১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাষাসৈনিক সাংবাদিক ছৈয়দ মোস্তফা জামাল

ভাষাসৈনিক সাংবাদিক ছৈয়দ মোস্তফা জামাল। - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রবীণ সাংবাদিক, ভাষাসৈনিক, অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহকারী মহাসচিব, ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ মোস্তফা জামাল দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন ১৯ বছর হয়েছে। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ও বড় মনের অধিকারী এ মহৎ ব্যক্তির কথা তার সমসামায়িক ও অনুজদের মনে আজো ভাস্বর হয়ে আছে। তিনি ছিলেন লোভ লালসার ঊর্ধ্বে এক সমাজহিতৈষী। ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের সাথে তার আচরণ ছিল অমায়িক, আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সমাজসেবা, জনকল্যাণ ও ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানে তিনি পুরো জীবন ব্যয় করেন। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতা করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অনেকে ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে প্রথিতযশা সাংবাদিক ও নামী-দামি সম্পাদক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তাদের মধ্যে দৈনিক সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক আমানুল্লাহ কবির ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক হারুন হাবিব অন্যতম। ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম এসে তিনি গ্রামীণ সাংবাদিকতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৩ থেকে ২০০৪ সালে মৃত্যু অবধি ৩১ বছর তার সান্নিধ্যের সৌরভে মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়েছি। সাতকানিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ছাত্র থাকাকালীন তার সাথে আমার পরিচয়। তিনি তখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের গ্রামে ফিরে দৈনিক ইত্তেফাকের সাতকানিয়া প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ইত্তেফাক ছিল সেসময় অত্যন্ত জনপ্রিয় দৈনিক। আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। পঁচাত্তর সালে বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গেলে সংবাদ ও বাংলাদেশ টাইমসে পটিয়া মহকুমা সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। ছৈয়দ মোস্তফা জামালের কাছে আমি রিপোর্টিংয়ের খুঁটিনাটি অনেক বিষয় শিখেছি। তিনি আমাকে ঢাকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার মফস্বল সম্পাদকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে বিএ অনার্সে ভর্তি হই তখন তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মুঈনুদ্দিন আহমদ খানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দেখাশোনা করার অনুরোধ করেন।

ছৈয়দ মোস্তফা জামালকে ঘিরে সাতকানিয়া ও পটিয়ায় তরুণ সাংবাদিকদের একটি গ্রুপ গড়ে ওঠে। সৈয়দ মাহফুজুন্নবী খোকন, মাহফুজুর রহমান খলিলী, আবু সুফিয়ান, আমিনুল হক আজাদ, মামুনুর রহমান খলিলী, এ কে এম শারফুদ্দিন ও রাজিব কান্তি বড়ুয়া অন্যতম। ছৈয়দ মোস্তফা জামালের নেতৃত্বে দানবীর সাবেক পার্লামেন্ট মেম্বার আহমদ কবির চৌধুরীর দানকৃত জমিতে আমরা সাতকানিয়া প্রেস ক্লাব গড়ে তুলতে সক্ষম হই। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান দক্ষিণ চট্টগ্রাম সফরে এলে আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেস ক্লাবের জন্য ২৫ হাজার টাকা অনুদান মঞ্জুর করেন। সে সময় এ অংশটি অনেক বড়। আমি তখন প্রেস ক্লাবের সভাপতি। সৈয়দ মাহফুজুন্নবী খোকন এখনো সাতকানিয়ায় সাংবাদিকতা করেন এবং প্রেস ক্লাবের বর্তমান সভাপতি। মাহফুজুর রহমান খলিলী পরবর্তীতে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হন এবং বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী। আবু সুফিয়ান এখন সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত। চট্টলা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক। আমিনুল হক আজাদ বান্দরবানে জামায়াতের প্ল্যাটফর্ম থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন। কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। মামুনুর রহমান খলিলী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসর নিয়েছেন। এ কে এম শারফুদ্দিন স্থানীয় হাইস্কুলের হেড মাওলানা হিসেবে অবসর নিয়েছেন। রাজিব কান্তি বড়ুয়া বেসরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছেন। এখন সবই অতীত কথা।

ছৈয়দ মোস্তফা জামাল ১৯৩৪ সালের ৮ জানুয়ারি সোমবার পবিত্র রমজান মাসে চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া থানার সোনাকানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন কলকাতাস্থ নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারাবরণকারী নেতা মৌলভি ছৈয়দ ছোলতান আহমদ। তার দাদা ছৈয়দ আলিম উল্লাহ শাহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও আরাকানে ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে বৃহত্তর সাতকানিয়া থানার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আন্দোলনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় মিছিল, পথসভা, অবরোধ কর্মসূচি পালন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সক্রিয় প্রচার চালান। সাতকানিয়ার আহ্বায়ক হিসেবে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও এপ্রিল মাসে ঢাকায় ভাষা সম্মেলনে অংশ নেন। সে সময় তখনকার সদস্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে চট্টগ্রামসহ ভাষা আন্দোলন বিষয়ে মতবিনিময় করেন।

তিনি ১৯৫২ সালে দৈনিক আজান, ১৯৫৩ সালে দৈনিক সংবাদের সাতকানিয়া সংবাদদাতা, ১৯৫৪ সালে ঢাকায় দৈনিক মিল্লাত ও সাপ্তাহিক সৈনিকের সহসম্পাদক, ১৯৫৮ সালে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক নাজাতে রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৬০ সালে দৈনিক আজাদীর ঢাকা ব্যুরো প্রধান নিযুক্ত হন। এ সময় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) রিপোর্টার্স ইউনিটের উপপ্রধান ছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং মারি, মোজাফফারাবাদ ও কাশ্মির সফর করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সমাজসেবা সম্মেলনে অংশ নেন। ১৯৬৭ সাল থেকে চার দফায় ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৯ সালে দৈনিক ইত্তেহাদের ঢাকাকেন্দ্রিক রিপোর্টার, ১৯৬০ সালে দৈনিক পয়গামে সহসম্পাদক, ১৯৭২ সালে দৈনিক স্বদেশের ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ থাকায় তিনি প্রথমে রংপুরের বুড়িমারী সীমান্তপথে ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, কলকাতা, মেঘালয় ও আগরতলায় অবস্থান করেন। তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে সুদীর্ঘ সময় চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বতারা পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহকারী মহাসচিব নির্বাচিত হন।

ছৈয়দ মোস্তফা জামাল বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী গবেষণা একাডেমির সভাপতি, সুফি নুর মোহাম্মদ আল-কাদেরি স্মৃতি সংসদের সহসভাপতি, কবি আলাদীন আল নুর স্মৃতি সংসদের সভাপতি ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। তিনি তমদ্দুন মজলিসের সহসম্পাদক ও অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খানের নেতৃত্বে ঢাকায় গঠিত পাকিস্তান ছাত্রশক্তির প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সিরাত মিশন চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি, বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাজকল্যাণ সমিতির সহসভাপতি, ঢাকার বাংলা কলেজের গভর্নিং বড়ির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কবি কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত কমিটির প্রচার সম্পাদক, প্রাচীন সমাজ উন্নয়ন সংগঠন বাংলাদেশ সমাজকল্যাণ সমিতির (বিএসকেএস) সহসভাপতি, ড. মাহফুজুল হক স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলামী ফাউন্ডেশনের পরিচালনাধীন চট্টগ্রাম ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক প্রিন্সিপাল আশরাফ ফারুকী ছৈয়দ মোস্তফা জামাল লিখিত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর জীবন-কর্মের ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ এবং মঘিস্থানে ইসলাম নামে দু’টি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সাংবাদিকতায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০০১ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি তাকে স্বর্ণপদকে ভ‚ষিত করে, ২০১০ সালে মরণোত্তর সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমদ পদক লাভ করেন।

ছৈয়দ মোস্তফা জামালকে ঘিরে রয়েছে আমাদের অনেক স্মৃতি। ১৯৭৫ সালে যখন বিভিন্ন পেশার মানুষের বাকশালে যোগদানের হিড়িক পড়ে যায়, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি যোগ দেবেন কি না। উত্তরে তিনি বলেন, বাকশাল টিকবে না। সব ওলটপালট হয়ে যাবে। পরবর্তীতে তার কথা সত্য প্রমাণিত হয়। তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি আমাকে বিস্মিত করে। ছৈয়দ মোস্তফা জামাল দৈনিক ছোলতান নামে একটি বাংলা দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু উদ্যোক্তা না পাওয়ায় সফল হননি। আমরা সমাজহিতৈষী এ মনীষীর রুহের মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে তার দারাজাত বুলন্দ করে দিন।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
স্বাধীনতা সূচকে ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম নাটোর পৌরসভা কার্যালয়ের ভিতরে দুপক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত কাঁঠালিয়ায় মাঠে ছাগল আনতে গিয়ে বজ্রপাতে কিশোরে মৃত্যু সালমান খানের বাড়িতে গুলির ঘটনায় গ্রেফতার ২ আরো দুই সদস্য বাড়িয়ে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন রাবির নতুন জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে অপরাধ না করেও আসামি হওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে : মির্জা ফখরুল লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানোৎসবে নেমে শিশুর মৃত্যু ধূমপান করতে নিষেধ করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা বড় বোনের বৌভাতের গিয়ে দুর্ঘটনায় স্কুলছাত্র নিহত কোটালীপাড়ায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত

সকল