২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজনীতির হম্বিতম্বি যুদ্ধক্ষেত্রের বাকযুদ্ধ

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাজনীতির ময়দানে সব কিছু জায়েজ আর যুদ্ধের ময়দানে সব কিছু হালাল এমনতর প্রবাদবাক্য আমরা কমবেশি সবাই জানি। রাজনীতি এবং যুদ্ধ ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা মহাকালে সুনির্দিষ্ট করে লেখা না থাকলেও আমরা ইতিহাস-শিল্প-সাহিত্য থেকে জানতে পারি যে, আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ ছোট-বড় বহু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে বড় বড় রাজা-মহারাজারা যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তার ফলে আমরা পৃথিবীর আদি সম্রাটদের যে তালিকা পাই তাদের মধ্যে সম্রাট সারগন, শি হুয়ান টি, সাইরাস, দারায়ুস প্রমুখের নাম জানতে পারি। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার এবং কনস্টানটাইনের নামও সম্রাট হিসেবে ইতিহাসে লিখিত রয়েছে।

রাজনীতি ও যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে যে দিন থেকে মানুষ রাজ্য-রাজা রাজধানী এবং সিংহাসন লাভের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির ময়দান এবং যুদ্ধের ময়দানে আদিকাল থেকে আজ অবধি যা কিছু ঘটে চলেছে তা বলতে গেলে কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই চলে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু পোশাকি পরিবর্তন হয়েছে বটে কিন্তু নৈতিক কলাকৌশল, বাগাড়ম্বর, প্রচার প্রপাগান্ডা ইত্যাদি আদি-অকৃত্রিম এবং অবিকৃত অবস্থাতেই রয়েছে। আর এ কারণেই রাজনীতির কথা এলে আড়াই হাজার বছর আগের সক্রেটিস-এরিস্টটল এবং প্লেটোর নাম যেভাবে আসে একইভাবে যুদ্ধ বলতে সাইরাস-সিজার-হানিবল-আলেকজান্ডারের নামই মানুষ বারবার উচ্চারণ করে। আর যুদ্ধকৌশলের মাস্টার পিস হিসেবে যুদ্ধগুরু যানঝু লিখিত আর্ট অব ওয়ারই সমরবিদদের কাছে গত আড়াই হাজার বছর ধরে বাইবেল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

রাজনীতির ময়দানে মিথ্যাচার-হম্বিতম্বি-হুমকি-ধমকি এবং প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত নাজেহাল কিংবা বেইজ্জতি করার মহাকালের কৌশলের আদি ও অকৃত্রিম ধারার সাথে হাল আমলের প্রযুক্তিগুলো যোগ হয়েছে। অর্থাৎ আগে মাইক ছিল না- এখন আছে, সামাজিকমাধ্যম পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, সিনেমা ইত্যাদির ব্যবহারও আদিকালে ছিল না। আর বর্তমানকালের মতো এত জটিল-কুটিল স্বভাবের বিশাল জনগোষ্ঠীও প্রাচীন জমানায় ছিল না। তবে রাজনীতির কথাবার্তা-কৌশল ইত্যাদির ব্যবহার আদিকালে ও বর্তমানকালে হুবহু একই অবস্থায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজনীতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়াদি মুহূর্তের মধ্যে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তাতে আদি ও অকৃত্রিম রাজনীতির বাতচিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়নি।

রাজনীতির মতো যুদ্ধের যে বিবর্তন হয়েছে সেখানে হাতাহাতি লড়াই থেকে প্রথমে লাঠি-পাথর ইত্যাদির ব্যবহার- তারপর ধাতব অস্ত্র থেকে বারুদ এবং পরবর্তীকালে পরমাণুর ব্যবহার যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, যুদ্ধ মানেই সম্পদ ও প্রাণ হরণের প্রতিযোগিতা কিংবা যুদ্ধ মানেই এক পক্ষের জয় আর অপর পক্ষের পরাজয়ের চিরায়ত নির্মম বাস্তবতার সাথে হাজার হাজার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যোগ করেও কোনো গুণগত পরিবর্তন সাধন করা যায়নি।

যুদ্ধ ও রাজনীতি নিয়ে আজকের শিরোনাম ও লম্বা ভূমিকা দেয়ার প্রয়োজন হলো হাল আমলের একটি আলোচিত ও সমালোচিত রাজনৈতিক বক্তৃতার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজনে। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সংক্ষেপে কাহিনীটি বলে নেই। রাজশাহী অঞ্চলের একজন স্থানীয় বিএনপি নেতা একটি রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। তিনি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পতন কামনা করেন এবং তার রাজনীতির বর্তমান ধারার পরিসমাপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে কবর শব্দটি উচ্চারণ করেন।

উল্লিখিত বক্তৃতাটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে এবং শাসক দল আওয়ামী লীগের আঁতে ঘা লাগে। ফলে তারা নিদারুণ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে এবং আলোচিত বক্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। শেষ খবর হলো, বক্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং তিনি জেলে আছেন। রাজশাহী অঞ্চলের বিএনপির যে নেতা সম্পর্কে এতক্ষণ বললাম তার নাম আবু সাইদ ওরফে চাঁদ। তিনি রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক। জনাব চাঁদ যে বিপদে পড়েছেন ঠিক একই বিপদে পড়েছিলেন বিএনপির জাতীয় নেতা শামসুজ্জামান দুদু এবং মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তবে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। কারণ আওয়ামী ক্রোধ তাদের শেষ পর্যন্ত জেলে ঢোকায়নি।

আজকের আলোচনায় আমি জনাব চাঁদের রাজনৈতিক বক্তব্য কিংবা হুমকি নিয়ে ব্যক্তিগত কোনো মন্তব্য করব না। তবে তিনি যা বলেছেন সেসব কথা রাজনীতির হাজার বছরের ইতিহাসে কত শত কোটিবার যে উচ্চারিত হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এমনকি আবহমান বাংলার ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে রাজনৈতিক বাতচিতের বহু ঘটনা। যেখানে গণতন্ত্র-সুশাসন-ন্যায়বিচার যত প্রবল সেখানে শাসকের সহনশীলতা তত বেশি থাকে। আর শাসকদের অবৈধ ক্ষমতা লাভ নানান কুকর্ম এবং জনরোষ যত বেশি হয় ততই ক্ষমতার কেন্দ্রে অস্থিরতা অবিশ্বাস সন্দেহ আতঙ্ক ইত্যাদি প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে।

আমাদের দেশের ষাটের দশক-সত্তরের দশক-আশির দশক থেকে আজ অবদি বহু রাজনৈতিক হম্বিতম্বি বলে আসছে। আইয়ুব-ইয়াহিয়া-টিক্কা খানদের নিয়ে কার্টুন আঁকা অথবা তাদেরকে গালাগাল খিস্তিখেউরের জন্য যদি কাউকে পাকড়াও করা হতো তবে কিংবদন্তি চিত্রশিল্প পটুয়া কামরুল হাসানের নির্ঘাত ফাঁসি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হতো। বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ৭ মার্চের ভাষণের সেই তোলপাড় করা উক্তি- তোমাদেরকে ভাতে মারব- পানিতে মারব শব্দমালা পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরাচাররা কিভাবে হজম করেছিল তা হাল আমলের আওয়ামী লীগ নেতাদের ভেবে দেখা উচিত।

পাকিস্তান জমানা বাদ দিয়ে আমরা যদি স্বাধীন বাংলাদেশের বাকশালী আমলের কথা চিন্তা করি তবে মতিয়া চৌধুরীর সেই বিখ্যাত উক্তি চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানানো এবং হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর বাতচিত কিন্তু বাকশালীরা হজম করেছিল। এরশাদ জমানার রাজপথ এবং তার শাসনামলে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে এবং তা তিনি যত দিন পর্যন্ত ধৈর্যসহকারে মোকাবেলা করেছেন ঠিক তত দিন পর্যন্ত তার ক্ষমতার মসনদ নিরাপদ ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি অধৈর্য হয়ে পড়লেন অমনি তার পতনের ঘণ্টা বাজা শুরু হয়ে যায়। তিনি যায়যায়দিন বন্ধ করলেন। সম্পাদক শফিক রেহমান প্রাণভয়ে দেশত্যাগ করলেন। তার বিরুদ্ধে কলাম লেখার জন্য সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করলেন। বিবিসির সংবাদদাতা প্রয়াত আতাউস সামাদ, সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীসহ অনেককেই জেলে পুরলেন। অন্য দিকে তার বিরুদ্ধে কবিতা লেখার জন্য কবিকে জেলে ঢুকিয়ে ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’ কবিতাটিকে বাংলাসাহিত্যে অমরত্বদানের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলেন।

এরশাদের পতন হয়েছে বহু দিন আগে। তারপর বিএনপি এসেছে, আওয়ামী লীগ এসেছে, তারপর বিএনপি। মাঝে কিছু দিন ১/১১-এর কুখ্যাত কুশীলবদের দলের পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভ আজকের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। রাজনীতি ব্যাকরণ পাল্টানোর বহু চেষ্টা সত্ত্বেও মানুষের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি এবং প্রতিক্রিয়া মহাকালের মতোই প্রবহমান রয়েছে। কেউ চেষ্টা করলেও রাজনীতির চিরায়ত প্রবাহকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে পারবে না। রাজনীতির হম্বিতম্বি-বাতচিত কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রের বাকযুদ্ধ অথবা যুদ্ধ কৌশলের আদি ও আসল রূপ প্রাকৃতিক নিয়মেই চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement