২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাছের গল্প

মাছের গল্প। - ছবি : নয়া দিগন্ত

সাম্প্রতিক পত্রিকার খবর, ‘দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের আওতায় এসেছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দুর্গম এলাকা নিঝুমদ্বীপ। পিডিপির একজন কর্মকর্তা বলেন, আপাতত সেখানে বিদ্যুতের কোনো গ্রাহক নেই। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ জেলে। বর্তমানে এখানকার মানুষ রাতে কুপি জ্বালিয়ে তাদের দৈনন্দিন কাজ করে।’

হরিণ আর ন্যাচারাল মাছের দ্বীপ বলে পরিচিত নিঝুমদ্বীপ। ডিসেম্বর-২০১৬ এক ডজন আইনজীবী হরিণ দেখতে গিয়েছিলাম নিঝুমদ্বীপ। ওঠেছিলাম নিঝুম রিসোর্টে। হরিণের সন্ধানে প্রায় প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা বের হই। জঙ্গলের আড়ালে আবডালে ওঁৎপেতে বসে থাকি, পায়ের ছাপ দেখি, ছাগলের মলের মতো মল দেখি, হরিণ আর দেখা হয় না।

১৯ ডিসেম্বর হরিণ দেখার অভিযান শেষ করে ফেরার পথে সবাই নামারবাজারে জড়ো হই। এমন সময় এক ঝুড়ি মাছ নিয়ে হাজির হয় এক জেলে যার মধ্যে ছিল দু’টি বোয়াল, কয়েকটি রুইসহ চেনা-অচেনা নানা প্রকারের মাছ। জেলে যে দাম হাঁকে সে দামেই মাছগুলো কিনে নেন খলিল ভাই (টিমলিডার)।

মুক্ত পানির ন্যাচারাল মাছ। মুক্ত পানির ন্যাচারাল মাছে একটা ভিন্ন স্বাদ ও ফ্লেভার আছে। যুগের পর যুগ চাষের মাছ খেতে খেতে মুক্ত পানির ন্যাচারাল মাছের স্বাদ ও ফ্লেভারের বিষয়টি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানে এসে হাইট্টা ধানের (কালো কুচকুচে এক প্রকার আউস ধান) চালের ভাত ও শৈশবে হারিয়ে যাওয়া মুক্ত পানির ন্যাচারাল মাছের স্বাদ ও ফ্লেভার খুঁজে পাই। কিন্তু একসাথে এত খানা খাব কী করে? সকালে মধু আর খেজুরগুড় দিয়ে চালের রুটি খেয়েছি। সে স্বাদ জিহ্বা থেকে শেষ হতে না হতেই আরো ১০ কেজি মাছ নিয়ে হাজির।
আমাদের খাবার সরবরাহের দায়িত্বে ছিল আলতাব কাকার হোটেল। আলতাব কাকার হোটেলের পাক খেয়ে খলিল ভাই বলেই ফেললেন, ‘এখানকার পাক খেয়ে বাড়ি গিয়ে আবার গিন্নিদের সাথে এই বলে ঝগড়া শুরু কইরেন না যে, তোরা এতদিন আমাগো কী খাওয়াইলি? আর দ্বীপের বেটারা আমাগো কি খাওয়াইয়া দিলো?
আগের দিন সকালে ৫০০ টাকা কেজি চিংড়ি মাছ, ইয়া বড় চিংড়ি। একেকটির ওজন ৫০০ গ্রামের কম হবে না। আলিশান একেকটি রুই-রোয়াল প্রতি কেজি ৩৫০ টাকার কাছাকাছি। আমাদের খানা তদারকির দায়িত্বে ছিল এক বরিশালের পোলা। পোলাটি সর্বদা খাই খাই অবস্থা। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ন্যাচারাল মাছের স্বাদ ও ফ্লেভার। খাওয়া শেষে পোলা খলিল ভাইয়ের কাছে এই মর্মে নালিশ করে যে, ‘স্যার, দেখেন তো আমি যখন খাই চাচা (হুদা সাহেব) তখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্যার, আপনিই বলেন, এখনই তো আমার খাওয়ার সময়। আমি তো খাওয়ার জন্যই আইছি, ১০ কেজি মাছ থেকে মাত্র ছয় টুকরো মাছ খাইছি।’

যে দ্বীপে আমার জন্ম সে দ্বীপের বর্তমান নাম মেঘনা উপজেলা হলেও আদি নাম ব্রাহ্মণচরের প্যাঁচ। আমাদের দ্বীপের সাথে নিঝুমদ্বীপের বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। মেঘনার বুক চিরে জেগে উঠেছিল নিঝুমদ্বীপ। দ্বীপটির বয়স একেবারেই কম। ১৯৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না এই দ্বীপে। তৎকালীন হাতিয়ার নেতা আমিরুল ইসলাম কালাম দ্বীপ পরিদর্শনে গিয়ে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব না দেখে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, হায় নিঝুমদ্বীপ। সেখান থেকেই নাম হয় নিঝুমদ্বীপ।

মেঘনার বুক চিরে ভেসে উঠেছিল ব্রাহ্মণচরের প্যাঁচ দ্বীপটিও। মেঘনার বুকে জেগে ওঠা দ্বীপের মধ্যে আয়তন ও বয়সের দিক দিয়ে মনপুরার পরই ব্রাহ্মণচরের প্যাঁচের স্থান। আমাদের দ্বীপটি ছিল সোনার ফসলগর্ভা আর মাছের খনি। চারপাশের নদীসহ দ্বীপটিকে মাছের প্রাকৃতিক অভয়াশ্রমও বলা চলে। এই দ্বীপে ছিল প্রচুর খাল-বিল, ডোবা-নালা ও নিম্ন ভূমি। বিশেষ করে পুরো দ্বীপটি বর্ষায় তলিয়ে যেত পানির তলায়। ফসলের জমি ও গ্রামগুলো জলের উপর ছবির মতো ভাসত। গ্রাম ও বাড়িঘর নির্মাণের জন্য যেসব কৃত্রিম খাল-ডোবা সেসব খাল ডোবাও তলিয়ে যেত বর্ষার পানিতে। ডিমওয়ালা মা-মাছসহ অসংখ্য ছোট মাছ আশ্রয় নিত দ্বীপের খাল-বিল, ডোবা-নালা, জলাশয়ে। এককালে এই দ্বীপের জলাশয়গুলোই ছিল হাজার প্রকার ন্যাচারাল মাছের অভয়াশ্রম।
সরকারের নজরে আসায় ‘মাছের পোনা দেশের সোনা’ স্লোগান নিয়ে, ‘পোনার’ একমাত্র প্রাকৃতিক যোগানদার চট্টগ্রামের হালদা নদী। হালদাকে দেশী -বিদেশী বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘জিন ব্যাংক’, ‘জাদুকরী মাছের ব্যাংক’, ‘মুক্তার খনি’ ও ‘অর্থনৈতিক নদী’ ইত্যাদি হরেক নামে আখ্যায়িত করে থাকে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে এ নদীতে উৎপাদিত মৎস্যসম্পদকে আল্লাহ তায়ালার অপার নিয়ামত হিসেবে বিস্ময়ের চোখে দেখেন বিজ্ঞানীরা। গ্রামাঞ্চলের চারপাশে নদীসহ ভেতরে যেসব জলাশয় ছিল সে সব নদী ও জলাশয় মুক্ত পানির মাছের ডিম দেয়ার উপযুক্ত ও নিরাপদ স্থান ছিল। সিলেটের হাওর-বাঁওড় পার হয়ে নদী মেঘনা দক্ষিণ দিকে গমনকালে এখানে এসেই একাধিক শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে মাঝখানে ৬০ বর্গমাইলবিশিষ্ট যে এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছিল, সেই এলাকার নামই ব্রাহ্মণচরের প্যাঁচ। ব্রাহ্মণচরের প্যাঁচের চারপাশের নদী-নালাগুলো কিছু দিন আগেও ছিল মাছের প্রাকৃতিক নিরাপদ আশ্রয়।

স্বাদ, ঘ্রাণ ও দাম অসাধারণ দেখে মাছ-ভাত ছাড়া নিঝুমদ্বীপের আর কিছুতে মন ভরেনি। নিঝুম দ্বীপের মাছের স্বাদ ও প্রাচুর্য শৈশবে দেখা আমার দ্বীপের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার গাঁয়ের একদিকে বিল, তিন দিকে নদী। শৈশব থেকে প্রচুর মাছ দেখে আসছি। নিজেও ধরেছি বারো রকমের মাছ। শৈশবের মাছ দেখা ধরা ও খাওয়ার কাহিনী আধুনিক শিশুদের কাছে রূপকথার গল্পের মতো।

আমার বাড়ির উত্তরদিকে একটি শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটের কাছেই মেঘনা। কয়েক বছর আগেও মেঘনা থেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখেছি। বিশেষ করে বর্ষার শেষে ছোট ছোট ডিঙ্গি নায়ে চড়ে নদীর স্রোতে ছিপ ফেলে বাইলা, কালিবাউশসহ নানা প্রকার মাছ ধরতে দেখেছি। বর্ষায় পাকা ঘাটলায় বসে কালিবাউশ ধরার আশায় গত বর্ষায় মাছের ঘ্রাণযুক্ত খাবারসহ গোটা চারেক ছিপ নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম। ঘাটলায় বসে ছিপ ফেলেছিলাম মেঘনার জলে। আমার এই আজব কাণ্ড দেখে উৎসুক শিশুরা ভিড় করতে শুরু করে। কারণ এই জন্মের শিশুদের কাছে ছিপ নিয়ে নদী মাছ ধরা অবিশ্বাস্য ঘটনা। এই দ্বীপের শিশুরা আগের দিনের মাছের কোনো খবরই জানে না। নদীতে ছিপ ফেলে এই দ্বীপের মাছের কাহিনী বলা শুরু হলে শিশুরা মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করে।

ছয় দশক আগে আমার বয়স যখন তোমাদের মতো, তখন জ্যৈষ্ঠ মাসে দেয়া ডাকলে মাথা আউলায়ে যেত। দেয়ার ডাকে খাল-বিল ছেড়ে ডাঙায় ওঠে আসে মাছ। জল শুকিয়ে থাকা খাল-বিলে ঢুকে পানি। নতুন পানির সাথে ঢুকবে টেংরা, পুঁটি, ডেলা, টাকি, বাইলা, পাবদা, ফলি, শিং, বাইনসহ নানা রকমের ছোট ছোট মাছ। দুই প্রকারের পুঁটির মধ্যে একটি চ্যাপটা, আরেকটি বড় ও লম্বাটে। লম্বাটে নাম জাতিপুঁটি। নতুন পানির সাথে নেমে আসা কোনো কোনো জাতিপুঁটির গায়ে আলতা লাগানো থাকে। ঠোঁটের পেছন থেকে লেজ পর্যন্ত লম্বালম্বি আলতা পরা পুঁটিকে আমরা বলি ‘বউপুঁটি’। হৃষ্টপুষ্ট নতুন বউপুঁটির পেটভরা শুধু ডিম আর ডিম। ডিম দেয়ার সময় হলে সাজগোজ করে গায়ে আলতা মেখে নাচতে নাচতে এসে বড়শি গিলতে শুরু করে। আলতামাখা বউপুঁটি ধরার জন্য আগেভাগেই ছিপ-বড়শি জোগাড় রাখতে হবে।

আকাশে গুড়–ম গুড়–ম গর্জন শুরু হয় বোশেখের শুরুতেই। গুড়–ম গুডুম সম্পর্কে মা বলতেন, ‘এসব দেব-দেবীর হাঁকাহাঁকি। বৈশাখ থেকেই কৃষকের হাতে তেমন কোনো কাজ থাকে না, কাজ থাকে না ঘরের গিন্নিদেরও। কাজকর্মহীন ঝড়-বাদলের দিনকে বলা হয় কুদিন। কুদিনে কোনো কোনো দেবতাও দেবীদের ঘরে রাখতে চায় ঘরেই। শুরু হয় দেবের হুমকি-ধমকি। দেবের হুমকি-ধমকিতে কাঁদতে আরম্ভ করে দেবী। দেবীর চোখের জল হয় বৃষ্টি আর দেবের হাঁকডাক হয় বজ্রে। ভাদর শেষে আশ্বিন। সামনে সুদিন। বের করে দেয়া দেবীকে ঘরে তুলতে যায় দেব। অভিমানী দেবী ঘরে উঠবে না। মান করে থাকে। মান ভাঙাতে আবার শুরু করে হুমকি-ধমকি। তাই, শরতের শেষে আশ্বিনে আবার শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। এভাবে ঋতু পরিবর্তন দেব-দেবীদেরই লীলাখেলা। বোশেখের ঝড় আর দেয়ার গর্জনে ঘুম ভাঙে মাছের। জোরালো বৃষ্টি হলে ডোবা-নালা ও খানাখন্দ পানিতে ভরে ওঠে। বৃষ্টির পানি মাঠ থেকে গড়িয়ে নামে বিলে। গড়িয়ে নামা পানির সোঁতা ধরে বিল থেকে ডাঙায় উঠে আসে উজাইন্যারা। ভাটি থেকে উল্টোদিকে ধাবমান মাছকে বলে উজাইন্যা। কোনো কোনো উজাইন্যা মাছ ভাঙায় উঠে আসে। ডাঙায় উঠে আসা উজাইন্যা মাছের মধ্যে কই মাছ অন্যতম।

প্রবীণদের মুখে ডাঙায় উঠে আসা উজাইন্যাদের অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনেছি। উজাইন্যারা বৈশাখের শেষ দিকে কান খাড়া করে রাখে। আকাশ ফেটে গুড়–ম গুড়–ম বজ্রসহ বৃষ্টি নামলেই উজাইন্যাদের মাথা গরম হয়ে যায়। মাথা গরম মাছ মারার জন্য মানুষ মালকোঁচা মেরে মাথলা মাথায় মাঠে নেমে আসে। কোঁচ, জুইত্যা, টেঁটা, জাল, পলো ইত্যাদি হাতে লোকজন ছড়িয়ে পড়ে মাঠে। উজাইন্যা বোয়াল মাছ পানির সোঁতা ধরে একেবারে বিলের কিনারে চলে আসে। কখনো কখনো উজাইন্যা বোয়ালের পিঠ ও দাড়ি পানির উপরে ভেসে উঠে। উজাইন্যা বোয়ালের শিকারিরা বলে রাঘববোয়াল। রাঘববোয়াল বড় ভয়ঙ্কর মাছ। পাকা শিকারি ছাড়া রাঘববোয়াল শিকার করা বিপজ্জনক। একটু অসাবধান হলে শিকারি নিজেই শিকার হয়ে পরে।

একদিন সহসা ঝড়বৃষ্টি থেমে পশ্চিমাকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। পূর্বাকাশে সাঁকোর মতো ভেসে উঠেছে সাত রঙের রঙধনু। টেঁটা হাতে ডুলা নিয়ে কই মাছ খুঁজতে এখনই বেরিয়ে পড়ার সময়। পানির সোঁতা বরাবর ছুটছি। এক জায়গায় উঁচু আল থেকে নিচু জমিতে কলকল শব্দে পানি নামছে। পানি বেয়ে কই মাছ উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। পানির কলকল ধ্বনির সাথে কই মাছের কানকোয় হাঁটার কটকট শব্দে আমার মাথা আউলায়ে যায়। কই মাছের পিঠে লোহার চিরুনির মতো খাড়া কাঁটা এবং কানকোর দু’পাশ ভাঙা কাচের মতোই ধারালো। বজ্রমুষ্টিতে ধরতে গেলেই কাঁটা লাগে। মাথায় যত রকমের কৌশল আছে সব কৌশল খাটিয়ে বেশ কয়টা কই ডুলায় ঢুকাতে পারি। দেখতে না দেখতে লোকজন হামলে পড়ে। মাছ ধরা নিয়ে সেকি হুলস্থূল কাণ্ড।

পরদিন ঝলমল রোদ। কৃষক মাঠে হাল দিতে যায়। হাল দিতে গিয়েও অনেকে দু’-একটা কই মাছ ঘরে তোলে। মাঠে যেখানে-সেখানে আটকেপড়া মাছ কাক-পক্ষী ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে খায়। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কাক-পক্ষীর মতো আমিও আটকেপড়া মাছ খুঁজতে বেরোই।

গ্রাম থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণে বন্ধুর মাঠ। মাঠের মাঝখানে ছোট একটি ডোবা। কয়দিন আগেও ডোবার তলা ছিল ঠনঠনে। বৃষ্টির পর এখন এক কোমর পানি। কোথা থেকে দলে দলে ব্যাঙ ডোবার পানিতে আশ্রয় নিয়েছে। শত শত ব্যাঙ ডাকাডাকি করে মাঠ তুলে নাচাচ্ছে। ডোবা থেকে কয়েক গজ দূরে একটি কাক। কাক ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে কী যেন খাচ্ছে। সাবধানে কাছে যাই। আচমকা ঢিল দিতেই কাকটি উড়ে যায়। দেখি, একটি কই মাছের অর্ধেকটা ঠোকরানো। কয়দিন আগে ডোবার পাশের জমিতে চাষি হাল দিয়ে গেছে। হাল দেয়া জমিতেও এক হাঁটু পানি। সব কিছু দেখে মনে হলো, এ ডোবায় উজাইন্যা কই থাকতে পারে।

বাড়ি থেকে ছোট কনুই জাল ও ডুলাসহ ফিরে আসি। ডোবায় জাল মারি। আস্তে আস্তে টানতে থাকি। জালের গোড়া কাছে আসতেই দেখি, লোছের ভেতর উৎপাত শুরু হয়ে গেছে। লোছ কাছে এনে হেঁচকা টানে ডাঙায় নিয়ে আসি। মাটির ঢেলা, কাঁকড়া আর ব্যাঙ জালের লোছ ভরে রয়েছে। ব্যাঙ আর কাঁকড়ার সাথে লোছের ভেতর তিন-চারটি কই মাছও লাফালাফি করছে। বৃষ্টির পানিতে কই মাছ! আনন্দ আর উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মাছে মাছে ডুলা ভরে উঠে। মাছগুলো কানকো দিয়ে ডুলা থেকে বাইরে আসতে চাইছে। ডুলার গায়ে শক্ত কানকোর ঘর্ষণে খড়খড় শব্দ হচ্ছিল। মাঝমাঠের ঠনঠনে ডোবায় বৃষ্টির জমা পানি থেকে মাছ ধরছি, আজব খবরখান শনৈঃশনৈঃ সারাগাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন পলো, ওঁছা, জালি, টেঁটা, কনুইজাল ইত্যাদি নিয়ে কই ধরা শুরু করে। শতাধিক লোক ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কয়েক শ’ কই মাছ ধরার ফলে ডোবার পানি একেবারে মাঠা হয়ে যায়।

ডুলা ভরা মাছ দেখে বাড়ির সবাই খুশি। কই মাছের প্রাণ, শক্ত প্রাণ। পানি দিয়ে পাতিলে ভরে রাখলে এগুলো অনেক দিন বাঁচে। মা ভাজা করার জন্য বড় দেখে কয়টা মাছ আলাদা করে বাকি মাছ একটি বড় পাতিলে জিইয়ে রাখেন।

মা মাছ কাটতে শুরু করলে আমি মায়ের সামনে যাই। হৃষ্টপুষ্ট ও জ্যান্ত মাছগুলো ভীষণ দাপাদাপি করছিল। দাপাদাপির কারণে মা কাটতে পারছিলেন না। তা দেখে হজরত মামা এগিয়ে আসেন। মামা মাটিতে আছড়িয়ে মাছগুলো নিস্তেজ করেন। মা নিস্তেজ মাছ বঁটিতে তোলা শুরু করলে আমি জানতে চাই-
- মা, জ্যৈষ্ঠ মাসে আসমান ডাকলে কই মাছ পাগল হয়ে যায় কেন?
- কে বলল, আসমান ডাকলে কই মাছ পাগল হয়ে যায়?
- সবাই তো বলে। পাগল না হলে জলের মাছ ডাঙায় উঠে আসবে কেন?
- ওরা ডাঙায় উঠে আসে ওদের বাচ্চাদের নিরাপত্তা জন্য।
- কী রকম?
-চেয়ে দেখ, প্রতিটি মাছ কেমন মোটাসোটা। (মা একটি মাছের পেট চিড়ে কাঁঠালের বিচির আকৃতি হলুদ রঙের একজোড়া ডিম হাতে নিয়ে) দেখ কত বড় ডিম! ডিমওয়ালা কইকে বলা হয় মা-কই। ডিম দেয়ার সময় হলে কোনো মায়েরই মাথা ঠিক থাকে না।
- মাথা ঠিক থাকে না বলে কি জলের মাছ ডাঙায় উঠে আসবে?
- মাছের পেটে ডিম এলে নিজ জীবনের নিরাপত্তার চেয়ে সন্তানের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবতে শুরু করে। মাছ কথা বলতে পারে না এ কথা সত্য। তাই বলে অনুভ‚তি নেই, এ কথা সত্য নয়। যারা কথা বলতে পারে তারা সবাক। সবাকের চেয়ে নির্বাকের অনুভ‚তি অনেক বেশি। নির্বাক প্রাণীদের যত বোকা মনে করা হয় আসলে ওরা তত বোকা নয়। কোনো কোনো বণ্টনের সময় সৃষ্টিকর্তার বিচারের ভুল হয়নি। তাই, মানুষ ছাড়া অপরাপর প্রাণীদের একদিকে দুর্বল করে অপরদিকে সবল করে দিয়েছেন। মাছ এদের প্রখর অনুভ‚তিশক্তি দিয়ে ডোবা-নালার অবস্থান বুঝতে পারে। এক মাছের ডিম-বাচ্চা আরেক মাছ খেয়ে ফেলে। সবল মাছের ভয়ে দুর্বল মাছ সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়ে পড়ে। ডাঙায় উঠে ডোবা-গর্ত পেলেই স্বস্তিতে ডিম ছাড়ে। একটি কই মাছে যে পরিমাণ ডিম রয়েছে সে পরিমাণ বাচ্চা বড় হলে এ গাঁয়ের সবাইকে একটি করে কই ভাজা খাওয়ানো যেত।
-এত বাচ্চা! একটি কইয়ের ডিমে?
- কই মাছের ডিমের কথা শুনেই তাক লেগে গেলে। ইলিশ মাছের কথা শুনলে কী করবে! সবচেয়ে বেশি ডিম দেয় ইলিশ। একজন লোক এককালে খেতে পারে পাঁচটি ইলিশ মাছের ডিম। একটি ইলিশ মাছ এককালে ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। পাঁচটি ইলিশ মাছ এককালে যে ডিম দেয় সে ডিমের প্রতিটি বাচ্চা বড় ইলিশে পরিণত হতে পারলে সেই ইলিশ দিয়ে ১০ কোটি মানুষকে একবেলা পেটভরে খাওয়ানো যাবে। আমরা নির্বিচারে ১০ কোটি মানুষের খাবার একাই সাবাড় করে থাকি। তোর জন্য আমার যতটুকু দরদ প্রতিটি প্রাণীর তার সন্তানের জন্য ততটুকু দরদ।
-(কিছুক্ষণ ভেবে) শুনেছি, মাছ নিজের বাচ্চা খায়, যারা নিজের বাচ্চা খায় তাদের এত দরদ কিসের?
-ভুল শুনেছি, কোনো মাছই নিজের বাচ্চা খায় না। এক মাছ অন্য মাছের বাচ্চা খায়। এ কারণেই মা-মাছ অন্য মাছের ভয়ে বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail: adv.zainulabedin@gmail.com
(পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে)


আরো সংবাদ



premium cement