২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইমরানের গ্রেফতার ও রাজনীতি গ্রাসের নতুন খাত

ইমরান খান - ফাইল ছবি

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রধান সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানকে সম্প্রতি খুবই বাজে কায়দায় গ্রেফতার করে পুলিশ। ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হাজির হয়ে জামিন চাইতে গিয়েছিলেন ইমরান খান। কিন্তু পুলিশ বা শরিফ সরকার তাকে কোর্টে পৌঁছাতে দেয়নি। তার আগেই কোর্ট-ভবনের বারান্দা থেকে তাকে আটক করে ।

ইমরান খান সেনাবাহিনীর কড়া সমালোচনা করার পরদিনই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ থেকে পরিষ্কার যে, ইমরানকে গ্রেফতারে সেনাবাহিনীর গোপন ভূমিকা রয়েছে। অথচ দেশটির অর্থনৈতিক সঙ্কট এতটাই খারাপ যে, তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রার আয় বছরে ২৫ বিলিয়ন আর তাদের আমদানি ব্যয় ৮০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ননপ্রোডাকটিভ খাতের ব্যয় অনেক বেশি। তার মধ্যে সেনাবাহিনীই প্রধান। পাঁচ থেকে সাত লাখ সদস্যের সেনাবাহিনী ও অন্যবাহিনী পুষতে সরকারের বাজেটের বেশির ভাগই ব্যয় হয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের টুঁটি সেনাদেরই হাতে। যদি কোনো রাজনৈতিক সরকার সেনাবাহিনীর পেছনে বিপুল ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে বা তাদের কাজের বিষয়ে প্রশ্ন করে, তাহলে ইমরান খানের মতোই তাদের পরিণতি ঘটে। সরকারগুলো তাই সেনাবাহিনীর দাবি আপসে পূরণ করে।

এখন ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরও পিটিআইয়ের সমর্থকদের সহিংস প্রতিবাদের ফলে তার মুখ চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা করছে সেনাবাহিনী। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বান্দিয়ালকে ‘পিটিআই এজেন্ট’ হিসেবে চিত্রিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অভিযোগ দায়েরে নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লিতে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। তার মানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দখল করার তালে আছে শরিফ সরকার। এই লক্ষণ যেকোনো দেশের আইনি স্বাধীনতা ধ্বংসের পাঁয়তারা তা অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগ শক্তিশালী না থাকলে কর্তৃত্ববাদ কেবল মাথাচাড়াই দেয় না, প্রতিপক্ষের শক্তি ও সাহসকে, সাংবিধানিক ক্ষমতাকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। পাকিস্তানে সেটিই ঘটতে যাচ্ছে বলে অনুমান বা ধারণা করা যায়। পার্লামেন্ট থেকে যখন বিচার বিভাগের প্রতি এমন ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার তৈরির আয়োজন চলে, তখন এই ভাবনাই সত্য হয়ে উঠতে দেখা যাবে বলে মনে করি।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে অন্যায় করে আসছে ১৯৫৮ সাল থেকে তারই যেন ব্যর্থতার রূপটি আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। কিন্তু তাতেও শিক্ষা হয়নি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের। ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনী যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল, তারপর তাদের ক্ষমতার বিষদাঁত কেন রাজনীতিকরা ভাঙেননি, এই প্রশ্ন এখন প্রধান আলোচ্য হয়ে উঠেছে। অস্ত্রের জোরেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিজেদের আকার যেমন বড় করেছে, তেমনি দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক কালচারকে গুঁড়ো করে দিয়ে রাজনীতিকদের বিভক্ত করে মজা লুটছে। অথচ ওই দেশটির উন্নয়নের একটি সম্ভাবনা ছিল। তা আজ প্রায় ধূলিসাৎ।

পাকিস্তানের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। দেশটি অনেক দিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ‘বেইল-আউট ঋণ’ চাইলেও সংস্থাটি এমন অনেক কঠোর শর্ত আরোপ করতে চাইছে, যেগুলো পূরণের ক্ষমতা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নেই।

এমনকি পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন ও সৌদি আরবও এখন আর দেশটির দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। চীনা অর্থে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কিস্তির টাকা বহু দিন ধরে পরিশোধ না করায় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চীন।

যার কারণে গোটা পাকিস্তান ভয়াবহ লোডশেডিংসহ প্রায়ই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। নাটকীয়ভাবে দাম বেড়ে এক ডলার এখন ২৭৭ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এখন এক কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি এবং এক কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে।

সাড়ে পাঁচ লাখের সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক যুক্তিতে কোনোভাবেই এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয় পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু জন্মশত্রু ভারতের সাথে যুদ্ধের জন্য এত বড় সেনাবাহিনী পুষছে তারা। ভারতের সাথে নানা সময়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতলগত হয়ে গিয়েছিল।

পূর্বপাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭১-২০২৩ পর্বেও পাকিস্তানের শাসকের ভ‚মিকা থেকে সামরিক বাহিনীকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। কিছু দিন পরপর সামরিক একনায়করা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করছে। কখনো সিভিলিয়ান শাসকদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিচ্ছে তারা। বর্তমান পর্বে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা থেকে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কলকাঠিই আমরা দেখি।

চীন ওই দেশে বিনিয়োগ করেছে লাভের আশায়, রাজনৈতিক প্রেমের টানে নয়। আবার ভারতের সাথে পাকিস্তানের সামরিক বিরোধের সূত্রেও ওই বিনিয়োগ মনে হলেও চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে রয়েছে তাদের টাকা খাটানোর বিজনেস। সেটি অপ্রকাশ্যের চুক্তির বলেই যে হয় তার অভিজ্ঞতা তো আমাদেরও আছে। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা এতটাই লাগাম ছাড়া হয়েছিল যে, রাজাপাকসেদের পারিবারিক দেশে পরিণত হয়েছিল বিষয়টি। রাজাপাকসে পরিবারের পতন হয়েছে জনগণের আন্দোলনের মুখে কিন্তু রয়ে গেছে চীনের বিনিয়োগ। সেই ঋণ কিভাবে পরিশোধ করবে দেশটি তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের নানা জল্পনা রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত একটি দেশ পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে অনেক বছর সময় লাগে। এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। সবাই আশঙ্কা করছে পাকিস্তানও সে দিকেই এগোচ্ছে।

শাহবাজ শরিফের সরকারের দিব্যদৃষ্টি কি সেনাবাহিনীর নগ্ন নিষ্ঠুরতা দেখছে না? নাকি তারাও রাজনীতিকদের কোমর ভেঙে দিতেই সামরিক বাহিনীর হয়ে কাজ করছে? দেশের জনগণ নয়, রাজনৈতিক শাহবাজ সরকারের লক্ষ্য ক্ষমতার মসনদ। তার ভাই নওয়াজ শরিফও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন লুটপাট আর দুর্নীতির সাগর সৃষ্টি করে। শাহবাজও সেই পথেরই পথিক। তারা পারিবারিক ডাইনেস্টির স্বপ্নে বিভোর। এর আগেও আমরা সেটি দেখেছি জুলফিকার আলী ভুট্টোর সময়। তার কন্যা বেনজির ভুট্টোর সময়ও দেখা গেছে। বেনজির হত্যার পর তার স্বামী ব্যবসায়ী আসিফ আলী জারদারির দুর্নীতিও ছিল আরেক আলোচিত বিষয়। এখন শাহবাজ শরিফ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কোয়ালিশনের প্রধান অংশীজন পিপিপির বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি কতটা কী করবেন, তা আমাদের জানা আছে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, পাকিস্তানি রাজনীতিকদের বেশির ভাগই ধনী ভ‚স্বামী শ্রেণীর। পাকিস্তানি রাজনীতিতে গরিবের রাজনৈতিক শক্তি নেই বললেই চলে। ইমরান খান হচ্ছেন ওই রাজনৈতিক লুটেরা বলয়ের বাইরের মানুষ। মূলত শোষিত-বঞ্চিত গরিব মানুষের প্রতিনিধি। তিনি চাইছিলেন, রাজনীতিকে সেনাদের কাছে থেকে সরিয়ে এনে পাবলিকের করে তুলতে। যদিও অনেকেই মনে করেন, সামরিক বাহিনী প্রচ্ছন্নভাবে তার পেছনেও ছিল। কিন্তু তিনি তো আসলে জনগণের রাজনৈতিক সহচর, তাদেরই প্রতিনিধি। তিনি তাই সেনাদের কর্তৃত্ব মানতে চাননি। সে কারণেই পার্লামেন্টের ছোট দলগুলোর সাথে যে কোয়ালিশন করে সরকার গড়েছিলেন ইমরান তারাই অনাস্থার জালে আটকে ফেলে ইমরানকে। এটি খুবই পুরোনো খেলা বটে কিন্তু লোভী ও রাজনীতিকদের আটকানো যায়নি। তারা শাহবাজের অর্থ খেয়ে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেয়। শাহবাজ ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হয়েছে তা তো আগেই বলা হয়েছে।

মোটাদাগে আমরা এগিয়ে থাকলেও গত ১৪-১৫ বছর ধরে যেভাবে ক্ষমতার পালাবদলহীন এমন একটি সরকার ক্ষমতায় আছে, যারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মতোই অসততার সব উপাদান ধারণ করে আছে। প্রশাসনের লোকেরা সরকারের নিজস্ব কর্মকর্তায় পরিণত হয়েছে। জনগণের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ভোট ব্যবস্থা হরণ করা হয়েছে। তুলনামূলক বিচারে আমরা এগিয়ে আছি সত্য কিন্তু সেই তুলনা কি পাকিস্তানের মতো একটি দেশের সাথে হবে নাকি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দেশের সাথে করব আমরা। পাকিস্তানিরা ডুবে যাচ্ছে বলে আমরা উঠে যাচ্ছি না...

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদের সময়কাল যে সামরিকীকরণের ধকল গেছে, এক দলীয় বাকশাল স্বৈরশাসন হটিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও রাজনীতিকে বহুদলীয় করার একটি চেষ্টা ছিল। জিয়া সীমিত করে হলেও একদলকে বহুদলের রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। এরশাদ সেই ধারাবাহিকতায় চললেও তিনি আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে রাজনীতিতে সন্দেহ অবিশ্বাস আর বেআইনি তৎপরতা আমদানি করেছিলেন। জিয়ার হ্যাঁ-না ভোটের পথ ধরে ব্যাপক না হলেও ভোটে কারচুপি বা রিগিং ছিল আলোচিত বিষয়। তারই সম্প্রসারিত রূপ আমরা দেখি ২০০৮-এর নির্বাচনে, ২০১৪ সালে বিনাভোটে ১৫৪টি আসন আর ২০১৮ সালের নির্বাচন তো আগের রাতেই লুটে নিয়ে যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ আর প্রশাসনিক কর্তারা।

এই যে মনোলগ, রাজনৈতিক নাট্যের চূড়ায় আছে সামরিক কর্তৃত্বেরই নেশা, যা পাকিস্তানি শাসনামল থেকেই আমরা অর্জন করেছি। এই অর্জন যে কতটা ক্ষতিকর, ধনবাদী গণতন্ত্রও সে রকম ক্ষতি করতে পারে না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নিঃশেষ করে সামরিক বাহিনী আবারো পাঁয়তারা কষছে ক্ষমতার মগডালে সরাসরি বসে যেতে। সে কারণেই প্রধান বিচারপতিকে সাইজে আনার চেষ্টা করছেন পার্লামেন্ট সদস্যরা। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না, ক্ষমতার এই উদগ্র নেশা কেটে গেলে তাদেরও আশ্রয়স্থল হতে পারে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট। বিচার বিভাগকে শাসকদলের অধীনস্থ করার মানে হচ্ছে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা।


আরো সংবাদ



premium cement