২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমি কথা বলতে চাই

- ফাইল ছবি

তার মানে আমি কথা বলতে পারছি না। আমি এই কথাটা জানাতেই সূচনায় আমার কথা বললাম। আমার এ কথা কি পুরোপুরি সত্য? নাকি আংশিক সত্য? নাকি ৫০ ভাগ সত্য নাকি ৭৫ ভাগ সত্য? নাকি শতভাগ?

এই রকম অনেক প্রশ্নই সাধারণের মনে গুমড়ে মরছে। কারণ, যারা সরকার দলীয় লোক, তারা মনে করে, দেশে সাংবাদিকতার পরিবেশ সুস্থ ও স্বাভাবিক আছে। কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা নেই। কারও লেখার স্বাধীনতা নস্যাৎ করেনি সরকার। তবে, সামান্য হলেও প্রতিবন্ধকতা আছে সেই মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে। কোনো গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই তারা তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে ভয় পায়। কেন ভয় পায়? কারণ সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এর মধ্যেই ৪২১টি মামলা হয়েছে। সর্বশেষ মামলায় প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান ও সম্পাদক মতিউর রহমানও রয়েছেন। সরকার প্রধান জাতীয় সংসদে যে ভাষায় প্রথম আলো নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন, তাতেই প্রমাণ হয় এই সরকার গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। স্বাধীনতা দিবসে খাদ্যের জন্য হাহাকার করারও কি অধিকার নেই এদেশের মানুষের? সরকারের সমালোচনা যে সরকার সহ্য করতে পারে না, সেই সরকার আর যাই করুক, গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়।

সবাই যার যার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির কথা লিখছেন। সেগুলো দেশের সংবাদপত্রগুলো কমবেশি ছাপছে। কখনো এডিট করে। সরকার ক্ষেপে যেতে পারে, এই ভয়ে সেন্সর করে পত্রিকাগুলো স্ব-উদ্যোগেই। কোনো পত্রিকাই নিজেদের পত্রিকার ডিক্লারেশন বন্ধ করতে চায় না। যদিও সরকারের সেই আইনি অধিকার নেই যে ডিক্লারেশন বন্ধ করে দেবে। কিন্তু তারপরও তো আমরা দেখেছি দৈনিক আমার দেশকে কিভাবে বন্ধ করা হয়েছে।

জেলাপ্রশাসককে ব্যবহার করে যে ঘোরতর বেআইনি কাজ সরকার করেছে, পুলিশি অ্যাকশনের মাধ্যমে যে নারকীয় কাণ্ড ঘটানো হয়েছে, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে তার নজির নেই। ১৯৭৪ সালে গণকণ্ঠও বেআইনিভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। সেই সব ইতিহাসের ধারাবাহিকতাই আমাদের রাজনৈতিক সরকারের চেতনায় এমনভাবে গেড়ে বসে আছে যে আমরা সেই ধারণার বাইরে আসতে পারিনি আজো।
বহু নিউজ কনটেন্ট নিয়েই আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পারি। যেমনটা করতে দেখেছি প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২৬ মে মার্চে একটি ফটোক্যাপশনের কনটেন্ট নিয়ে। সেখানে খাদ্যের দাবি করা হয়নি। খাদ্য কিনতে না পারার কথাটা আক্ষেপের সাথে বলেছিল একজন খেটে খাওয়া মানুষ। ওই নিউজের বয়ান যেহেতু খাদ্য আর দিনটি স্বাধীনতার দিন, তাই সরকারের মনে সন্দেহ জেগেছে যে প্রথম আলো স্বাধীনতাকে তিরস্কার করতেই ওই দিনে ওই নিউজ ছেপেছে। এটা যেমন একধরনের সত্য, তেমনি স্বাধীনতাকে ওই নিউজ নস্যাৎ করেছে, এই চেতনাও সত্য নয়। কেননা, ওই দিনটিতে কি আধপেটা কিংবা না খেতে পাওয়া মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। কিংবা কোনো অভুক্ত মানুষ ছিল না? বা অন্যান্য দিনেও কি তাদের পরিমাণ কম বা বেশি ছিল? খাদ্যশস্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন আর প্রান্তিক মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছানোর বিষয়টি ভিন্ন। গোলাভরা খাবার থাকলেই যে অভুক্ত মানুষের পেটে খাদ্য পৌঁছাবে এই তাত্তি¡ক রাজনৈতিক বয়ান, সত্য ধারণ করলেই বাস্তব সত্য নয়। রাজনৈতিক দলের বয়ান আর প্রকৃত সত্যের মধ্যে ফারাক অনেক।

এই সব চিন্তা হচ্ছে স্বার্থের ভেতরে নিহিত সত্য। তার ও তাদের ভাবনায় স্বাধীনতা এতোটাই ঠুনকো যে তার একটি ফটোকার্ডের ছোট একটি রাজনৈতিক বয়ানেই কাঁপতে থাকে এবং তা পাকা পাতার মতো বোঁটা খসে পড়ে নিচে। না, স্বাধীনতা ওই রকম হালকা-পলকা বিষয় নয়। আসলে এই সূত্র ধরে সরকার চাইছে যেন কোনো মানুষ তার অধিকারের বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করতে না পারে। সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করতে না পারে। ঠিক ওখানেই সংবাদপত্রের, সাংবাদিকতার, মুক্ত চিন্তার ও মুক্ত সাংবাদিকতার বিরোধী শক্তির তৎপরতা থাকে। আর সেটাই হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মুক্ত সাংবাদিকতার বিরোধী সরকারের খারাপ দৃষ্টান্ত। এ বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডমের যে স্কোর ঘোষিত হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ এক পয়েন্ট নিচে নেমে এসেছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। গত বছর ওই পজিশন ছিল ১৬১তম। এই এক পয়েন্ট কমেছে কেন, কী জবাব আছে সরকারের কাছে? কারণ সরকার ফ্রিডমের মানে কী তাই তো বোঝে না। ভোট দেয়ার যে সাংবিধানিক স্বাধীনতা, সেটাও যে মতপ্রকাশেরই অন্য একটি স্বাধীনতা, সেটা বোঝারও ঘাটতি আছে সরকারি দলের। এ কারণে বর্তমান সরকার ভোটের আগের রাতেই পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের সহযোগে ব্যালটপেপার কেটে বাক্স ভরে নিয়ে বিজয় ঘোষণা করে। এতেও তাদের মনে একটুও লজ্জা বা শরম লাগেনি। বরং তারা গর্বের সাথে ওই অবৈধতাকেই নিজেদের বিজয়ের পতাকা বানিয়েছে।

মুক্ত, স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। কারণ, সাংবাদিকরা কোনো ব্যক্তি স্বার্থে বা দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদের শাণিত কলম ধারণ করে না। সমাজের সবচেয়ে সচেতন, প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী, প্রজ্ঞাবান ও সৃজনীভাবনার অধিকারীগণ কোনো রাজনৈতিক দলেরই লেজুড় হতে পারে না। যদি কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয় বা কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে কলম ধরে কোনো সাংবাদিক, তাহলে বুঝতে হবে, সেই তিনি হারিয়ে বসেছেন তার নৈতিক অধিকার।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু অন্যের মতপ্রকাশকে পুলিশি অ্যাকশনের মাধ্যমে কণ্ঠরোধ করার যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মনন, তা থেকে স্বাধীন হতে পারিনি আমরা আজো। কারণ আমরা বহন করছি ব্রিটিশীয় ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা আর কালচারাল হেজিমনির মনন ও মনীষা। ওই পরাধীন চেতনার বিদায় ঘটানোর কাজটি আমরা ১৯৭১ সালে করলেও, গত বাহান্ন বছরেও তা পরিত্যাগ করতে পারিনি। আমাদের পরাজয় এখানেই।

ঢাকার পত্রিকাগুলোতে সেলফ সেন্সরশিপ এখন মুক্ত, স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রধান অন্তরায়। এখন বাংলাদেশে, একশ্রেণীর সাংবাদিকরাই মুক্তস্বাধীন চিন্তার বিরোধী। তারা সরকারের সমালোচনা করলেই নাখোশ হন, তারা সরকারের লেজুড়ে পরিণত হয়েছেন। সরকারের কথিত উন্নয়নের রাজনীতিই তাদের সাংবাদিকতার প্রধান উপাত্ত। এর উল্টোপিঠের উপাত্ত তাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া জাগাতে পারে না। কোনো ভিন্নমতের লেখা ছাপতে বা নিউজ পোর্টালে আপ করতে চায় না কোনো দলান্ধ সাংবাদিক। তাহলে তাকে নানাভাবে বাধা দেয়া হয়। সরকারের এজেন্ট-সাংবাদিকগণ এ ব্যাপারে ভীষণরকম স্মার্ট। আবার অনেক সময় ওই প্রতিবন্ধকতা তাদের ব্যক্তিগত নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের ফলে। সরকার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে মনে না হয় যে সাংবাদিকতা সাপ্রেসনের মধ্যে আছে।

ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিকদের কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির কোনো সুযোগ নেই। ভিন্ন মতের পত্রিকা প্রকাশেরও নেই ডিক্লারেশন। যারা ভিন্নমতকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেন, তাদের পত্রিকাকে সরকারি বিজ্ঞাপন যেমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তেমনি বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতাদেরও প্রচ্ছন্ন হুমকির মধ্যে রাখা হয়েছে। ফলে ওই সব পত্রিকা আর্থিক সঙ্কটে হাঁসফাঁস করছে। যারা চাকরি করেন বিভিন্ন পত্রিকায়, তারা তাদের ভিন্নমত প্রকাশও করতে পারেন না। তারপরও যারা বিভিন্ন কায়দা-কৌশলে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান বা বলেন, লেখেন কোনো গণমাধ্যমে, সামাজিক গণমাধ্যমে, সরকারের কাজের সমালোচনা, সরকারের অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলোর ত্রুটি-বিচ্যুতি, মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়, মেগা প্রকল্পের ক্ষতি, অলাভজনক প্রকল্পের তরফে লুটপাটের অভিযোগ, ব্যাংকব্যবস্থাকে লুটেরাদের হাতে ছেড়ে দেয়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থা ও ঋণের মাধ্যমে লুটে নেয়া, সরকারের দেয়া বানোয়াট তথ্যের ব্যাপারে সন্দেহপোষণ করে লেখা ও মতপোষণ করা- এ ধরনের ভিন্নমত সরকার পছন্দ করে না। অথচ সংবাদপত্রের এই ধরনের রিপোর্ট বা বিচার বিশ্লেষণ যে সাংবাদিকতার প্রধান লক্ষ্য, সরকারের কাজের ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া, যাতে তা সংস্কার করে সংশোধন করতে পারে।

সংবাদপত্রকে এ কারণেই চতুর্থ এস্টেট হিসেবে গণ্য করা হয়। সাংবাদিকরা সারাক্ষণ এই ভয়ে থাকেন যে কখন না জানি পুলিশ এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এটা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের পরিবেশ পরিস্থিতি। সাংবাদিকদের পেশার চেয়ে দলগত অনুকারী ও লেজুড় হিসেবে বিনির্মাণ করেছে সরকার। ফলে দু’টি মোটা দাগের ভাগ আছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়। নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় চেতনা হারিয়ে ফেলছে সাংবাদিকরা। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার যে মৌলিকত্ব তা আজ কড়ে আঙুলে গোনা যায়। এবং তাদের মতপ্রকাশের কোনো স্বাধীন জায়গা নেই বললেই চলে। এই রকম অবস্থায় কি আমি কথা বলতে পারি? নাকি পারবো? ভিন্নমত প্রকাশ না করলে সরকারের কর্তৃত্ববাদী চেহারা প্রকট হয়ে ওঠে। দেশের উন্নয়নের কথা বলে পেরিফেরিয়াল বা প্রান্তিক এলাকার মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার তো হরণ করা যায় না। মনে রাখা জরুরি যে ওই প্রান্তিক জনগণই আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এবং তারাই বঞ্চিত সব থেকে বেশি। জাকির হোসেন নামের দিনমজুর তো ওই প্রান্তিক মানুষদেরই প্রতিনিধি। ওই প্রতিনিধিকে তো আপনি পরিত্যাগ করতে পারেন না।

সেই রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার কী রাজনীতিকদের আছে?


আরো সংবাদ



premium cement