২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নির্বাচনী রাজনীতিতে কূটনীতির উত্তাপ

নির্বাচনী রাজনীতিতে কূটনীতির উত্তাপ। - ছবি : সংগৃহীত

বিগত এক বছরের বিদেশীদের কর্মকাণ্ড অনুসরণ করলে বোঝা যায় আমাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে কূটনীতিকরা উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। গত ২০-০৫-২০২২ ব্রাসেলসে বাংলাদেশ ও ‘ইইউ’-এর যৌথ কমিশনের দশম বৈঠকে ‘ইইউ’-এর বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা প্যাম্পোলোনি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন (প্রথম আলো : ২১/০৫/২০২২)।

ওই মাসেই ২৬ তারিখে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন (নয়া দিগন্ত : ২৭/০৫/২০২২)। এরপর ৩১ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব)-এর ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে পিটার হাস আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন (প্রথম আলো : ০১/০৬/২০২২)।

জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিও ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে প্রেস ক্লাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নেবে বলে জাপান সরকারের আশাবাদ ব্যক্ত করেন (প্রথম আলো : ০১/০৬/২০২২)। পিটার হাস এরপর ৮ জুন নির্বাচন ভবনে ‘সিইসি’ কাজী হাবিবুল আউয়ালের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে (নয়া দিগন্ত : ০৯/০৬/২০২২)।

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী ৩৮ দেশের সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর ১৪টি দেশের প্রতিনিধিরা গত ৩ জুলাই নির্বাচন ভবনে ‘সিইসির’ সাথে বৈঠক শেষে বলেন, তারা দেখতে চান, জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হবে (নয়া দিগন্ত : ০৪/০৭/২০২২)।

যুক্তরাষ্ট্রের Integrated Country Strategy (ICS) গত জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার সম্পর্কের বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে যে, বাংলাদেশ যদি ক্রমবর্ধমানশীল কর্তৃত্ববাদী সরকার গণতন্ত্রের পরিসরকে সঙ্কীর্ণ করতে থাকে তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি ‘আইপিএসে’র লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হলেও দুই দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে (ডেইলি স্টার : ০৭/০৭/২০২২)। এরই মধ্যে গত ৫ জুলাই মার্কিন দূতাবাসের ভেরিফাইড ফেসবুকে এক পোস্টে বলা হয়, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের নেতা নির্বাচন করবে বলে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশা করে (নয়া দিগন্ত : ১৫/০৭/২০২২)। একই সময়ে ঢাকায় জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস এবং ‘ইইউ’-এর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী নির্বাচন নিয়েও আলোচনা হয় বলে জানা যায় (প্রাগুক্ত)। গত ১৯ জুলাই ব্রাসেলসে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা (নয়া দিগন্ত : ৩১/০৭/২০২২)।


মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ১০ আগস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ইউএসএইড’ এবং ‘ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনাল’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন (নয়া দিগন্ত : ১১/০৮/২০২২)। বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘও এ সময় মুখ খোলা শুরু করে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত প্রধান নাদা আল নাহসিফ বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সরকারের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ’ (নয়া দিগন্ত : ১১/০৮/২০২২)। ১৫ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত ‘ইইউ’ রাষ্ট্রদূতরা টুইটারে এক অভিন্ন বার্তায় জানান যে, বাংলাদেশে নির্বাচনের জন্য অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন (নয়া দিগন্ত : ১৬/০৯/২০২২)। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে ‘আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ’ আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজ সভায় রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন (প্রথম আলো : ২৯/০৯/২০২২)। দেখা যায়, যুক্তরাজ্যও এই নির্বাচন বিতর্কে সরব হয়েছে। গত ৩ অক্টোবর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন শেষে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি (নয়া দিগন্ত : ০৪/১০/২০২২)। এর মধ্যে আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে ওয়াশিংটনে গত ৮ অক্টোবর মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি আর শ্যারম্যান এক বৈঠকে মানবাধিকার উন্নয়ন এবং সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন (নয়া দিগন্ত : ০৯/১০/২০২২)। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী গত ১০ অক্টোবর বলেন, ‘সাম্প্রতিক এসব রাজনৈতিক হামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঘিরে এক অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে।’

সংস্থাটির পক্ষ থেকে গত ২২ আগস্ট শুরু হওয়া বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে (প্রথম আলো: ১১/১০/২০২২)। ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন গত ১৭ অক্টোবর সিলেটে পুনরায় বলেন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ (নয়া দিগন্ত : ১৮/১০/২০২২)। প্রয়াত মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এমটেড কেনেডির ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়র গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আট দিনের সফরে বাংলাদেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্মারক বক্তৃতায় বলেন, তার বাবা ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন। একটি দলকে ঘিরে রাজনৈতিক ক্ষমতা আবর্তিত হওয়ার বিষয়ে তার বাবার উদ্বেগ ছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য তারা বাবা এটিকে মঙ্গলজনক মনে করতেন না (প্রথম আলো : ০১/১১/২০২২)। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার গত ৬ নভেম্বর ঢাকায় এক সংক্ষিপ্ত সফরে এসে বলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র (প্রথম আলো : ০৭/১১/২০২২)। গত ৮ নভেম্বর সম্পাদক পরিষদের সভায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সব সংস্থাকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে (প্রথম আলো : ০৯/১১/২০২২)। একই দিনে বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেন, ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি আমাদের কাজেরই অংশ। তবে বাংলাদেশের নির্বাচনে জড়িত হওয়ার এখতিয়ার এই মুহূর্তে জাতিসংঘের নেই’ (প্রাগুক্ত)। তবে তিনি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওদিকে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, আমরা আশা করি, নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সরকার বেছে নিতে পারবেন। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এই লক্ষ্যের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে (প্রাগুক্ত)। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ঢাকায় একটি মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির যে ঘটনা শুনেছিলাম, কখনোই যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়’ (প্রথম আলো : ১৫/১১/২০২২)। এমনকি তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের অংশগ্রহণের শর্তের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি গত ১৬ নভেম্বর ঢাকায় একটি মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন (ডেইলি স্টার : ১৭/১১/২০২২)।

পশ্চিমাদের এসব কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ওপর এক ধরনের প্রভাব সৃষ্টির মধ্যেই বিএনপি ১০ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টনে মহা সমাবেশ ডাকে। এই সমাবেশ নিয়ে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর উদ্বেগ দেখা দেয় এবং বিরোধীদের উপর দমন-পীড়নের খড়গ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর আগে গত ৩০ নভেম্বর সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিসট্যান্স’ (IDEA) বাংলাদেশকে কর্তৃত্ববাদী দেশের তালিকাভুক্ত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে (প্রথম আলো : ০১/১২/২০২২)। এরপর ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ১৪টি দেশের বাংলাদেশ মিশন (দূতাবাস) ও ঢাকার ‘ইইউ’ কার্যালয় মানবাধিকার দিবস (১০ ডিসেম্বর) উপলক্ষে যৌথ বিবৃতি দেয়। তারা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করছি (প্রথম আলো : ০৭/১২/২০২২)।

ইতোমধ্যে ৭ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির নয়াপল্টন অফিসে রেইড করলে একজন নিহত হয় এবং অনেকেই আহত ও গ্রেফতার হয়। এতে জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমারা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ওয়াশিংটনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্পোক্সম্যান নেড প্রাইস বাংলাদেশ সরকারকে কোন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তা ছাড়া উক্ত সহিংসতার ঘটনার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদেরকে আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন (ডেইলি স্টার : ০৮/১২/২০২২)।

ওই ঘটনা ঘটার এক ঘণ্টা পর ঢাকায় জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধি উইন লুইস মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে অঙ্গীকারের কথা বাংলাদেশকে স্মরণ করিয়ে দেন। পরদিন জাতিসঙ্ঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ক্লেমেন্ট ভউল বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের খবরে উদ্বেগ জানান (প্রথম আলো : ০৯/১২/২০২২)।

৮ ডিসেম্বর আবার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ফেসবুক পোস্টে সহিংসতার সুষ্ঠু তদন্ত এবং মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় (নয়া দিগন্ত : ০৯/১২/২০২২)। এরপর ৯ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা মুখপাত্র জন কিরবি বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচনী সহিংসতার পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান জানান (নয়া দিগন্ত : ১১/১২/২০২২)। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলীও বিরোধীদের ওপর নৃশংস ক্র্যাকডাউন বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানান (প্রাগুক্ত)। একই দিনে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারেক বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিক্ষোভকারী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান (প্রাগুক্ত)। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রথমবারের মতো কথা বলেন সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড। ঢাকায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সাথে সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, তাদের গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যাল হলো বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে বলে তার দেশ আশা করছে (নয়া দিগন্ত : ১১/০১/২০২৩)।

নির্বাচনী বছরের শুরুতে পশ্চিমাদের দৌড়ঝাঁপ আরো বেড়ে গেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। গত ১০ জানুয়ারি চার দিনের সফর শেষ করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক ইলিন লাউবাচার। তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার, সরকার পরিচালনা ও নিরাপত্তা বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব, নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং সুশীলসমাজের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন (ডেইলি স্টার : ১১/০১/২০২৩)। তার পরপরই আসেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক হবে বলে প্রত্যাশা করেন এবং বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে চান বলে জানান। লু আরো বলেন, এক দলকে সরিয়ে অন্য দলকে ক্ষমতায় বসানো যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য নয়। বরং বাংলাদেশের জনগণকেই সেটা ঠিক করতে দিতে হবে (প্রথম আলো : ১৭/০১/২০২৩)। মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের সিরিজ সফরে এরপর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কাউন্সিলর ডেরেক শোলে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা কিছু কড়া কথাবার্তাও বলেন। তিনি রাখঢাক না করেই জানান যে, বিশ্বের যেকোনো দেশেই গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশে সহযোগিতা সীমিত করে নেয়। সাত সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়া শোলে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠক করে গণতন্ত্র, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী সুশীল সমাজের গুরুত্বের ওপর জোর দেন এবং এসব বিষয়ে সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার থাকবে বলে অবহিত করেন। তার সাথে গণভবনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ হবে’ (ডেইলি স্টার : ১৬/০২/২০২৩)।

তবে এ সময় আরো একটি ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের কূটনৈতিক রাজনীতিতে যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। শোলের সফরের সময় কাকতালীয়ভাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় খাতরা সফরে এসে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তার দেশের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে (প্রথম আলো : ১৬/০৩/২০২৩)। এই বিতর্কে চীনও নতুন করে যুক্ত হয়েছে। গত ১৪ মার্চ চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থানকে চীন সমর্থন করে (প্রাগুক্ত)। চীনের এই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের বাংলাদেশের নির্বাচনবিষয়ক বক্তব্যসমূহের পরিপ্রেক্ষিতেই এসেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এরই মধ্যে মার্কিন দূত পিটার হাস তার দায়িত্ব পালনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক নিবন্ধে লিখেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের কেউ নেই। তবে আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে পারবে, এটাই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া (নয়া দিগন্ত : ১৬/০৩/২০২৩)। যুক্তরাষ্ট্রের এই চাওয়ার মধ্যেই গত ১২ মার্চ ‘ইইউ’ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এর নেতৃত্বে আট সদস্যের ‘ইইউ’ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠকে ‘ইইউ’ রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে সামনের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে ‘ইইউ’ নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাবেনা (ডেইলি স্টার : ১৪/০৩/২০২৩)। ‘ইইউ’ এর এই কঠোর বার্তার আওয়াজ মিলানোর আগেই গত ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের বৈশি^ক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের কথা বলা হয়। পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে সেই নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় (প্রথম আলো : ২১/০৩/২০২৩)।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement