২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতীয় সরকার ও সঙ্কট উত্তরণ সম্ভাবনা

লেখক ড. আবদুল লতিফ মাসুম। - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ রাজনৈতিক সঙ্কটপ্রবণ দেশ। অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়নি। সরকার পরিবর্তনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথের বদলে অনিয়মতান্ত্রিক অধ্যায় রচিত হয়েছে। কখনো স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতি, রক্তপাত, অভ্যুত্থান ও ষড়যন্ত্রে অতিবাহিত হয়েছে সময়। এবারের রাজনৈতিক সঙ্কটও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা থেকে সৃষ্ট।

বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এক রকম গায়ের জোরে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছে। জনগণের সম্মতি ও সম্মানের তোয়াক্কা করেনি তারা। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’। সোনার হরিণের পিছু পিছু ধেয়ে সোনার বাংলাকে প্রায় শ্মশান করেছে তারা। আওয়ামী লীগ হাজার বছর ধরে ক্ষমতায় থাক, তাতে কারো আপত্তি নেই। ‘কেয়ামত ছে কেয়ামত তক’ ময়ূর সিংহাসনে আসীন থাকুক তারা- জনগণের আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তি সেখানেই যে, তারা জনগণের সম্মতির বিপরীতে শক্তি মদমত্ততায় ক্ষমতা দখল করেছে বারবার।

২০০৮ সালের কারসাজির নির্বাচন, ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের নিশীথ নির্বাচন অবশেষে সমাগত ২০২৩ সালের নির্বাচনকেও তারা নতুন প্রকৌশলে জিতে যেতে চায়। সবাই বলছে, ‘বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান’। রাজনৈতিক দলগুলো বহুধাবিভক্তির মধ্যে জোটে জোটে সূচনা করছে জাতীয় ঐক্যের। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন আর নয়। তারা জাতির আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়েছে। অপর দিকে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার বলা হচ্ছে, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের মন্ত্রী, আধামন্ত্রী, পাতিমন্ত্রী এমনকি বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা গলদঘর্ম হচ্ছেন জনগণকে বোঝাতে- নির্বাচনটি অবশ্যই নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু আদর্শলিপিতে আছে, ‘খলের আশ্বাসবাক্য না করিবে বিশ্বাস’।

সরকারে গোঁ ধরেছে, নির্বাচনটি তাদের অধীনেই হতে হবে। সংসদীয় সরকারব্যবস্থা মোতাবেক আসলে তাই নিয়ম। কিন্তু তারা অতীতের অনিয়মে প্রমাণ করেছেন ব্রিটেন-কানাডা তো দূরের কথা মুদির ভারতকেও তারা লজ্জা দিয়েছেন। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি বারবার জয়লাভ করছে। সেখানে ধর্মীয় উন্মাদনাকে সম্বল করেছে তারা। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ভোট ছাড়াই ১৫৩ জন সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিরল ঘটনা সেখানে ঘটেনি। দিনের ভোট রাতে অনুষ্ঠিত হয়নি। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ন্যূনতম নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের তোয়াক্কা তারা করেনি। তাই নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বাংলাদেশের বাতাস ততই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। আগামী নির্বাচন আদৌ হবে কি-না? হলে কী পদ্ধতিতে হবে অথবা অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছে গোটা জাতি।

এদিকে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের নিপীড়নের মাত্রা অতীতকে অতিক্রম করেছে। রক্তপাতের ঘোষণা দিচ্ছে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। সরকার যদি আগের মতোই ছলে-বলে-কলে নির্বাচন সম্পন্ন করে, তাহলেও তারা ক্ষমতায় টিকতে পারবে না বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন। ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে ভুট্টোর ‘পিপিপি’ বোগাস নির্বাচন করেও ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিস্ফোরণোন্মুখ জনগোষ্ঠীকে গণঅভ্যুত্থানে ধাবিত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে গুজবই সংবাদ হয়ে দাঁড়ায়। হাওয়া থেকে পাওয়া অনেক খবর আছে। একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ সেদিন একান্ত আলাপচারিতায় বলছিলেন, এবারের নির্বাচন হবে ঘোষণানির্ভর। অর্থাৎ ইলেকশন বাই ডিক্লারেশন। ইলেকশনের রকমফের নামে এরশাদ আমলে একটি কলাম লিখেছিলাম। গল্পটি এরকম : জাতীয় পার্টির একজন বড় নেতা বলেছিলেন এটি। ইলেকশন তিন প্রকার- ১. ইলেকশন বাই ইলেকশন (প্রকৃত নির্বাচন); ২. ইলেকশন বাই কালেকশন, অর্থাৎ গুণ্ডাপাণ্ডা দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখলপূর্বক ফলাফল নির্ণয় ও ৩. ইলেকশন বাই ডিক্লারেশন। ফলাফল যাই হোক না কেন, অবশেষে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক নির্দেশিত ব্যক্তিকে নির্বাচিত ঘোষণা। গল্পটি গল্প নয়, আসলে বাস্তব।

ফরিদপুরের এক নির্বাচনী এলাকায় পাতানো নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা পার্টির বিজয়ী হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী ভোট কালেকশনও করা হয়েছে। কিন্তু রিটার্নিং অফিসার ডিসি ফলাফল ঘোষণা করছেন না। ডিসিকে চাপ দেয়ার পর তিনি বললেন, উপরে যোগাযোগ করুন। জাতীয় পার্টির ফরিদপুর জেলার সভাপতি প্রেসিডেন্ট এরশাদকে ফোন করলেন। উল্লেখ্য যে, পার্টি সভাপতি ছিলেন ওই মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীর আপন ভাই। প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে বললেন, ওটা এমজের ব্যাপার। আমি হস্তক্ষেপ করব না। এমজে মানে মেজর জেনারেল মোহাব্বতজান চৌধুরী। প্রেসিডেন্ট এরশাদ মোহাব্বতজানকে যথেষ্ট মোহাব্বত করতেন। তাই আদর করে এমজে বলতেন। যাই হোক অবশেষে, সেখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ সেখানে এমনিতেই ‘ইলেকশন বাই ইলেকশন’ পরিত্যক্ত। ইলেকশন বাই কালেকশন পরাজিত। ইলেকশন বাই ডিক্লারেশন অবশেষে বিজয়ী। গল্পটি বললাম এ কারণে যে, ২০২৪ সালের সমাগত নির্বাচনটিও এমন হতে পারে।

দৃশ্যমানভাবে নির্বাচনটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হবে। অবশেষে পালটে যাবে ফলাফল। বলা যায়, ‘উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’। এরকম গল্পের ফানুস উড়ছে। সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি, জরুরি অবস্থা ও উত্তর বাড়িতে ক্ষমতা হস্তান্তর ইত্যাদি গুজব শোনা যাচ্ছে। তবে রাজনীতিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে এটি বুঝি যে, সব কিছু নির্ভর করছে আহূত গণআন্দোলনের ঘনত্বের ওপর। বিএনপি সূচিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যদি তীব্রতা অর্জন করে তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এমনকি ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজনপূর্বক বিদায় হওয়াটাও অসম্ভব নয়। তার কারণ ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার জন্য না করতে পারে এমন কিছু নেই। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সংযোজিত থাকলে তারা কোনো না কোনো সময় আবার ক্ষমতাসীন হতে পারে। যেমন ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অভাবিত পরাজয়ের পর ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির দূরত্বের সুযোগে তারা ক্ষমতাসীন হয়। আর তা না হলে তাদের অবস্থা হতো আজকের মুসলিম লীগের মতো।

সমাগত নির্বাচনী সঙ্কট উত্তরণে নানা মুনি নানা মত দিচ্ছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আগে থেকেই তত্ত্বাবধায়ক ধরনের নির্বাচনী সরকারের কথা বলে আসছে। এখন তারা ক্ষমাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার দৃঢ় সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছে। প্রায় সব বিরোধীদল প্রায় একই সুরে কথা বলছে। একটি তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে, নির্বাচনই হতে দেয়া হবে না বলে তারা হুঙ্কার দিচ্ছে। এই হুঙ্কার তখনই বাস্তব হবে যখন একটি সফল গণআন্দোলন ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দিতে পারবে। বিরোধী শক্তি এখন একটি সুবিধাজনক সময়ে অবস্থান করছে। বিএনপির নেতৃত্বে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনটি সফলভাবে এগিয়ে এসেছে তা একটি সাংবিধানিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার কাছাকাছি অবস্থান করছে। আন্দোলনের গতি যদি তীব্রতর হয়ে নির্বাচনের কাছাকাছি পৌঁছায় তা দু’টি সুবিধা পাবে- ক. দুর্বল সরকার ও খ. সাংবিধানিক পরিবর্তন। দুটো মিলে যদি একদফা ও এক দাবিতে পরিণত হয় তা হলে সরকার পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠবে।

নির্বাচনকালীন সরকারের পাশাপাশি কতিপয় রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব জাতীয় সরকার এর কথা বলছেন। ডাক্তার জাফরুল্লাহ ছিলেন জাতীয় সরকারের একজন শক্ত প্রবক্তা। তিনি জাতীয় সংস্কারের জন্য বেশি সময়ে জাতীয় সরকারের কথা বলছিলেন। তার প্রস্তাবিত জাতীয় সরকার রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অনিবার্য কিছু পরিবর্তনের পরে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বিদায় নেবে। গণফোরামসহ বাম ধারার রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সদস্যরা এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে আসছেন। অপরদিকে দেশে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় সরকারের কথা বলছে। তাদের জাতীয় সরকার গঠিত হবে জাতীয় নির্বাচনের পর। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রদত্ত এ ফর্মুলা অনুযায়ী, যে সব দল গণআন্দোলনের মধ্যমে সরকার পরিবর্তনে ভ‚মিকা রাখবে তারা নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্বিশেষে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারে শামিল থাকবে। জাতীয় সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামতের কাজটি তারাই সম্পন্ন করবে। তারা কিন্তু নির্বাচন-পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার প্রস্তাবনায়ও কঠিন অবস্থানে রয়েছে। তা আগেই বলা হয়েছে। তা হলে বলা যায়, বিএনপি নির্বাচন পূর্বাপর নিরপেক্ষ সরকার বা জাতীয় সরকারব্যবস্থার পক্ষে রয়েছে।

অতিসাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি জাতীয় সরকার প্রস্তাবনা পেশ করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর মাওলানা রেজাউল করিম। তার প্রস্তাবনা মোতাবেক নির্বাচনের আগে তিন মাসের জন্য শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারে। তার এই প্রস্তাবটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিপূরক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচারপতিদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যে বিচারবিভাগীয় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এটি তার অবসান ঘটাবে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যে গুরুতর বিরোধিতা রয়েছে তারও খানিকটা উপশম করবে। তার কারণ, জাতীয় সরকারে আওয়ামী লীগেরও প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারবে। আবারো সেই একই কথা, গণআন্দোলনটি যদি আওয়ামী লীগ রক্তপাতের মাধ্যমে মোকাবেলা না করে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে তা হলে তার সুযোগ থাকবে। শক্তি প্রয়োগের মধ্যমে সমাধান খুঁজলে শক্তিই তাদের নিঃশেষ করে দেবে। চরমোনাই পীর সাহেবের প্রস্তাবটির আরো ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পীর সাহেব প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারের প্রধান কিভাবে নির্র্ণিত হবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে কোনো সরকার গঠন অসম্ভব বিষয়। তারা অবশ্য নিবন্ধনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলছে। এ দেশে ৪০টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত রয়েছে। আরো কিছু দল নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে। পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব ছিল এমন সিদ্ধান্ত নিলে চরমোনাইয়ের নেতৃত্বাধীন দলটি বাদ পড়বে।

প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ের কথা যদি বলা হয় তা হলে ‘প্রধান প্রধান’-এর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক হবে। তবে সমঝোতার মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য সমাধানে পৌঁছা সম্ভব। সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব তথা সিভিল সোসাইটি যদি একটি সম্মত ফর্মুলা গ্রহণ করতে পারে, তা হলে যে নামেই ডাকা হোক নির্বাচনপূর্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচনকালীন সরকার অথবা জাতীয় সরকার অর্জন অবশ্যই সম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement