২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাদের নতুন রাজনীতির চেতনা

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। - ছবি : সংগৃহীত

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ অচিরেই দেশে ফিরে আসবেন, এটা আমাদের বিশ্বাস।

কিন্তু কিভাবে? তিনি ২০১৫ সালে ঢাকার উত্তরা থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলেন এবং ৬৩ দিন পর তাকে পাওয়া গেল পার্শ্ববর্তী ভারতের একটি রাজ্য মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় শিলং-এ, প্রায় অসচেতন ও অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়। তারপর তার চিকিৎসা হলো। তিনি জানালেন তিনি কে? কিভাবে তিনি ভারতে অনুপ্রবেশ করলেন তা তিনি বলতে পারেননি। তার পর মামলা হলো অনুপ্রবেশের অভিযোগে... এবং আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেছেন, বিদেশে বাংলাদেশের কেউ জেল খাটলে সাজা ভোগ করে দেশে ফিরে আসেন। সালাহউদ্দিন আহমদও আসবেন। অসুবিধা কী? এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।

তার যুক্তিটা যথেষ্ট সহজ ও সরল। কিন্তু সরকারি জীবনে ওই সব সরল ও সহজ যুক্তির উপরেও আইনি যুক্তি খাঁড়া হয়ে আসে। তবে, ড. মোমেন কখনো কখনো এমন নির্জলা সত্য বলেন যে তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলে ফেলেন যে, তিনি তো দলের কেউ না, বাইরের লোক। কথা সত্য। তিনি নিয়মিত দলের লোক না, তবে তিনি সত্য বলতে ভয় পান না। আমার ধারণা, এবারও তিনি সরলোক্তিই করেছেন। নিহিত সত্যের ভেতরে ঢোকেননি।

তবে, আমাদের মনে পড়ছে ২০১৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা, যখন গুম হয়ে যাওয়ার একটি ভয়ঙ্কর আতঙ্ক বিরাজমান ছিল বিরোধী রাজনৈতিক সমাজে। তখন কে বা কারা রাজনৈতিক লোকদের অপহরণ করে চলছিল। সেসব নিউজ আমরা পাচ্ছিলাম সংবাদপত্রে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। আর আমাদের কেবল মনে হচ্ছিল, কারা এই সব নির্মম অপহরণের পেছনে? সাদা পোশাকের পুলিশের কথা আমরা জানি বা জানতাম। তারা বিরোধী রাজনীতিকদের গুম করে দেয়। কোনো বিশেষ কারণে ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম গুম হয়েছেন। তাদের কোনো খবর আজো কেউ বলতে পারেনি। সরকার তরফে বহুবারই বলা হয়েছে, আত্মগোপনে থেকে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি। এ রকম অভিযোগ বিএনপি অস্বীকার করেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। অপহরণ আতঙ্কে থাকতে হয়েছে রাজনীতিকদের। বিশেষ করে বিএনপির লোকদের। যারা তীব্র ভাষায় সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করতো তারা নিজেদের বাসায়ও রাত কাটাত না। যারা রাজনীতি করেন না, বিএনপিও করেন না, কিন্তু সরকারের সমালোচনায় মুখর, তাদেরও কাউকে না কাউকে গুম করা হয়েছে। অপহরণের বহুদিন পর তাদের কেউ কেউ সশরীরে ফিরে এসেছেন বটে, কিন্তু অপহরণের ব্যাপারে মুখ খোলেননি। এমন কি কবি ও অ্যাক্টিভিস্ট ফরহাদ মজহারকেও অপহরণ করা হয়েছিল ঢাকার শ্যামলী থেকে। তাকে যশোর সীমান্তে পাওয়া যায়। কিভাবে অপহরণমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন তিনি, সেই বর্ণনা তিনি দেননি। প্রতিবাদী ব্যক্তি ফরহাদ মজহারও চুপ মেরে যাবেন, এই বিষয়টি প্রায় অবিশ্বাস্য। কারণ, তিনি স্পষ্টবাদী এবং সাহসী মানুষ। চুপ মেরে গিয়ে তিনি মার্কসের দাস ক্যাপিটাল বা পুঁজিবিষয়ক বইটি নিয়ে ক্লাস শুরু করেন। যেসব কলাম তিনি লিখতেন, সেগুলোও এখন আর চোখে পড়ে না। আর যারা ফিরে আসেনি, তারা আদৌ ফিরে আসতে পারবেন, এরকম ভরসা তো তাদের পরিবার পরিজনরা করতে পারছে না। তবু তারা আশায় বুক বেঁধে আছেন, কখন না জানি ইলিয়াস আলী দরোজায় নক করে ডাকবেন তার স্ত্রী বা ছেলেমেয়েদের নাম ধরে।

এই যে এত মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে, তার কয়েকজন ফিরে এসেছে, তাতে সরকারের করতালি আমরা শুনেছি। যারা ফিরতে পারেননি, তাদের জন্য প্রকাশ্যে শোকও প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আওয়ামী রাজনৈতিক নেতাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এটা প্রমাণ করেনি যে তারা দুঃখিত হয়েছেন। বরং তাদের ভাবখানা এই রকম ছিল যে বিরোধিতা করলে গুম হয়ে যাবেন। এরকম ধমক যে কোনো কোনো পাতিনেতা দিয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য।

২.
২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন সালাহউদ্দিন আহমদ। নিখোঁজের ৬৩ দিন পর ১১ মে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে স্থানীয় পুলিশ তাঁকে উদ্ধারের পর প্রথমে একটি মানসিক হাসপাতালে এবং পরে শিলং সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১৫ সালের ১১ মে ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে তার বিরুদ্ধে ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা করে শিলংয়ের পুলিশ।

সালাহউদ্দিন আহমদ ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর শিলংয়ের নিম্ন আদালতে খালাস পান। কিন্তু ভারত সরকার আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ১ মার্চ আপিল আদালতের রায়ে তাকে বেকসুর খালাস দিয়ে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার আদেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে তাকে দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন আদালত।

ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপরোল্লিখিত মন্তব্য করেছেন
একটি বিষয় অনুদ্ঘাটিতই থেকে গেল, তা হলো সালাহউদ্দিনকে কে বা কারা অপহরণ করেছিল। কেন তারা মেঘালয়ের শিলং সীমান্তে ফেলে এসেছিল তাকে এবং তারা কেন এটা করেছে। আর নিম্ন আদালতে তাকে মুক্তি দেবার পরও ভারত সরকার আপিল করে তার জেলজীবন আরো ৪-৫ বছর বাড়িয়ে দেয়। তাতে কি লাভ হয়েছে ভারতের?

বিএনপির চোখে দেখলে এটাই মানানসই হবে যে, ইচ্ছে করে তো আর সালাহউদ্দিনের মতো রাজনীতিক, যিনি মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী ইত্যাদি পদে ছিলেন, রাতের আঁধারে শিলং সীমান্তে যাননি কিংবা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এমনটা করেননি। বোধসম্পন্ন কোনো মানুষ এটা করতে পারেন না। সরকারি চোখে সালাহউদ্দিন ডুব দিয়ে ওখানে পৌঁছেছেন এবং সরকারের রাজনৈতিক চরিত্রে কালিমা মাখানোর কাজটি করেছেন।

আমাদের রাজনৈতিক চরিত্র এমন চিন্তার বাইরে স্বাভাবিক কিছু ভাবতে শেখেনি। সালাহউদ্দিন আহমদ অপহৃত হয়েছিলেন এবং তাকে শিলং সীমান্তে ফেলে আসা হয়েছে যাতে তিনি দেশে ফিরতে না পারেন। এবং গত ৮ বছর ধরে তিনি ভারতের হাসপাতালে ও জেলে বন্দী জীবনযাপন করছেন। এখন তিনি দেশে ফেরার আইনগত অধিকার পেয়েছেন। আর তার ফেরা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যত সহজে তার মত জানিয়েছেন, আইনি দায় কি এতটাই সহজ ও স্বাভাবিক? সরকারের প্রধান দায়িত্ব তার একজন নাগরিককে ফিরিয়ে আনার সব ইতি-কর্তব্য সম্পন্ন করা। কিন্তু আমরা জানি, সরকারের রাজনৈতিক চরিত্র গোপনে গোঁফ মুচড়াচ্ছেন, কিভাবে তাকে আবারো আটকানো যায়। ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া অপ-আইনের প্যাঁচগুলো আমরা তো এ-করণেই ইনট্যাক্ট রেখেছি বা আরো পোক্ত করেছি।

সরকারের দায়িত্ব ছিল অ্যাবডাকশনে থাকা মানুষগুলোকে খুঁজে এনে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু সরকারের তো আরো বহু কাজ আছে, তার খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই যে সালাহউদ্দিন বা গুম হয়ে যাওয়া লোকদের খুঁজে বের করে আনবে? তা তারা করবেন না, তা জানি আমরা। কোনো সরকারই তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করে না। কিন্তু সমাজে যে অপহরণকারীদের কিছু গ্রুপ এরকম অপকর্ম করছে এবং সরকারের সোনা দিয়ে মোড়ানো সুনামে কালো দাগ যোগ করে দিয়েছে, সেই সব অপরাধীদের কেন আইনের হাতে সোপর্দ করার আয়োজন হয়নি?

প্রচলিত যে ধারণাটি আছে, তা হলো সাদা পোশাকে সরকারের বিশেষ পুলিশ ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা এই অপকর্ম করছেন, যাতে বিএনপি নামক সংগঠনটি রাজনৈতিক ময়দানে তোলপাড় শুরু করে। রাজনৈতিক তোলপাড় মানে হচ্ছে মাথা গরম করা রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলা করে তোলা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মসূচির মৌলিক চরিত্র এমনটাই। ব্যতিক্রম কেবল এবারই চোখে পড়ছে। সরকারের উসকানিকে পরিহার করে, দোষারোপ এড়িয়ে গিয়ে বিএনপি যে রাজনৈতিক ইতিহাস গড়ল, তার তুলনা হয় না। সরকার ও সরকারের রাজনৈতিক দল ও দলের নেতারা নানাভাবে তাদের ভাঙচুরের পথে আনার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেই ফাঁদে পা দেয়নি বিএনপি। বিএনপির এই প্রায় অহিংস মিছিল মিটিংয়েও হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ। তাদেরকে কোথাও মিছিল মিটিং করতে দেয়নি। হয় পুলিশি পারমিশনের বাধা, নয়তো সেই ভেন্যুতে আওয়ামী লীগই সভা ডেকেছে। এভাবে, আওয়ামী লীগ বিএনপির সহযোগী ছিল, আমরা দেখেছি সংবাদপত্রে ও টিভি পর্দায়। আর পুলিশ তো অস্ত্র বাগিয়েই ছিল। কোনো রকম বিশৃঙ্খলা করেনি, তারপরও গুলি করে হত্যা করেছে ৭টি প্রাণ। আর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে একটি ছেলে।

বিএনপির এই অহিংসপ্রায় রাজনীতিই হয়তো আগামী দিনে নতুন রাজনীতির দুয়ার উন্মুক্ত করবে
সালাহউদ্দিন আহমেদ দেশে নির্বিঘ্নে ফিরতে পারবেন কি না তা সরকারই ভালো জানেন। তবে, সরকার যেন সীমান্তেই আবার আটক করতে উদ্যত না হন, তাকে যেন তার পরিবার পরিজনের সাথে মিলিত হতে দেন, এটাই আমরা চাই। একটি শুভ সূচনার কথা দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানতে চাই।

দেশটা আমাদের সবার, এটা মনে রাখলে, বিরোধ থাকবে না। আজ যখন চট্টগ্রামের জহুর হোসেন চৌধুরী মাঠে বাংলার ক্রিকেটের দামাল ছেলেরা বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারিয়েছে, তখন আমরা তাদের গৌরবজনক উত্থানই কামনা করছি। সেই সাথে রাজনীতির ময়দানেও যে সব ভুল-ত্রুটি আছে তা যেন ধুয়ে মুছে যায়, মনের কালিমা ও ক্লেদ নিংড়ে নিয়ে যায় নতুন চেতনা, এই প্রার্থনা করছি।


আরো সংবাদ



premium cement