২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

‘ব্যত্যয় একটা কিছু হয়েছে’

হামলার প্রতিবাদে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সমাবেশ। - ছবি : নয়া দিগন্ত

সম্প্রতি সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত একটি খবর মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গত ১৭ মার্চ সব জাতীয় সংবাদপত্রে খবরটি গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়। পাঠক যে খবর পড়ে যুগপৎ স্তম্ভিত ও হতাশ হয়েছেন, সন্দেহ নেই। আমরা অন্যতম জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক থেকে সে খবরটি পাঠকের জন্য উদ্ধৃত করছি। বোদ্ধা পাঠক আমাদের দ্বিরুক্তি ধৃষ্টতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি। ইত্তেফাক খবরটির শিরোনাম করেছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে একতরফা ভোট’। খবরের সূচনাপর্ব থেকে সামান্য কয়েকটি ছত্র উদ্ধৃত করছি। ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একতরফা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশ দিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবী প্যানেলের প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্রের বাইরে রেখেছেন আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা।... দুই দিনব্যাপী এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য ভেঙে এভাবে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী সমিতিতে ভোট করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।’ খবরটি পড়ে সবশ্রেণীর পাঠক যুগপৎ স্তম্ভিত ও হতাশ হয়েছেন। স্তম্ভিত হওয়ার কারণ হয়তো এমন যে, দীর্ঘকালের ইতিহাস ঐতিহ্য ভেঙেছেন আইনজীবীরা একান্ত দলান্ধতার কারণে। আইনজীবী সমাজের সম্মানিত সদস্যগণ পেশাজীবী সমাজের মানুষ। সমাজে উচ্চতর স্তরের লোক তারা। তারা কৌঁসুলী, তারা সমাজের বিচারবঞ্চিত বহু মানুষকে অধিকার ফিরে পেতে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকেন। এই সম্মানিত ব্যক্তিগণ অবশ্যই সুকৌশলী, অবশ্যই অপকৌশলী নন। সেই হিসেবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সমর্থক হিসেবে তাদের সহযোগীদের সাথে যে আচরণ করেছেন সেটা তাদের সামাজিক মর্যাদার সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করা হচ্ছে। তা তাদের একটি ক্ষুদ্র একাংশ বিনষ্ট করায় তারা হয়তো মর্মাহত আর জনগণ সেটা দেখে একেবারেই হতভম্ব। সেই সাথে মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টির কারণও রয়েছে। সম্মুখে জাতীয় নির্বাচন, সেখানে ক্ষমতাসীনদের আচরণ কী হতে পারে তার একটি ‘মিনি’ উদাহরণ আওয়ামী লীগপন্থীরা দেখিয়ে দিলেন। সে জন্য সাধারণের মধ্যে এই গভীর হতাশা। সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনে প্রতিপক্ষের প্রার্থীদের পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি, আগেই কেন্দ্র দখল করে নিয়েছেন ক্ষমতাসীনদের অনুসারীরা। এমন একটা সংগঠনের নির্বাচনে সরকার সমর্থকদের আচরণ অভূতপূর্ব। ক্ষমতাসীনদের অনুরক্তগণ জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সময় কেন ডাইনোসরের মতো রূপ তারা নেবে সেটা এখন বিস্ময়ভরা চোখে দেখার বিষয় এবং সরকারের প্রতিপক্ষকে বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন ও করণীয় বিষয় স্থির করার সময় এসে গেছে।

সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক সংগঠনগুলো দেশের বর্তমান শাসকদের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে যে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, তার যথার্থতা অতীতের মতোই এবারো প্রমাণিত হলো এবং সেটা উদাহরণ হয়ে থাকল এই সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির ভোটে।

শাসক দল কিন্তু তাদের অধীনে নির্বাচন করিয়ে নিতে এখনো বদ্ধপরিকর, এখন পর্যন্ত এ প্রশ্নে তাদের কিছুমাত্র পিছু হটার আলামত নেই। তাদের মনোভাব ও দেহভঙ্গিমা এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিতে নারাজি। তারা ইতোমধ্যে পরিষ্কার করেছেন, যেকোনো মূল্যে তাদের ক্ষমতায় আসতেই হবে। এমন ‘ধনুর্ভঙ্গ পণ’ কোনো শুদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে প্রকাশ করা যে পুরোপুরিভাবে আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর শামিল। তারা অভিপ্রায়ই শুধু প্রকাশ করেননি; তার অনুশীলনও হচ্ছে। এমন প্রশ্নে সুরাহা বা নিষ্পত্তি করায় একমাত্র দায়িত্বশীল হচ্ছে জনগণের আদালত, অস্ত্র নয়; বিশেষ করে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের একেবারেই নয়। কারা ক্ষমতায় বসবেন কাদের বিদায় দেয়া হবে তার মতামতের এখতিয়ার কেবল সব ভোটারের। এমন প্রত্যয় এমনটাই পরিষ্কার করে যে, তারা জনতার অধিকারকে ছিনতাই করবেনই যেমনটা অতীতে করে এসেছেন। তাহলে আর ভোট করা নিয়ে কেন এত ‘ঢাকঢোল’ পেটানো বা বাগাড়ম্বর করার দরকার কী? দেশের নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সৃষ্ট। কারা তাদের তৈরি করেছেন, ইতোমধ্যে কমিশন একাধিকতার প্রমাণ করেছেন। তাদের রূপদানকারীদের ব্যাপারে যে প্রতিষ্ঠানের অনুরাগের কোনো কমতি নেই, এখন সেই কমিশনই শাসক দলের সাথে আলোচনা করে বলে দিক, নির্বাচন নিয়ে এত ঝামেলা ও পয়সা খরচ করার কী দরকার? আসুন, ঘোষণা করে দিচ্ছি, আপনারা ‘নতুন দিনের’ সরকার। আপনারা তো সাফল্যের দিগন্ত সীমা স্পর্শ করে এসেছেন। এবার না হয় আপনারা পৃথিবীর ‘অরবিট’টা অতিক্রম করে ফেলুন। তাহলে আর কী চাই? এতকাল মানুষ পানি খেত, এখন মধুর নহর থেকে পেয়ালা ভরে মধুই কেবল খাবে। কী আনন্দ ঘরে ঘরে! আয় সখি, নৃত্য কর ঘিরি ঘিরি।

সে যাই হোক, সবাই এটা আশা করতে পারে, যারা আইনাঙ্গনের মানুষ সেই আইনজীবীদের কাছ থেকে সহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র ও সহ-অবস্থানে দীক্ষা সবাই পাবে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শাসক দল যেটা দিতে পারেনি, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চেতনায় স্নাত হলেও আইনজীবীরা কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই দেখাবেন তাদের সহযাত্রী ভিন্ন সমতাদর্শের সাথে। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয়, সেই আওয়ামী চেতনায় লালিত আইনজীবীগণ সেটা দেখাতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে শুধু অবাক নয়, সেই সাথে বেদনার বিষয় যে, দেশ এখন যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এ সময় আইনের মানুষগুলো আইনের শুদ্ধ পথটা অনুসরণ করলে সেটা মূল দলের জন্য শুধু নজিরই হতো না, তাদের ভিন্নভাবে ভাববার উপলব্ধি জাগাতে পারত। কিন্তু তা না হওয়ায় জনগণ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারপরনাই শঙ্কিত। মূল দলের এবং তাদের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের চলার পথ অভিন্ন ও সমান্তরাল সে প্রেক্ষিতে বিষয়টি দৃঢ়মূল হয়েছে, এখন তাদের প্রতিপক্ষ যে পক্ষশক্তির চেয়ে আরো দৃঢ় হওয়ার সময় উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ইস্পাত দৃঢ় হতে হতে দেশে শুদ্ধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনকে আরো বেগবান করছে। এ জন্য পুরো আন্দোলনের গতিপথ পর্যালোচনা করে দেখা হোক কোথায় কোন ফাঁকফোকর রয়েছে, কোথায় কতটুকু ব্যত্যয় ঘটেছে? ঝালাই পর্যালোচনা, তার আলোকে সব কিছু পুনঃবিন্যাসের আয়োজন করতে হবে। সবাইকে এই প্রত্যয়ের দীক্ষা নিতে হবে ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে ওপরে তুলে ধরে এগিয়ে যাওয়াটা এখন মানুষ প্রত্যাশা করে। এত কাল তথা যা প্রায় ১৫ বছরের মতো যেখানে দেশের চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এরই কেবল অনুশীলনই করা হয়েছে, এখনো করা হচ্ছে।

জনগণ আরো একটি বিষয় লক্ষ করেছে, প্রধান প্রতিপক্ষ শক্তি তথা বিএনপি এবার তাদের সমমনা পেশাজীবীদের মধ্যে সাবেক সদস্য যারা প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ, তাদের সাথে সংযুক্ত করে জনসমক্ষে হাজির করছে। এটা অবশ্যই তাদের কর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী ও জনগণের ভেতর তাদের ব্যাপারে বিএনপি যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিন্যাস করতে চায় এবং দেশকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কথা ভাবছে। সেই প্রয়াসের সাথে গুণীজন অভিজ্ঞ-দক্ষ ব্যক্তিদের সংযুক্ত করা হয়েছে। তাদের অগ্রসর চিন্তাভাবনা ও সৎ পরামর্শ রাষ্ট্র মেরামতের প্রয়োজনীয় নীল নকশা বাস্তবায়নের পথ সুগম। এবার সম্মুখে চলার পালা প্রধান প্রতিপক্ষ শক্তি তথা বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের যে ২৭ দফা পেশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে, ২৭ দফাই শেষ কথা নয়। প্রয়োজনে সেখানে আরো বিষয় সংযোজিত ও সন্নিবেশিত হতে পারে। এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সবাই একে খোলা দলিল হিসেবে গ্রহণ করছে বটে। তবে অনেকেই মনে করেন দু’টি বিষয়ও এই দলিলে ঢুকতে পারে। সেটা হচ্ছে, দেশের বিপর্যস্ত পরিবেশ পরিস্থিতি ও ভোক্তাদের কাছে যেসব মানহীন ও ভেজাল ওষুধপত্র, উচ্চমূল্যে খাদ্য উপস্থিত করছে, তার প্রতিবিধান অবশ্য করতে হবে। এ ব্যাপারে একটা কথা অবশ্য রয়েছে তা হলো, যা কিনা ২৭ দফায় রয়েছে, সংবিধান সংস্কারের বিষয়। তাই সংবিধান যদি পর্যালোচনায় আসে সে ক্ষেত্রে এই দুই বিষয় হয়তো স্বাভাবিকভাবে এসে যাবে। কিন্তু উভয়ই সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত আছে।

ইদানীং একটা বিষয় খুব লক্ষণীয়, সেটা হলো যাদের কলমের ধার জবরদস্ত, তাদের অনেকেই কিন্তু এ সময়ে জেগেছেন, সরব হয়ে উঠছেন। তারা ক্ষমতাসীনদের নিয়ে মিঠে কড়া কিছু লিখছেন বটে তবে তাদের শেষ কথা ঘরে ফিরে আওয়ামী বলয়ের সীমান্ত ধরে চলছে বটে; তবে তাদের সেই পত্রের ফাঁকফোকর দিয়েও আসল কথাটা বেরিয়ে আসছে যে, ‘ব্যত্যয় কিছু একটা হয়েছে। এ কথা কেন বলা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা গুণীজন নানাভাবে করছেন। কেউ কেউ বলছেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেকেই এখন বহমান বায়ুর গতিপথ দেখে পাল তুলেছেন। আসলে তারা হয়তো উপলব্ধি করছেন, পরিবর্তন এখন যেন অনিবার্য, শুধু কিছু সময়ের ব্যবধান।

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২

সকল