২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

২৫ শে মার্চের ইতিবৃত্ত

২৫ শে মার্চের ইতিবৃত্ত। - ছবি : সংগৃহীত

২৫ শে মার্চ ১৯৭১ ছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সৃষ্টি হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের শেষ দিন; রাতটি ছিল ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময়। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে পাক-হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চরম নৃশংসতা চালায়। গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগে হতচকিত মানুষ ও জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে। নারী-পুরুষ, শিশু, দুর্বল, সবল, বৃদ্ধকে নির্মম ও পৈচাশিকভাবে হত্যা করা হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ২৩ বছর ৭ মাস ১২ দিনের অসংখ্য ব্যর্থতা, শাসন, শোষণ, নির্যাতন, শাসক শ্রেণীর লোভ, হিংসা ও অবহেলার শত শত কালিমার সাথে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের গায়ে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেন ২৫ শে মার্চ; যা ছিল গণহত্যা চালিয়ে চিরতরে বাঙালির স্বাধিকার চেতনা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার জন্য। হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এ দেশবাসীকে হত্যার মহাউৎসবে মেতে উঠেছিল। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে চিরতরে এ জাতিকে পঙ্গু করার মাধ্যমে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

ভারত বিভক্ত হয়েছিল মুসলমানদের ওপর ইংরেজ ও হিন্দুদের সম্মিলিত অবহেলা, শোষণ ও নির্মম আচরণের জন্য; আর একই কারণে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু অত্যাচারীরা ছিল একই মুসলিম জাতি ও ধর্মের পশ্চিম পাকিস্তানি। ধর্মীয় কারণে ভারত বিভক্ত হয়ে হিন্দুদের জন্য ইন্ডিয়া, আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল বটে। ইন্ডিয়ার নেতারা আদর্শগতভাবে প্রকৃত হিন্দু ছিলেন এবং হিন্দুত্ববাদ অনুসরণ করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করেন; কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চরিত্র ইসলামী আদর্শের ধারে-কাছেও ছিল না। ফলে পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন ছিল না। ইসলামী আদর্শ যে সাম্য, মৈত্রী, মানবিক মূল্যবোধ, ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে; পাকিস্তানি শাসকদের চরিত্রে সেটা ছিল না। ফলে তারা পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের প্রতি চরম জুলুম, অন্যায় ও অবিচার করতে থাকে। এসব কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মানুষের সম্মান-মর্যাদা, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা লাভের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিকে উজ্জীবিত করে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করার; আর এজন্যই সংঘটিত করেন অসংখ্য ঘটনা এবং সৃষ্টি করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা, জেনারেল ওসমানির মতো সর্বাধিনায়ক ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মেজর জিয়াসহ অসংখ্য সামরিক নেতা।

২৫ শে মার্চের গুরুত্ব বুঝতে হলে এর ইতিবৃত্ত জানতে হবে। এ বঙ্গভূমিতে ১১৯৭-৯৮ সালে বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের আগমন ঘটে। ১৩০৩ সালে রাজা গৌর গোবিন্দকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে শোষিত ও অত্যাচারিত মানুষের মুক্তি দান করেন হজরত শাহজালাল তাঁর ৩৬০ জন দুঃসাহসী যোদ্ধাদের মাধ্যমে। এতে বঙ্গভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাম্য ও ন্যায়বিচার। ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশির প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শোচনীয় পরাজয়ে ভারতবর্ষে মুসলমান শাসকদের শাসনের অবসান শুরু হয়। প্রায় ৭০০ বছর মুসলিম শাসনে সংখ্যাগুরু হিন্দু জাতিও চাচ্ছিল একটা পরিবর্তন। তাই ইংরেজদের হাতে মুসলমান শাসকের পরাজয়কে তারা লুফে নিলো।

ইংরেজরাও তাদের শাসন দীর্ঘায়িত করার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো শুরু করল ষোলআনা। উভয় গ্রুপের কমন শত্রুতে পরিণত হলো মুসলমানরা। ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের কৌশলে লেলিয়ে দিলো। মুসলমানদের বঞ্চিত করে হিন্দুদের প্রভুত্বের আসনে বসানো হলো। মুসলিম শাসনামলে খাজনা আদায়কারী হিন্দু কর্মচারীদেরকে বানানো হলো জমিদার; আর মুসলমানরা হয়ে গেলেন প্রজা। হিন্দু ও ইংরেজদের যৌথভাবে চতুর্মুখী চক্রান্ত শুরু হলো ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে তাদের নিজস্ব আদর্শ ও জীবনবোধ থেকে দূরে রাখার জন্য। যা স্পষ্ট বুঝা যায় ১৮৮৭ সালের মাদ্রাজে কংগ্রেস অধিবেশনে হিন্দুত্ববাদী নেতা লালা লাজপত রায়ের বক্তব্যে, ‘মুসলমানরা এখানে বহিরাগত। তারা যদি হিন্দুদের আচার-বিধি পালন না করে তবে ভারতে তাদের বসবাস করতে দেয়া উচিত নয়।’

‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ নামে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধের একটি উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য, যা তারাকৃষ্ণের ‘রাজভক্তি বিষয়ক’ প্রবন্ধে উল্লেখ আছে- ‘পূর্ব্বকালে যখন এই দেশ হিন্দু জাতির শাসনাধীনে ছিল তখন রাজাগণের পক্ষপাতিত্ব দোষে জাতি বিশেষ অপর সব জাতির উপর সম্পূর্ণ প্রভুত্ব করিতেন, ওই সব জাতিকে স্বর্গ বা নরকগামীকরণের কর্তা ছিলেন। যখন এই রাজ্য যবনদিগের হস্তে ছিল, তখন তাহারা হিন্দুবর্গকে নাস্তিক ও অধার্মিকের শেষ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছিলেন। স্বজাতি প্রজাবর্গের প্রতি যাবতীয় বিষয়ে অনুগ্রহ, হিন্দু প্রজাদিগের প্রতি সর্বতোভাবে নিগ্রহ করিতেন। ... ব্রিটিশ জাতির রাজনিয়মাবলীতে এই সকল দোষের লেশও নাই, তাহারা আপন জাতীয় এবং এদেশস্থ ডোমপ্রভৃতি যৎপরোনাস্তি নীচ ব্যক্তিকে বিচার কালে সমান দেখিতেন। ... ঐ জাতির পক্ষপাত শূন্যতা গুণের অধিক প্রশংসা কী করিব?’ হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিদ্বেষ কতটা তীব্র ছিল, যার প্রমাণ মিলে জ্ঞানেন্দ্র পান্ডের বইতে- “...যদি মুসলিমরা এই দেশে থাকতে চায়, তাহলে আমাদের মতো করে থাকতে হবে।’

এভাবে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানে মুসলমানরা শঙ্কিত হয়ে নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ১৯০৬ সালে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কংগ্রেস চিহ্নিত হয়ে উঠল কেবল হিন্দুদের দল হিসেবে। ১৯০৫ সালে পশ্চাৎপদ মুসলমানদের উন্নতির জন্য বঙ্গভঙ্গ হয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে অধিকাংশ মুসলিম এরিয়া নিয়ে গঠিত হয় বাংলা-আসাম প্রদেশ। কিন্তু তা টিকতে পারেনি বর্ণ হিন্দুদের কঠোর আন্দোলনের কারণে। সারা ভারতে ১৯২৩ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ১১২টি দাঙ্গায় অসংখ্য মুসলমান নিহত হয়।

অবশেষে, দ্বি-জাতি তত্ত্বে র ভিত্তিতে ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে এ কে ফজলুল হকের মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও ১৯৪৭ সালের ২৭ শে এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কংগ্রেসের অন্যতম অসাম্প্রদায়িক নেতা মি. বসু, কিরণ শঙ্কর রায়সহ আরো অনেকে একমত পোষণ করেন।

কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘হিন্দু মহাসভা’ ও কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল অবাঙালি নেতাগণের চরম বিরোধিতার কারণে বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্রের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হতে পারেনি। অবশেষে লীগ ও কংগ্রেস নেতারা একমত হলে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান সর্বদিক থেকে দুর্বল হবার কারণে শুরু হয় বঞ্চনার আরেক অধ্যায়। কেননা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী বাঙালিদের মধ্যে ছিল না কোনো সামরিক বাহিনীর, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর, সরকারি প্রশাসন এককভাবে পরিচালনার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত জনবল। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষায়ও বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানিদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানিরা আমাদের তুলনায় অগ্রগামী থাকার কারণে শাসনব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই ছিল তাদের হাতে। মুজিব তার বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা-৭৫)

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস‘ বইতে লিখেছেন পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ‘পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসাবে দেখা হতো। ‘প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব প্রদেশের একচ্ছত্র দৌরাত্ম্য ছিল। পাকিস্তানের ওই অংশে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ছিল পাঞ্জাবে। সবচেয়ে বেশি উর্বর কৃষিজমি ছিল সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল পাঞ্জাবের। অনেক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা মনে করতেন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তাদের স্বার্থ রক্ষায়। তাদের অনেকেই বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করতেন, মনে করতেন বাঙালিদের লড়াই করার ক্ষমতা নেই।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য কায়েম হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমাংশের উন্নয়নের দিকে প্রধান নজর দিলো। পূর্ব পাকিস্তানকে একরকম উপনিবেশ হিসাবে দেখা শুরু হয়।’ (স্ত্রূ-বিবিসি)

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান বিধান সভায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে মতামত প্রদান করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার দিনের অনুষ্ঠানে তৎকালীন এরিয়া কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আইয়ুব খান বাঙালি সৈনিকদের উর্দু ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিলে মেজর এমটি হোসেন ও ক্যাপ্টেন এমএ গণি তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। ১৯ শে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা হবে ঘোষণা দিলে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৫২ সালে রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এরপর পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বৈরতন্ত্র বা সামরিক শাসন। দীর্ঘ ৯ বছরে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হলেও সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা হচ্ছিল না। ১৯৫৮ সালের ২৭ শে অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি ইসকান্দার মির্জার মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে। ২০ দিনের মাথায় ইসকান্দার মির্জা অপসারিত হয়ে দেশান্তরিত হন। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন আইয়ুব খান।

যদিও ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে, কিন্তু চতুর এ স্বৈরশাসক নির্বাচনে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রপতির পদটি দখল করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট অসাধারণ বীরত্ব ও বিস্ময়কর সফলতা প্রদর্শন করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করেন, যা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সারা পাকিস্তান উত্তাল হয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবির ওপর গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় রাওয়ালপিন্ডিতে এবং তা ব্যর্থ হলে ২৫ শে মার্চ পুনরায় সামরিক শাসন জারি করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দেন। ৩০০ আসনের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয়ে নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান-ই হচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ কিন্তু ভুট্টো ও পাকিস্তানি জেনারেলদের চক্রান্তে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতিকে চিরতরে দুর্বল করার গভীর ষড়যন্ত্র চলতে থাকে গোপনে। পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলনে উত্তাল হতে থাকে। ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সামনে মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি তার ভাষণের সর্বশেষ যে আলটিমেটাম দেন, তা ছিল ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এরপর ইয়াহিয়া খান মুজিবের সাথে আলোচনা করার জন্য ঢাকা আসেন। ১৬ মার্চ হতে ২২ শে মার্চ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যা ছিল এক প্রতারণা মাত্র। বৈঠকের আড়ালে তারা ব্যাপক গণহত্যা পরিচালনা করার জন্য সৈন্য বৃদ্ধি করতে থাকে। ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করে। ঘটে সেই ২৫ শে মার্চ, রোজ বৃহস্পতিবারের কালো রাত্রি। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের আসলরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে বাঙালি জাতির এক প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি হত্যার মহোৎসবে।

মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মঞ্জুর, এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার ও আরো অনেক সিনিয়র বাঙালি সামরিক অফিসারগণ একত্রিত হন তেলিয়াপাড়ায় ৪ ও ১০ এপ্রিল। প্রণয়ন করেন মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুক্ত হয় ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা। অসংখ্য শহীদের রক্ত ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং সৃষ্টি হয় একটি লাল-সবুজ পতাকা। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।’

লেখক : একজন সামরিক ইতিহাসবিদ ও
নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email : hoque2515@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির মৃত্যু নীলফামারীতে তিন হাজার ১৭০ চাষির মাঝে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ কারাগারে কয়েদির মৃত্যু উজ্জ্বল হত্যার বিচার দাবিতে সরিষাবাড়ীতে মানববন্ধন পাবনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ১ আহত ২১ খাবারের সন্ধানে বসতবাড়িতে হরিণ, মহামায়ায় অবমুক্ত সিঙ্গাপুর প্রবাসী ফিরোজ মাহমুদের লাশ দেশে ফিরেছে ফরিদপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের মৃত্যু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সব ধর্মের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে: ড. সুকোমল বড়ুয়া

সকল