২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেষশাবক ও নেকড়ে বাঘের গল্প অতঃপর...

মেষশাবক ও নেকড়ে বাঘের গল্প অতঃপর... - ছবি : সংগৃহীত

‘একদা একটি মেষশাবক ঝরনায় পানি পান করছিল। ঝরনার অপর প্রান্তে একটি নেকড়ে বাঘও পানি পান করছিল। মেষশাবকটি দেখতে বেশ নাদুসনুদুস। এ দেখে নেকড়ে বাঘের লোভ হলো। সে মেষশাবককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে মনস্থির করল। কী অজুহাতে মেষশাবকটির ঘাড় মটকানো যায়, নেকড়ে তা ভাবছিল। অবশেষে তার মাথায় বুদ্ধি এলো। সে কূটকৌশল আঁটল। সে মেষশাবককে রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোর এত সাহস। আমার পানি ঘোলা করছিস। সেই পানি আমি পান করছি। মেষশাবক নেকড়েকে দেখে আগেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সে কম্পিত ভীতু কণ্ঠে বলল, মহাশয় আমি তো আপনার নিচু প্রবাহে পানি পান করছি। আপনার থেকে আসা পানিই আমি পান করছি। এ কথায় নেকড়ে ভাবল, সে যুক্তি তো আর কাজে খাটছে না। তখন সে সুর পাল্টাল। রাগতস্বরে বলল, তুই গত বছর আমার পানি ঘোলা করেছিলি। তখন মেষশাবক উত্তর করল, আমার বয়স তো এক বছর হয়নি। তখন নেকড়ে বলল, তুই পানি ঘোলা করে না থাকলে তোর বাপ তা করেছিল।’

গল্পের বাকি অংশ পাঠকের বুঝতে বাকি নেই, কোনো যুক্তিতে না টিকতে পেরে নেকড়েটি মেষশাবকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঈশপের এ গল্পটি বেশ বিখ্যাত। ইংরেজিতে গল্পটির শিরোনাম ‘ Wolf on the lamb’ গল্প অবশেষে শিক্ষা হলো ‘খলের ছলের অভাব হয় না’। আসলে নেকড়ে বাঘটি মেষশাবকটিকে খাবে। সে অজুহাত খুঁজছিল। কোনো অজুহাতই যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন সে যুক্তির আবেদন অগ্রাহ্য করে মেষশাবকটিকে হত্যা করল।

বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে গল্পটির অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সেকালে ও একালে। প্রথম আলোর প্রতিবেদককে নিয়ে গত সপ্তাহের ঘটনাবলি এ ধরনের সর্বশেষ ঘটনা। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে প্রকাশ : সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে তার সাভারের বাসা থেকে তুলে নেয়া হয় ২৯ মার্চ রাত ৪টায়। এর ১০ ঘণ্টা পর বেলা ২টার দিকে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি মামলা হয়েছে। সেই মামলার বাদি ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া। তিনি যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক বলে জানা গেছে। থানায় অভিযুক্ত হওয়া এজাহার অনুযায়ী, ২৮ মার্চ দিবাগত রাত সোয়া ২টায় মামলাটি হয়েছে। অর্থাৎ এর পৌনে দুই ঘণ্টার মাথায় তেজগাঁও থানা থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আমবাগান এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে শামসুজ্জামানকে তুলে নেয়া হয়।

উল্লেখ্য, ২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি কার্ড তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ছবি দেয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট দেয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসঙ্গতিটি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে, উক্তিটি ওই শিশুর; বরং উক্তিটি বলা হয়েছে দিনমজুর জাকির হোসেনের। গ্রেফতারের সময় সাদা পোশাকের পুলিশ তাদের পরিচয় দেয়। অথচ পরবর্তীকালে পুলিশের বিভিন্ন ব্রাঞ্চে যখন তার জন্য খোঁজাখুঁজি করা হয়, তখন কেউ কিছু জানে না এমন তথ্য দেয়া হয়। বাংলাদেশে নিকট অতীতে এরকম গুমের (Forced Disappearance) অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গতভাবেই পরিবার ও সংশ্লিষ্ট মহল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। শামসুজ্জামান ভাগ্যবান এই কারণে যে, তুলে নেয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সৌভাগ্যবশত তাকে ‘বন্দুকযুদ্ধের মোকাবেলা’ করতে হয়নি। ‘আয়না ঘরে’ তাকে পাঠানো হয়নি।

পর্যবেক্ষক মহল মন্তব্য করে, তাকে আসলে হজম করা সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, তুলে নেয়ার পর ২০ ঘণ্টা শামসুজ্জামান কোথায় ছিলেন- এ বিষয়ে পুলিশ কোনো তথ্য দেয়নি। এমনকি তাকে কারা তুলে নিয়েছিল সে বিষয়েও থানা পুলিশ বা সিআইডির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মজার বিষয়, সাভার থেকে গ্রেফতার করা হলেও সিআইডি আদালতে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। তাদের দাবি, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানোর পরে বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের আশপাশ এলাকা থেকে শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিআইডির এই বক্তব্য অতীতের গুম বা অপহরণের ঘটনার সাথে মিলে যায়। বোঝা যায়, সরকারের ভেতরও সরকার আছে। অথবা এমন কোনো রহস্যময় শক্তি আছে যারা সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথবা সরকার জেনেশোনে বিষ পান করছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির খানিকটা উত্তপ্ত সময়ে এই ঘটনা ঘটল। বিস্ময়ের ব্যাপার, সামান্য ঘটনাটি অসামান্য বিষয়ে পরিণত হলো। কারণ শুধু প্রথম আলোই নয়, পরিপাশ্বের ঘটনাবলি। ভেতরে যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন একটি প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকারের প্রশ্নে সরকার যখন হেস্তনেস্ত হচ্ছে, তখন ঘটনাটি আগুনে ঘি ঢেলেছে। আন্তর্জাতিক জোট ও সংগঠনগুলো তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সবাই বলেছে, এ ঘটনা প্রমাণ করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আসলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নির্মূল করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সমাজ কিভাবে আলোড়িত হয়েছে তার প্রমাণ জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনপ্রধানের বিবৃতি। কমিশনপ্রধান ফলকার টুর্ক তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি পুনরায় কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিলম্বে এর প্রয়োগ স্থগিত এবং আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর ধারাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’

এই সংশোধনী আনতে সহযোগিতার লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে বিস্তারিত পরামর্শ পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফলকার টুর্ক। দেশের সিভিল সোসাইটিও তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ডিজিটাল আইনের প্রয়োগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরো সঙ্কুচিত হবে। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মন্তব্য করেন, এতে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। আইনজীবী শাহদীন মালিক মতামত দেন, গণতন্ত্রে ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ বলে কোনো অপরাধ নেই। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনকে স্বাধীন চিন্তার ওপর ‘খড়গ’ বলে অভিহিত করেন।

সামাজিক লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনগত লড়াই অব্যাহত রাখে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ। সম্পাদক মতিউর রহমান আগাম জামিন পেয়েছেন। উল্লেখ্য, ওই মামলায় সম্পাদক হিসেবে মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়। তার করা আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় সপ্তাহের জন্য তাকে জামিন দেন। অপরদিকে কথিত আসামি শামসুজ্জামান পাঁচ দিন পর জামিনে কারামুক্ত হন। শামসুজ্জামানের আকস্মিক গ্রেফতার, মামলা ও অবশেষে জামিন লাভকে একটি নাটকীয় ঘটনা বলছেন অনেকে। সরকার ও প্রথম আলোর দ্বন্দ্ব সেই এক-এগারো থেকে। সরকার পক্ষ তথা আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে, ওই সময়কালে প্রথম আলো আওয়ামী লীগের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল। এ নিয়ে সরকারপ্রধানের অভিযোগ ছিল একরকম প্রকাশ্য। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, দেশে ও দেশের বাইরে একাধিকবার এই বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ নীতিগতভাবে কোনো আপস না করায় সমঝোতা টিকেনি, বরং বিরোধ বেড়েছে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে গণআন্দোলন যত জোরালো হচ্ছে বিরোধ ততই তীব্রতর হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি এবং প্রথম আলোকে সম্পূরক বলে মন্তব্য করেছেন।

পর্যবেক্ষক মহল খবর দিচ্ছে, এর আগেও প্রথম আলো প্রধানকে পাকড়াও করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু অনুরোধ, উপরোধ ও দেশ-বিদেশের চাপে তা সম্ভব হয়নি। এবারে যখন ক্ষমতাসীন সরকার সম্ভবত একটি বড় ধরনের গণআন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছে এবং বড় ধরনের ক‚টনৈতিক চাপ অনুভব করছে, তখন প্রথম আলোর মতো জনপ্রিয় পত্রিকা যেটি আন্দোলনকে প্রকারান্তরে সমর্থন করছে তাকে বাগে আনার কসরত করছে। কিন্তু আগের এক-দুবারের মতো দৃশ্যত মনে হচ্ছে সরকারের সেই আশা সেভাবে সফল নাও হতে পারে। তবে সরকার ও পত্রিকাটির মধ্যে এক ধরনের সহযোগিতার সম্পর্কও রয়েছে। যা বর্তমান সরকারের ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে সহজ করেছে। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে বিভিন্ন সময় কাজে এসেছে।

যাই হোক মামলা অব্যাহত রয়েছে, কোর্ট পত্রিকার সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক উভয়কে জামিন দিয়েছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও অধীনতা বিষয়ে নাগরিক সাধারণের ধারণা রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সরকারের জন্য বিষয়টি বুমেরাং হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের প্রান্তিক অবস্থানের কারণে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। ঘা মেরে যখন কিছুই করা গেল না, তখন রসিকজন মন্তব্য করেন, ‘সেই তো নথ খসালি-তবে কেন লোক হাসালি।’

লেখক : অধ্যাপক, (অব:) সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement