১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খাই খাই রব

লেখক ড. আবদুল লতিফ মাসুম। - ছবি : সংগৃহীত

লুৎফর রহমান রিটনের ছড়াটি বেশ মনে পড়ে : ‘আবদুল হাই, করে খাই খাই, এক্ষুনি খেয়ে বলে, কিছু খাই নাই।/ লাউ খায় শিম খায়, খেয়ে মাথা চুলকায়, ধুলো খায়, মুলো খায়, মুড়ি সবগুলো খায়, লতা খায় পাতা খায়, বাছে না সে যা-তা খায়, থেকে থেকে খাবি খায়, কত হাবিজাবি খায়, সেদ্ধ ও ভাজি খায়, খেয়ে ডিগবাজি খায়, বকুনি ও গালি খায়, থামে না সে খালি খায়।/ গরু খায় খাসি খায়, টাটকা ও বাসি খায়, আম খায়, জাম খায়, টিভি প্রোগ্রাম খায়।/ খোলা মাঠে হাওয়া খায়, পুলিশের ধাওয়া খায়, ফুটবল কিক খায়, রক মিউজিক খায়, মিষ্টির হাঁড়ি খায়, জামদানি শাড়ি খায়, ভাত তরকারি খায়, টাকা কাঁড়ি কাঁড়ি খায়।/ চকোলেট টফি খায়, শরবত কফি খায়, ঘটি খায় বাটি খায়, চিমটি ও চাঁটি খায়।/ হাসি খায় খুশি খায়, ভুসি খায়, ঘুষি খায়, ট্যাংরা ও তিমি খায়, কোল্ড্রিংকস মিমি খায়, বেঞ্চি ও টুল খায়, বিরিয়ানি ফুল খায়, স্বর্ণের দুল খায়, খেয়ে ক্যাপসুল খায়।/ গাড়ি খায় বাড়ি খায়, পুলিশের ফাঁড়ি খায়।/ গুঁতো খায়, জুতো খায়, সুঁই খায় সুতো খায়।/ তরতাজা হাতি খায়, শরীফের ছাতি খায়, মাঝে মাঝে লাথি খায়।/ যা দেখে সে তাই খায়, অ্যাশট্রে ও ছাই খায়, খেতে খেতে খেতে খেতে, পেট হলো ঢোল, তবু তার মুখে সেই, পুরাতন বোল- কী যে অসুবিধে, খালি পায় খিদে।/ আবদুল হাই, করে খাই খাই, এক্ষুনি খেয়ে বলে, কিছু খাই নাই!’ ছড়াটি বেশ মজার। ভাবার্থ তাৎপর্যপূর্ণ। আসলেই সমাজে এমন কিছু লোক আগেও ছিল, যাদের ছিল খাই খাই রব। এখন সেই কিছু লোক অনেক লোক হয়েছে। হিসেব নিলে দেখা যাবে এখন সমাজের শতভাগ লোক খাই খাই রব করছে। কিছু লোক, খাই খাই লোকদের ভাষায়, অযোগ্য, অপদার্থ ও অযাচিত। তারা খাই খাই রব করে না। ঘুষ খায় না। দুর্নীতি করে না। টাউটারি, বাটপারি বোঝে না। এরা সৎ ও সহজ সরল। বাংলাদেশে বেশ কিছুকাল আগে অফিসে অফিসে খোঁজ নিয়ে, গবেষণা করে সৎ ও অসৎলোকের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ বেরিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, যারা দুর্নীতিবাজ তারা অধিকতর দক্ষ ও যোগ্য। যোগ্যতার নাম যদি হয় প্রহসন, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা তাহলে নিঃসন্দেহে সৎলোকগুলো অযোগ্য। আজকাল যোগ্যতার মাপকাঠি পাল্টে গেছে। লেখা পড়ায় যে দুর্বল, বিশেষ পরিচয়ে তিনিই সবল। চাকরিতে যিনি যতটা দলবাজ ও তেলবাজ তিনি ততই যোগ্য। ব্যবসায় যিনি যতটা অসৎ তিনি ততটাই অর্থবান। যে পুলিশ যতটা মারমুখী তিনি ততই পদক পাওয়ার যোগ্য। গ্রামে যে যতটা টাউট ক্ষমতাসীনদের কাছে সে ততটাই প্রিয়।
রাজনীতিকে এক সময়ে মনীষী স্যামুয়েল জনসন যা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, ‘Politics is the Last Refuge of the Scoundrel’. রাজনীতি বদমাশদের শেষ ঠিকানা। বাংলাদেশের কোনো কোনো দলের রাজনীতি দেখে এরকম মন্তব্য যদি কেউ করে তা কি খুব অন্যায় হবে? সমাজ ও রাজনীতির যে পরিচয় আমরা পেলাম তার সাথে আলোচ্য খাই খাই রবের প্রাসঙ্গিকতা ও সম্পৃক্ততা অবিচ্ছেদ্য। কথাটা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, ‘No Money, No Politics’. সমাজ ও রাজনীতির অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত এই খাই খাই রবের বিস্তৃতি। সমাজ একসময় বিশুদ্ধ ছিল, এরকম বলব না। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সমাজ ও রাষ্ট্রে খাই খাই রব বা অর্থলোলুপতা ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন তা সমস্ত সীমারেখা অতিক্রম করেছে।
দেশের যেকোনো প্রান্তে আপনি যান টেকনাফ কিংবা তেঁতুলিয়ায়, তহসিল অফিস কিংবা সচিবালয় অথবা বিমানবন্দরের টার্মিনালে আপনি খাই খাই রবের নমুনা পাবেন। আগে ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসগুলো সদাচার, সহযোগিতা ও আত্মীয়তায় পরিচালিত হতো। এখন সেখানে খাই খাই রব। টাকা ছাড়া টিকিটিও নড়ে না। পিয়নের ঘুষ ২০ টাকা থেকে ২শ’ টাকা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের আকাশ ছোঁয়া বৃদ্ধিতে এর পরিমাণ আরো বেড়ে যেতে পারে। এই যে দ্রব্যমূল্যের কথা বললাম তাও খাই খাই রবের ফলাফল। সবাই জানে সবাই বোঝে যে ক্ষমতাসীনদের একটি সিন্ডিকেট পর্দার অন্তরাল থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের খাই খাই রবের কোনো শেষ নেই। ১৯৭৪ সালে তাদের আমলে ৬ আনার টুথপেস্ট ৬ টাকায় বিক্রি হতে দেখেছি। লবণের বস্তা নিয়ে কাড়াকাড়ি হতে দেখেছি। এখনো আমরা অনেক সুখেই আছি। মন্ত্রী বলছেন, স্বর্গে আছি। আসলেই তো! আমাদের জিনিসপত্রের দাম যদি আমেরিকার মতো না হয়, তাহলে আমরা কী করে বুঝব যে, উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছি। গরিব দেশ থেকে বড়লোকের দেশে পরিণত হয়েছি। আসলে যারা খাই খাই রব করে তাদের লোভের লাগাম নেই। এ দেশের একজন মফস্বলের ছাত্র নেতা যখন ২শ’ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, তখন বোঝা যায় তাদের খাই খাই রবের মাত্রা কতো দীর্ঘ।

এবার আসি বাস্তব জগতে। ক্ষমতাসীন লোকেরা এ দেশকে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে। এক সন্তান যেমন অন্য পিতার সম্পত্তি দাবি করতে পারে না, তেমনি তারা মনে করে তাদের দল ছাড়া অন্য কোনো লোকের অধিকার থাকতে পারে না। তাদের খাই খাই রবের কিছু নমুনা দেখা যাক। গত কয়েক বছরের কয়েকটি ছিটেফোঁটা প্রকাশিত শুধু একটি অনলাইন সংবাদপত্র নিউজবাংলা২৪’র সংবাদ তুলে ধরা হলো: প্রবাসীর জমি দখল করে বসতঘর নির্মাণের অভিযোগ (৩০ ডিসেম্বর, ২০২২), হাটের জায়গা দখলে, বিক্রেতারা সড়কের পাশে (৬ ডিসেম্বর, ২০২২), জমি দখলের অভিযোগে নারী কাউন্সিলর বরখাস্ত, নিরাপত্তা চান ভুক্তভোগী (২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২), সাঁওতালদের ‘জমি দখল করে ভারত চলে যেতে চাপ’ এমপি সাদিকের (৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২), লোলা গাঙকে ‘পঙ্গু করছে’ পৌরসভা (৫ মার্চ, ২০২২ ), জমি দখল : এমপি বললেন, কাগজ দেখাক ছেড়ে দেবো (১ মার্চ, ২০২২), মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ পরিবারের (২৮ ফেব্রæয়ারি, ২০২২ ), জমিদখলের ‘চেষ্টা’ এম শাহে আলমের (২৬ জানুয়ারি, ২০২২), সুমিত্রা-রুপাদের পাশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ (২৩ জানুয়ারি, ২০২২), সুমিত্রা-রুপাদের স্বপ্ন কেড়ে নিলো সিকদারের বাগানবাড়ি (২২ জানুয়ারি, ২০২২), বীর মুক্তিযোদ্ধার দোকান দখল করে ‘নির্বাচনী ক্যাম্প’ (২২ অক্টোবর, ২০২১), জমি দখলে বাধা দেয়ায় মারধর, আহত ২ (২০ আগস্ট, ২০২১) দিনমজুরের ঘর ভেঙে বসতভিটা দখলের চেষ্টা (২ আগস্ট, ২০২১), পুলিশি ক্ষমতার জোরে বিধবার জমি দখলের অভিযোগ (২৬ জুন, ২০২১), ‘খাল দাও নতুবা বিষ দাও’ (২৫ জুন, ২০২১), তহশিলদারের বিরুদ্ধে অন্যের ফসল কেটে নেয়ার অভিযোগ (৩০ জানুয়ারি, ২০২১) ও নদী দখলকারীদের তালিকা হচ্ছে : নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী (১৫ ডিসেম্বর, ২০২২)। এতসব দখলের সংবাদের পর শেষ সংবাদটি লক্ষ করুন। নদী দখলকারীদের তালিকা তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী।
আদৌ সেই তালিকা হয়েছিল কি না, আমাদের জানা নেই। তবে সংবাদপত্রে কোনো কোনো সময় দখল উচ্ছেদের ছবি দেখেছি। কিছুদিন পর সেটি আবার বেদখলের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে দেখেছি। যখনই কোনো অঘটন ঘটে, অন্যায় ঘটে তখনই ক্ষমতাসীন মন্ত্রীরা হুংকার দেন, ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড়া হবে না। যারা অব্যবস্থায় অভ্যস্ত তারা ব্যবস্থা নিবে কিভাবে? কাউকে ছাড়া হবে না- একথার মধ্যে একটা যদি আছে। যদি দখলকারী আওয়ামী লীগার হয়ে থাকেন তাহলে সাত খুন মাফ। আর এখন তো সবাই আওয়ামী লীগ করেন। এভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি খাই খাই রবের লোকের অর্থাৎ ভোগ ও দখলদারদের মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। উল্লিখিত সংবাদগুলোতে দু-এক বছরের অতি সামান্য চিত্র তুলে ধরেছি। বিগত ১৫ বছরেও কমেনি তাদের লোভের লেলিহান জিহবা। এই কয়েক দিনে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ তুলে ধরছি। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘২১ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি এবং ৪টির ভবনসহ বেদখল হয়ে গেছে ঢাকা শহরে (প্রথম আলো, ৪ মে ২০২৩)। ‘দরপত্র বাগিয়ে নিতে ইউএনও’র চিঠি জাল কোটালিপাড়া ছাত্রলীগ নেতার (নয়া দিগন্ত, ৬ মে ২০২৩)। খিলগাঁও এর ঝিল দখল করে গড়ে উঠছে দালানকোঠা (নিউএজ, ৬ মে ২০২৩)। উদ্ধার হয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড- পাউবো’র বেদখল সাড়ে ১০ একর জমি- মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষিত (যুগান্তর ৬ মে ২০২৩)। আরেকটি সংবেদনশীল প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুরতন ব্রহ্মপুত্র নদকে বাঁচাতে হাঁটু পানিতে নেমে প্রতিবাদ করছে জনগণ। খননের নামে দখলদারদের দখলে চলে যাচ্ছে এই পুরাতন নদ। অবশ্য সব দখলদারই রাজনৈতিক না-ও হতে পারে। সব দলে সব মতে দখলকারী আছে। খাই খাই রব আছে। তবে এখনকার ক্ষমতাসীনরা খাই খাই রব-এর অন্যায়কে ন্যায়ের মতো প্রতিষ্ঠা করছে। তাতে প্রভাবিত হচ্ছে অন্যরা। খাই খাই সংস্কৃতি দ্বারা বিভ্রান্ত এবং উৎসাহিত হচ্ছে গোটা জাতি। মানুষ মানুষের জন্য- এ নীতি কথা ক্রমেই লোপ পাচ্ছে।

আমরা বলছিলাম খাই খাই রবের কথা। রাজনৈতিক শক্তি দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই যা তাদের খাই খাই মানসিকতা থেকে মুক্ত থেকেছে। মেগা প্রজেক্টের মেগা দুর্নীতির কথা সকলেরই জানা কথা। ব্যাংকগুলো লুটপাটে ফোকলা করে ফেলেছে তারা। বিদ্যুতের নামে যা তারা করেছে তা দস্যুতাকেও হার মানায়। উন্নয়নের মহাসড়কে যেতে তারা নির্মাণ খরচের ক্ষেত্রে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছেন। সরকারি প্রকল্প ও ত্রাণসামগ্রীতে তাদের লুটপাট ষোলআনা। যথার্থ ভাবেই তারা গোটা দেশকে ‘উল্টেপাল্টে দিয়ে লুটেপুটে খাচ্ছে’। আবারো সেই ছড়ায় ফিরে যাই- ‘তবু তার মুখে সেই, পুরাতন বোল-, কী যে অসুবিধে, খালি পায় খিদে।/ আবদুল হাই, করে খাই খাই, এক্ষুনি খেয়ে বলে, কিছু খাই নাই!’ আবদুল হাইদের খিদে কখনো মেটে না। তারা দেশটাকে গিলে খেয়েছে, তবুও বলে, তারা কিছু খায় নাই।

রাজনৈতিক দলসমূহে সব নেতাকর্মীদের মধ্যে এই প্রবণতা বিদ্যমান। হাফেজ্জি হুজুর রাজনীতিতে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খাই মেটাতে গিয়েই রাষ্ট্র উজাড় হয়ে যায়। ‘জিয়াউর রহমান খুব শক্তভাবেই এই খাই খাই মনোভাবের তীব্র নিন্দা করেছেন। তার বক্তৃতার নোটবুক ও লেখায় এর প্রমাণ মিলবে। খুব কষ্টের কথা, এই সময়ের বাংলাদেশে এই মূল্যবোধের চর্চা নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা কখনো কখনো কেতাবি ভাষায় ভালো ভালো কথা বলেন বটে, কিন্তু তাদের মন্দ মন্দ কাজের মাঝে সব কিছু হারিয়ে যায়। অবশেষে সুকুমার রায়ের ছন্দময় ‘খাই খাই’ কবিতাংশ উদ্ধৃত করছি ভবিষ্যৎ খাই খাই ওয়ালাদের জন্য : ‘খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে-
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড় করে আনি সব, থাক সেই আশাতে।‘

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement