২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটা কিছু হচ্ছে তাহলে

লেখক ড. আবদুল লতিফ মাসুম। - ছবি : নয়া দিগন্ত

‘পাকঘরে কে? আমি কলা খাই না’-এ প্রবচনটি বহুল কথিত। শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের গত কয়েক দিনের আলাপ-প্রলাপে এর প্রমাণ মিলছে। নিজেদের অজান্তেই তারা গোপন খবর ফাঁস করে দিচ্ছেন। সরকার পরিবর্তনের আগাম বার্তা দিচ্ছেন। রাজনৈতিক বিরোধীরা ‘সরকারের পতন আসন্ন’-এরকম গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছে বটে, তবে মাঠে-ময়দানে এরকম কিছুর আলামত স্পষ্ট হয়নি। অথচ অস্পষ্টভাবে সরকারি দলের লোকেরা প্রকারান্তরে নিজেদের বারোটা বাজানোর খবর নিজেরাই দিচ্ছেন। এই এলোমেলো অগোছালো অবস্থা, পরিবর্তনের পথরেখা নির্দেশ করছেন।

আমাদের বিদেশী প্রভাবশালী বন্ধুরা পর্দার অন্তরালে কি কি দাওয়াই দিচ্ছেন তা আমাদের অজানা। তবে গুজবের হাত-পা থাকায় তার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হিসেবে সেই কবে জাতীয় সরকারের ধারণা দিয়েছিলেন আর্তমানবতার সেবক প্রয়াত ডাক্তার জাফরুল্লা চৌধুরী। মনে হয় তা এখন শাখা-প্রশাখা প্রসারিত করে একটা কিছুতে রূপ নিচ্ছে। সরকারপ্রধান হিসেবে আমাদের নোবেলবিজয়ী প্রাজ্ঞপুরুষ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রথম থেকেই জোরেশোরে শোনা যাচ্ছিল। তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি, মার্কিন মুলুকের সাথে তার খাতির-মোহাব্বত এই গুজবকে বাস্তব করে তুলছে। আর এটিও অপ্রিয় বাস্তব যে, মার্কিনিরা যে কারণে তাকে মোহাব্বত করে, সেই একই কারণে ক্ষমতাসীন সরকার তাকে একদম সহ্য করতে পারে না। তা ছাড়া অন্য আরেকটি প্রচ্ছন্ন কারণ আছে। আওয়ামী শিবির আশা করেছিল- রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার যে মহানিদর্শন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থাপন করেছেন, তাতে তিনি নোবেল পেয়ে যাবেন। চিন্তাটি অলীক নয়। তবে তাকে নোবেল না দিয়ে খুবই অন্যায় করেছে পশ্চিমারা। সে জন্য দুষ্টু লোকেরা বলে, একটি মনস্তাত্তি¡ক যুদ্ধ অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া অভিযোগ রয়েছে- আমাদের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন যাতে বিশ্বব্যাংক না করে সে জন্য তিনি লবিং করেছেন। ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে এর চেয়ে গর্হিত কাজ আর হতে পারে না। তবে সত্য প্রকাশিত; মিথ্যা অপসৃত। সত্য এই যে, প্রফেসর ইউনূস তা করেননি। তবুও অনেকবার গালমন্দ শুনতে হয়েছে তাকে। অবশেষে এই বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিটিকে হামলা-মামলা-ঝামেলা দিয়ে হেস্তনেস্ত করার প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে।

ওদিকে এ কারণেই পশ্চিমে তার কদর বেড়ে গেছে। তারা ক্রিয়ার চেয়ে প্রতিক্রিয়া বেশি ব্যক্ত করে। ‘দে ডোন্ট অ্যাক্ট বাট রিঅ্যাক্ট’। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে প্রফেসর ইউনূসের নাম ততই প্রবল হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ‘জাতীয় ঐক্য’-এর প্রতীক হিসেবে তাকে ভিন্ন অন্য কাউকে ভাবা যাচ্ছে না। তবুও প্রকাশ্যত সুস্পষ্টভাবে তার নাম প্রস্তাবিত হয়নি। সেই পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্য খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। জাতীয় সরকারের ধারণাটি সুস্পষ্ট হয়নি। তবে যেহেতু সরকার পতন বা পরিবর্তন ব্যতীত বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে যাবে না, তাই নির্বাচনকালীন সরকার অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা জাতীয় সরকারের ধারণাটি অনিবার্য হয়ে উঠছে। সম্ভবত বিদেশ থেকে এর একটি ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি ওপেন সিক্রেটই রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ‘আমি কলা খাই না’ স্টাইলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে অগণতান্ত্রিক কোনো অপশক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বা অর্পণ এ দেশের মানুষ মেনে নেবে না।’ (প্রথম আলো, ৩ মে ২০২৩) অনেকেই এই মন্তব্যকে ওয়ান-ইলেভেনের সমান্তরাল ভাবছেন।

বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের শুরুতে দেশী-বিদেশী দল ও গোষ্ঠীর সাথে আলোচনা এবং সংলাপের প্রাবাল্য লক্ষ করা যায়। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলগুলো সম্ভাব্য সমীকরণের জন্য অনেক ‘মিটিং-সিটিং-ইটিং’ করেছে। বিশেষত প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের সাথে কূটনীতিকদের শলাপরামর্শের আধিক্য লক্ষ করা যায়। এতে জাতিসঙ্ঘ ও ঢাকাস্থ প্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত হন। সঙ্কট উত্তরণ অর্থাৎ- নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। একটি পর্যায়ে ৮ মে ঢাকাস্থ জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন কুইসের সাথে বৈঠক করেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতারা। সঙ্কট সমাধানে যে অসংখ্য কূটনৈতিক সংলাপ হচ্ছে এটি ছিল এ রকম একটি। তবে এই আলোচনাটি গুরুত্ব অর্জন করে এই কারণে যে, নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত বিনিময় করা হয়। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সরকারের একক সিদ্ধান্তে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সঙ্কট নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়টি আলোচনায় আসে।

এর আগে গত ১৬ এপ্রিল মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর আব্দুল মঈন খানের বাসায় নৈশভোজে অংশ নেন বিদেশী অতিথিরা। সেখানে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এসব বৈঠকে মূলত নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় নির্বাচনটি সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সেই সাথে ক্ষমতাসীন সরকারকে কিভাবে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে বাধ্য করা যায়, সেসব বিষয়ও আলোচিত হয়। কিন্তু কোনোভাবেই সরকারকে সমাধানে আসতে তখন রাজি করানো যায়নি। তবে পশ্চিমা চাপ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপ ক্রমেই তীব্রতর হয়। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের ওপর সীমিত অবরোধ আরোপ করে। দেশী-বিদেশী ক‚টনৈতিক চাপ যত বৃদ্ধি পায়, ক্ষমতাসীন সরকার ততই নমনীয়তা দেখাতে থাকে।

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিদেশী ক‚টনৈতিক চাপে এ মাসের প্রথম দিকে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ সরকার। তারা শর্ত আরোপ করে যে, বিএনপি নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলে নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের শামিল করা যেতে পারে। তবে আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনেই সব কিছু সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয়। এই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রস্তাব দিলেন যে, সংসদে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমরা এটুকু উদারতা দেখাতে পারি। পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য যারা আছে, তাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে যে, নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে চায়, আমি নিতে রাজি আছি।’ তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই, বিএনপির কোনো প্রতিনিধি এই সংসদে নেই। আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির নির্বাচিত এমপিরা কয়েক মাস আগে পদত্যাগ করেন। বর্তমান সংসদে বিএনপির নেতৃত্বে কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই সেহেতু দলটিকে নির্বাচনকালীন সরকারে নিতে হলে সংবিধান অনুযায়ী তা কিভাবে সম্ভব সেই প্রশ্নও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘২০১৪ সালে খালেদা জিয়াকে আমি আহ্বান করেছিলাম, তারা তো আসেনি। এখন তো তারা নাইও পার্লামেন্টে। কাজেই ওদের নিয়ে চিন্তারও কিছু নেই।’

তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে কৌশল হিসেবে দেখছে। বিএনপি ব্যতীত অন্য যে সব রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদে রয়েছে তাদের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে তাদের অংশগ্রহণ কোনো কাজে আসবে না। রাজনৈতিক সমাধান চাইলে তার উপায় আছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় ১০ সদস্যের বিপরীতে একজনকে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী করা যায়। ২০ জন মন্ত্রী থাকলে দু’জন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হতে পারেন।’ তবে এ বিষয় বিএনপির প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক নয়। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার পদত্যাগ করার পর নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে।

উল্লেখ্য, বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তারা ইচ্ছে করলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বরাবরই নাকচ করে আসছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, সব কিছুই নির্ভর করে দুটো বিষয়ের ওপর। প্রথমত, বিএনপি তথা বিরোধী শক্তি যদি আন্দোলনের তীব্রতা দ্বারা ক্ষমতাসীন সরকারকে কাবু করতে পারে তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেই আওয়ামী লীগ বিদায় নেবে। কারণ ক্ষমতা এবং ক্ষমতাই তাদের লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত বৈদেশিক চাপ যদি তীব্রতর হয় তাহলে বৈদেশিক অর্থনির্ভর বাংলাদেশ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবে। এদিকে বিএনপি সমাগত দিনগুলোতে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী স্যাংশনের মোকাবিলায় আরেক প্রকার স্যাংশনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, যারা স্যাংশনস দেবে তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ কোনো কিছু কেনাকাটা করবে না। এতে সঙ্কটের বা ভয়ের কিছু নেই বলেও জানান তিনি। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ আরোপিত স্যাংশনস কতটুকু কার্যকর হতে পারে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেন, দেশের অর্থিনীতি যখন অনাথ আর পালক পিতার পর্যায় তখন প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য কতটা বাস্তব ভবিষ্যৎই তা বলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশ থেকে কেনাকাটা বন্ধ করে দেয় তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প বিপন্ন হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন ও বৈদেশিক অসহযোগিতা আমাদের জনগোষ্ঠীকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।

সরকার অভ্যন্তরীণ আন্দোলন, বৈদেশিক চাপ ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। তাই একটা কিছু করে, জাতীয় সরকারের হাতে অথবা অন্য কোনোভাবে ক্ষমতা ছেড়ে সসম্মানে পশ্চাদপসরণ করতে চায়। সে ফন্দি-ফিকির ও কৌশল আঁটছে আওয়ামী লীগ। এমতাবস্থায় দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমঝোতার মাধ্যমে প্রত্যাশিত শান্তি ও স্থিতিশীলতার দিকে দৃষ্টি দেবে- এটিই জনগণের প্রত্যাশা। জেমস ফ্রিমন ক্লার্ক বলেন, ‘A politician thinks of the next election; a statesman thinks of the next generation.’

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement