২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নিষেধাজ্ঞা কি লাভজনক?

-

জাতির ভবিষ্যৎ এক তীব্র অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। দেশ কোন পথে যাবে, তা নিয়ে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। চীনের উত্থান, ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক রাজনীতিতে নানামুখী মেরুকরণ ঘটিয়েছে। মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রগুলো তাদের সম্পর্কের ভারসাম্য, প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী তাদের নতুন কেবলা নির্ধারণ করবে। এই অস্থির সময়ে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার শত্রু মিত্র নির্ধারণে সাহস রাখতে পারে। বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন ভোটারদের সাথে এক ধরনের ফাঁকিবাজি করেছে সরকার। মোট কথা, অবাধ নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়নি। এই কারণে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় ভাগ্যনির্ধারক দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নির্ধারণে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার রয়েছে বিপদের মধ্যে। এর আগে জঙ্গিবাদ দমনের নামে আমেরিকান নীতির সুযোগ পুরোদমে সরকার কাজে লাগিয়েছিল। বিরোধীদের নির্মূলে জঙ্গি কার্ড ব্যবহার সর্বোচ্চ সফলতা দেখিয়েছে। সেই কৌশল এখন পুরো অচল হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগর অঞ্চল নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা এই সরকারের জন্য পরিস্থিতি আরো জটিল করেছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণে দেশগুলো নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়। জাতীয় স্বার্থ বলতে দেশের ১৭ কোটি মানুষের ভাগ্যের বিষয়টি বোঝানো হবে না বর্তমান সরকারের ভাগ্য বোঝানো হবে, তা নিয়ে তৈরি হচ্ছে অস্পষ্টতা। বাংলাদেশে জনগণ ও সরকারের ভাগ্য দুটো যেন দু’দিকে বেঁকে গেছে। বর্তমান সরকারের ওপর গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন ও মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য তাগিদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সারা বিশ্বের গণতন্ত্র পছন্দ দেশগুলো। এ দেশগুলোর সাথে আমাদের অর্থনৈতিক ও আদর্শিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। অন্য দিকে রয়েছে চীন রাশিয়া ও ভারতকেন্দ্রিক মেরুকরণ। এ দেশগুলোর সাথে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক একপাক্ষিক। অর্থাৎ দেশগুলো আমাদের থেকে যে মাত্রায় উপকৃত হয় তার খুব সামান্য মাত্রায় আমরা দেশগুলো থেকে উপকার পেয়ে থাকি। প্রথমোক্ত দেশগুলো নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে সরকারের জবাবদিহিতা চায়। পরের দেশগুলো জবাবদিহিতা চায় না বরং বর্তমান সরকারকেই ক্ষমতায় চায়। জনগণের ইচ্ছা অভিপ্রায় তাদের কাছে মূল্যহীন।

আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব এর মধ্যে এ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার ও মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় অবস্থান জানান দিয়েছে। আমেরিকা ইতোমধ্যে আমাদের একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২০২১ সালে তাদের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমেছে।

নির্বাচনের বছর ২০১৮ সালে ৯৮ মানুষ গুম হয়ে যায়। তার আগের দুই বছরে এর সংখ্যা ৯০ এর বেশি ছিল। এদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন ফিরে এসেছে, কিছু সংখ্যকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। বাকিরা আর ফিরে আসেনি। জাতিসঙ্ঘ নিখোঁজ থাকা লোকদের ৭৬ জনের একটি তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। এর মধ্যে মাত্র ১০ জনের খোঁজ মিলেছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে গুম ও খুনের খুব বেশি অভিযোগ পাওয়া না গেলেও এটা একেবারে থেমে যায়নি। তবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের মতো একই হারে ২০২১ সালের পরও মানুষ হারিয়ে যেতে থাকলে বিগত দুই বছরে কমপক্ষে আরো ২০০ মানুষ নিখোঁজ হয়ে যেত। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপকৃত নিষেধাজ্ঞা এ কারণে আশীর্বাদ। একইভাবে পশ্চিমারা যখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে সেটাও বঞ্চিত নাগরিকরা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে। নিজেদের পছন্দের প্রার্থী নিজেরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার অধিকার কে না চায়?

ভোটের আয়োজন নিয়ে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য যেভাবে খেলছে বিষয়টা অপরাধ বিবেচনায় না নিলে ভবিষ্যতে গণতন্ত্র বিলুপ্ত হতে পারে, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব থেকে। পশ্চিমাদের ফেরি করা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে বাংলাদেশে এর একটা বিহিত হওয়া উচিত। ভোট ব্যবস্থা নিয়ে জালিয়াতি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী অনেক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাংলাদেশেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এমন একটি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। দৈনিক কালবেলা পত্রিকা এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা নিশ্চিতভাবে বলছে, এমন নিষেধাজ্ঞা আসছে। এ দিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যারা নিষেধাজ্ঞা দেয় তাদের কাছ থেকে কিছু কেনা হবে না।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পুরোপুরি আনপ্রেডিকটেবল বলতে হবে। নিষেধাজ্ঞা আমাদের এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্য কেউ দেয়নি, শুধু দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেখা গেল, তার কয়েক দিন পরেই সরকার দেশটি থেকে চিনি কেনার বিষয় চূড়ান্ত করেছে। এরপর কেনা হচ্ছে সয়াবিন তেল। তুলা কেনার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। আমাদের ধরে নিতে হবে, সরকার যে কথা বলবে, করবে তার বিপরীত। তবে কোন দেশ কার্যত আমাদের কতটা বন্ধু তার আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করছে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের বাণিজ্যের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি দেশটি আমাদের লাইফলাইন পোশাক রফতানির পর প্রবাসী আয় প্রেরণের তালিকার এক নাম্বারে উঠে এসেছে।

আমদানি, রফতানি ও বিনিয়োগের তথ্য বলছে, আমাদের একমাত্র আন্তরিক বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। করোনার পর ইউক্রেন হামলার মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতির যে দুরবস্থা চলছে তার মধ্যে আমাদের রফতানির ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে ও ৪৫ শতাংশ ইউরোপে হয়েছে। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪০১ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল ব্যবধানে প্রথম অবস্থানে ও যুক্তরাজ্য ২৭১ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রবাসী আয়ে সৌদি আরব প্রথম ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। গত দুই অর্থবছরে আমিরাতকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র উঠে এসেছে দ্বিতীয় অবস্থানে। চলতি অর্থবছরে বিগত দশ মাসে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে হটিয়ে প্রবাসী আয় প্রেরণে এক নম্বর স্থানে উঠে এসেছে। অন্য দিকে চীন ও ভারত বাংলাদেশকে তাদের পণ্যের বাজার হিসেবে একচেটিয়া ব্যবহার করছে। গত অর্থবছরে দেশ দুটি যথাক্রমে এক হাজার ৯৩৫ কোটি ও এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে আমাদের দেশে। দেশগুলো থেকে আমরা যে বিনিয়োগ পাই তা নিয়ে নানান বিতর্ক রয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতিতে সয়লাব করে দিয়েছে। কোনো ধরনের বাছবিচার তারা করে না। বিনিয়োগে অনিয়ম করার জন্য তাদের এক ধরনের প্রণোদনা থাকে। অন্য দিকে ভারতের বিনিয়োগের প্রধান টার্গেট তাদের কানেকটিভিটি রেল ও নৌ যোগাযোগের জন্য। এগুলোর মাল মসলা আবার সব নিজেরাই জোগান দেয়। দেশ দুটো থেকে আমাদের কোনো ধরনের প্রবাসী আয় নেই বললেই চলে। ভারতের বরং অন্যতম প্রধান প্রবাসী আয়ের উৎস বাংলাদেশে। বাংলাদেশী তরুণদের মধ্যে একটি বঞ্চনা রয়েছে যে, ভারতের হাজার হাজার মানুষ এ দেশে চাকরি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। অন্য দিকে, দেশীয় যুবকরা বেকার। রাশিয়াও একচেটিয়া সুযোগ নিতে চীন ভারতের সাথে যুক্ত হলো কয়েকগুণ দামে একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে দেয়ার নাম করে।

পশ্চিমাদের সাথে আমাদের আদর্শিক মিলটা গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে। সে কারণে ওইসব দেশে চলে যেতে চায় এ দেশের তরুণরা। সেখানে পড়াশোনা, রুজি-রোজগারের জন্য বহু মানুষ যাচ্ছে। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এক শ্রেণীর তরুণ গহিন জঙ্গল ও উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাচ্ছে। আমাদের দেশের অবস্থাসম্পন্ন মানুষও এসব দেশে তাদের আবাস গড়ে তুলেছে। এমনকি যারা গণতন্ত্রের শত্রু বিবেচিত হচ্ছে তারাও ওইসব দেশে গড়ে তুলছে বেগমপাড়া। এই অবস্থায় সরকার কাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে? পুরো দেশ যখন একদিকে ঝুলে আছে, সরকার যদি তার বিপরীত দিকে রওনা দেয় সেটা এক অসম্ভব যাত্রা হবে। এই যাত্রায় দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটার আশঙ্কাই বেশি।
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement