২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সংবাদপত্র দলন ও প্রথম আলো

সংবাদপত্র দলন ও প্রথম আলো। - ছবি : সংগৃহীত

দেশে এখন অনেক পত্র-পত্রিকা। ছোট বড় মাঝারি আন্ডারগ্রাউন্ড মিলিয়ে দৈনিক পত্রিকাও প্রচুর। প্রতিটি দৈনিকের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান আছে। কেউ বাংলাদেশি, কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। কেউ ইসলামী, কেউ সমাজতান্ত্রিক আদর্শে জনমত গঠনে নিবেদিত। প্রত্যেকের সম্পাদকীয় নীতি নিজস্ব। এতসব বৈপরীত্যের পরও আমরা পরস্পরকে সাধারণভাবে সহযোগী বলতে অভ্যস্ত। বৈরী বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। এর কারণ, আমরা সব পত্রিকা মিলে একটি আকাক্সক্ষার অনুকূলে সব সময় কাজ করি। সে আকাক্সক্ষা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি একটি সুস্থ সুন্দর গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাওয়ার- যেখানে প্রতিটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হবে নিরঙ্কুশ এবং প্রত্যেকে অবাধে কথা বলা, মতামত প্রচার এবং নিজ আদর্শের পক্ষে জনমত গঠনের সমান সুযোগ পাবেন।

এই কাজটি করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক দৈনিক বা তার সম্পাদক বা সাংবাদিককে সরকারের রোষে পড়তে হয়েছে, কোনো কোনো পত্রিকা ও টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সম্পাদক বা সাংবাদিককে হেনস্থা থেকে শুরু করে রক্তাক্ত হতে হয়েছে, মামলা-মোকদ্দমা ও জেল-জুলুমের শিকারও হয়েছেন অনেকে। সব ঘটনার ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পত্রিকা অথবা টেলিভিশন চ্যানেলটি সাংবাদিকতার নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করেছে বা আইনের দিক থেকে দোষী ছিল এমন নয়। কিন্তু কোনো একটি ক্ষেত্রেই আমরা, সাংবাদিকরা হেনস্থা ও হয়রানির শিকার গণমাধ্যমের প্রতি সহযোগীর মনোভাব দেখাতে পারিনি। পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা। কেউ কেউ বিবৃতি দিয়ে দায় সেরেছেন, কেউ বা মানববন্ধনে শামিল হয়ে ছবি তুলেছেন। বেশির ভাগই স্পিকটি নট থেকেছেন।

দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করা হয়েছে বেআইনিভাবে। এর সম্পাদককে শত শত মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে রেকর্ড মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন। কিন্তু সেটি দেয়া হয় প্রতারণা ও সম্পদের হিসাব সম্পর্কিত মামলায়। আর এসব মামলার পেছনে সত্য প্রকাশে সম্পাদকের পরোয়াহীন আচরণই যে অন্যতম কারণ সেটি সম্ভবত অস্বীকার করা যাবে না।

একটি দৈনিক পত্রিকা সরকারের বা মহলবিশেষের তোপের মুখে পড়লে সহযোগী অন্য পত্রিকাগুলো বা সাংবাদিকরা মুখ বন্ধ রাখেন। আমাদের দেশে সচরাচর এমনটাই দেখে এসেছি। শুধু মুখ বন্ধ রাখাই দস্তুর তাও কিন্তু না। কখনো কাউকে মুখ টিপে হাসতেও দেখা গেছে। বিশেষ করে গত প্রায় ১৫ বছরের বাংলাদেশে বহুবার এই প্র্যাকটিস প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। আমার দেশ, ইসলামী টেলিভিশন, দিগন্ত টেলিভিশন জ্বলন্ত উদাহরণ।

এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় দৈনিক প্রথম আলো সরকার ও সরকারি দলের রোষের শিকার। কথিত প্রগতিশীলতার ধারক এই পত্রিকাটির ভ‚মিকা নিয়ে অনেক মহলেরই ভিন্ন ভিন্ন কারণে অপছন্দ আছে, এমনকি অসন্তোষও। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যারা করেন তাদেরও যে গণতান্ত্রিক সমঅধিকার আছে এই দৈনিকটি তা স্বীকার করে বলে মনে হয় না। ধর্মীয় রাজনীতিমাত্রই জঙ্গিবাদ, কট্টরপন্থা এবং পশ্চাৎমুখী তথা অন্ধকারের দিকে যাত্রা এমন একটি প্রচারণা তাদের বহু রিপোর্ট ও নিবন্ধে স্পষ্ট। এমনকি বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর জবান থেকে মুসলিম পরিভাষা সযত্নে পরিহারের নেতিবাচক প্রবণতা দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট। এমনকি ফান ম্যাগাজিনে ধর্ম অবমাননার সুযোগও তারা হাতছাড়া করেনি। শুধু তাই নয়, গত ১৫ বছরে এই পত্রিকাটি আদতে নানা কৌশলে বর্তমান সরকারের শাসন দীর্ঘায়িত করার পক্ষেই ভূমিকা রেখেছে। সরকারি দলের নেতারা সেটি বোঝেন না এমন নয়। কিন্তু পত্রিকাটিকে তারা যে, এই সুযোগে একহাত দেখে নিচ্ছেন তার পেছনে ভিন্ন কারণ আছে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে নিই, প্রথম আলো অদরকারি শব্দ যোগ করে উদ্ভট বাক্য গঠনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও গতিও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। বড় পত্রিকা বলে তাদের ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বল ও বিকৃত ভাষারীতির প্রভাব পড়ছে অন্য সব পত্রিকার ওপর। এতে করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ভাষা সাবলীলতা হারাচ্ছে। সেই উদাহরণ দিয়ে আলোচনা ভিন্ন দিকে নেয়ার সুযোগ নেই। ভাষাসচেতন যে কেউ একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন।

আমাদের প্রথম আলো প্রসঙ্গে উপসম্পাদকীয় লেখার কথা নয়। কিন্তু ভব্যতার এতটুকু বোধ আমাদের আছে যে, অন্যের দুঃসময়ে অন্তত মুখ টিপে হাসার কথা ভাবতে পারি না। তার চেয়েও বড় কথা বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিত আমাদেরকে এমন একটি মহাক্রান্তির কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যেখানে সহযোগী কাউকেই এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। কথাটি স্পষ্ট করতে একটু সবিস্তারে বলি।

প্রায় ১৫ বছর ধরে দেশে আওয়ামী লীগের শাসন চলছে। কেউ দুঃশাসন, অপশাসন, স্বৈরশাসন এবং আরো নানা নামে অভিহিত করতেই পারেন, তাতে শাসনের চরিত্রের ইতরবিশেষ হয় না। এই শাসন জাতির জন্য কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। অর্থনীতি ডুবন্ত জাহাজের মতো নিয়ন্ত্রণহীন। সাংবিধানিক অধিকারের প্রতিটি ক্ষেত্র অস্বীকৃত। নীতি-নৈতিকতা, সততা, মূল্যবোধ, সৌজন্য, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সর্বোপরি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা অপসৃত। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, লুটপাট বিধ্বংসী পর্যায়ে উপনীত। সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে অযোগ্য, অদক্ষ, অথর্ব দলীয় অনুগত লোকদের নিয়োগে পুরো দেশ স্থায়ীভাবে অচল হওয়ার উপক্রম। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান এমনকি বিচারাঙ্গনের মতো রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভও এই ক্ষয়ের কবলমুক্ত নয়। সম্প্রতি একটি জেলা আদালতে বিচারক ও আইনজীবীদের নজিরবিহীন দ্ব›দ্ব এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন ঘিরে সঙ্ঘটিত ঘটনাবলি স্মরণ করুন। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যেসব কেলেঙ্কারি ঘটেছে সেসব না হয় উহ্যই থাকুক। মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে দেশ যে এক ভয়ঙ্কর খাদের প্রান্তে সচেতন মানুষের তা অজানা নয়।

এমনই এক সময়ে গোটা জাতির একটিই আকাক্সক্ষা। দুঃসহ পরিস্থিতির আশু অবসান। এই আকাক্সক্ষা পূরণের একমাত্র বৈধ উপায় একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এখন পর্যন্ত সেরকম পরিবেশ আছে বলে কেউ মনে করেন না। সরকার সে পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচন করবে এটি আওয়ামী লীগের বাইরে আর কাউকে ‘ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে’ বললেও মনে হয় না বিশ্বাস করানো যাবে। কিন্তু কাজটি করতেই হবে এবং বিরোধী দলগুলোর জোরালো আন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করেই করতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই।

এই জনআকাক্সক্ষার পক্ষে যারাই থাকবেন- হতে পারে গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন- তাদের সবারই কাঁধে কাঁধ মেলানো এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। আমরা স্মরণ করতে পারি, এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তথাকথিত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে বাম-ডান সবাই শামিল হয়েছিল। তাতে কারো জাত যায়নি। যদিও খালেদা জিয়ার সরকার দেশের জন্য ক্ষতির কারণ তো নয়ই; বরং গত ৫১ বছরের সেরা গণতান্ত্রিক ও গঠনমূলক সরকার ছিল বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ইরানের দৃষ্টান্তও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। ইসলামী বিপ্লবের ডাকে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব বামপন্থী ইমাম খোমেনির সাথে শামিল হয়েছিলেন। কারণ তাদের অভিন্ন প্রতিপক্ষ ছিল শাহের নিপীড়ক রাজতন্ত্র।

প্রথম আলো যে সংবাদ আইটেমের জন্য তোপের মুখে পড়েছে আমরা সেটিকে কোনোভাবেই ‘দায়িত্বহীন ও অপেশাদার সাংবাদিকতার’ দৃষ্টান্ত মনে করি না। সবুজ নামের ফুল বিক্রেতা একটি শিশুর ছবির সাথে দিনমজুর জাকির হোসেনের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে চিত্রসংবাদ প্রকাশ কোনোভাবেই ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করার কারণ অন্তত আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। যেমনটি আওয়ামী লীগের নেতারা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বা জাতীয় প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ দেখতে পেয়েছেন।

আমরা মনে করি, প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকারের খড়গহস্ত হওয়ার সাথে আগামী নির্বাচনের একটি সম্পর্ক আছে। ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে ওয়ান-ইলেভেন ঘটানোর পেছনে কারা কীভাবে সক্রিয় ছিল সরকারের তা অজানা নয়। একই মহল (চক্রও বলতে পারেন) আগামী নির্বাচনের আগে সেই একই নাটকের কুশীলব হয়ে উঠবে না সেটি নিশ্চিত করার তাগিদ সরকারের মধ্যে আছে। প্রথম আলো বন্ধ বা দুর্বল হলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত-প্রকাশের স্বাধীনতা সব জলে যাবে বলে যারা হা-হুতাশ করছেন তাদের আহাজারি বাস্তবতার বাইরে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা এ ধরনের আরো যেসব কালাকানুন বলবৎ আছে সেগুলো ওই কাজটি আগেই করে দিয়েছে। এখন আলোচ্য পত্রিকাটিকে দুর্বল করা সম্ভব হলে তারা নিজ অস্তিত্বের স্বার্থে হয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হবে অথবা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। যদি দ্বিতীয়টি ঘটে তাহলে সন্দেহ নেই সরকার আরো গুরুতর ব্যবস্থার দিকে যাবে।

আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন বা ইসলামিক টেলিভিশন সরকারের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধও গড়তে পারেনি। কিন্তু প্রথম আলো এক ধরনের প্রতিরোধ এরই মধ্যে গড়ে তুলেছে। তাদের প্রচারণার কৌশল অনেকটাই আগ্রাসী এবং দেশ-বিদেশের গণতান্ত্রিক মহলের সমর্থনও তারা পাচ্ছে। যদি এই লড়াইয়ে প্রথম আলো কোনোভাবে সাম্যাবস্থাও বজায় রাখতে পারে, নিঃসন্দেহে সেটি হবে পত্রিকাটির জন্য খুব বড় ঘটনা। কারণ তাতে করে সরকারই উল্টো চাপে পড়বে। আগামী নির্বাচনের আগে একটি সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের ধামাধরা দু’-একটি প্রতিষ্ঠার ছাড়া সব গণমাধ্যমের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা জরুরি। জরুরি দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার স্বার্থে। যদিও এই বাস্তবতা প্রথম আলো বুঝবে এমন আশা করাই বাতুলতা। কারণ বাংলাদেশে বামদের ইতিহাস আওয়ামী লীগের পা-চাটারই ইতিহাস।

সবশেষে একটি বিখ্যাত কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাই। কবিতাটি তুলে দিচ্ছি সাধারণ পাঠকের জন্য। এই আশায় যে এ থেকে কেউ হয়তো নিজের করণীয় বুঝে নিতে পারবেন।

জার্মান কবি মার্টিন নিম্যোলারের (১৮৯২-১৯৮৪) কবিতার নাম ‘ফার্স্ট দে কেম’ বাংলায় বলা যায়, যখন তারা প্রথম এলো :
‘যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে, আমি তখনো চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও এলো ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।’
শেষে একটি প্রশ্ন: আপনার আমার বিপদে কথা বলার মতো বাংলাদেশে কেউ কি এখন সত্যি আছে?
mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement