হতে পারে যেখানে মুদ্রার ওপর কোনো দেশের একক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তবে আমার মতে, সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে ফিয়াট কারেন্সির পরিবর্তে কমোডিটি কারেন্সির প্রচলন আবার শুরু করা। যেটিই হোক না কেন, ডলারের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে চায় বিশ্ব; চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এডওয়ার্ড হিকসনের নৈতিক গানের একটি কলি মনে করা যেতে পারে, ‘প্রথমে আপনি সফল না হলে, চেষ্টা করুন, আবার চেষ্টা করুন।’

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement