২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মজাই আলাদা

নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মজাই আলাদা। - ছবি : সংগৃহীত

গত মঙ্গলবার রাতে খন টিভির স্ক্রলে দেখলাম, আবারো ৫% দাম বাড়িয়েছে পিডিবি, তখনই আনন্দে বুক ধড়ফড় করে উঠল। বাহ! এই না হলে জনগণের সরকার। দিনের ভোট ভোর রাতে কাস্ট করে তারা যে বিপ্লব করেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। কোনো নজির নেই, তাই তো নজির স্থাপনের এমন উদগ্র তৎপরতা বিদ্যুৎ বিভাগের। আগে, মানে অতীতে দাম বাড়ানোর কাজটি করত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কমিশন দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানি করত। সেই শুনানিতে ভোক্তা জনগণের মতামত প্রতিফলিত হতো। ভোক্তা জনগণ কি চায়, কতটা দাম বাড়ালে তারা সহ্য করতে পারবে, কতটা করলে আপামর জনতার আর্থিক ক্ষমতায় কতটা চাপ পড়বে- এ সব উঠে আসত। আমি নিজে গত ৫০ বছরে একবারও এরকম শুনানির মধ্যে পড়িনি। বিইআরসি কাদের মধ্যে গণশুনানি করত আল্লাহ মালুম। নিশ্চয়ই আমার চেয়েও যাদের পাওয়ার বেশি লাগে এমন ভোক্তাদের মধ্যেই গণশুনানি চলে। কিন্তু মুশকিল হলো, সরকারের লোকেরা এই সব গণশুনানিতে বিশ্বাসী নয়। তারা ডাইরেক্ট অ্যাকশনে বিশ্বাসী। তাই তারা বিইআরসির কাঁধ থেকে দায়িত্বের ওজন কমিয়ে দিয়ে নিজেরাই কাঁধে নিয়েছে। এখন সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগই (বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বিপিডিবি) দাম বাড়ায়, কমায়! তবে কমানোর কোনো ইতিহাস নেই। আর তারা কমানোর সংস্কৃতিতে বিশ্বাসও করে না। এ দেশে যে পণ্যের দাম একবার বাড়ে, তা আর কমে না। বিশেষ করে আমদানি করা পণ্য। দাম বাড়ানোর অজুহাতের কোনো কমতি নেই। মেঘলা দিনের অজুহাতে যেমন দাম বাড়ানোর রীতি আছে- তেমনি সরবরাহ ঘাটতিসহ নানান রকম চাঁদাবাজির কারণেও দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু কেন এবং কারা চাঁদাবাজি করছে তাদের ধরা বা তাদের কুকীর্তির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেই। এটাই চলমান সরকারি সংস্কৃতি।

২. দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে। গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো। (প্রথম আলো/০৩/০১/২৩)
লক্ষ করার বিষয় হলো- পিডিবি বিদ্যুৎ কেনে যে দামে তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে তা বিক্রি করে। এতে পিডিবি ঘাটতিতে পড়ে। সেই ঘাটতির অর্থ সে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি হিসেবে নেয়। অন্য দিকে বিতরণ কোম্পানিগুলো কোনো রকম ভর্তুকি পায় না। বরং তারা মুনাফা করে। গত অর্থবছরেও তারা মুনাফা করেছে। এক বিদ্যুৎ নিয়ে কতগুলো কোম্পানি চলছে, কত মানুষের চাকরি হয়েছে, কত পরিবার এই কর্মযজ্ঞের ফল ভোগ করছে, ভাবলে অবাকই হতে হয়। একটি চেইন অব জবস ফ্যাক্টরি যেন। এই আইডিয়া বেশ ভালো। কর্মসংস্থানের এই যজ্ঞ চাকরি বাজারের চাহিদাকে উসকে দেয়। কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। তা হলো- আমাদের চাকরিজীবীরা মানসিকভাবে দুর্নীতিপ্রবণ। কোনো নতুন প্রার্থীর চাকরি হলেই শুভার্থীরা জিজ্ঞেস করে... উপরি আছে?

সমাজের ভেতরে এই উপরির কালচার ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে এটা। সরকারের প্রত্যেক স্তরের দায়িত্বশীলরা জানেন, নিম্নস্তরের মানুষেরাও জানেন। একটি ছোট উদাহরণ দেই। সিটি করপোরেশনের একটি অফিসে আমি গিয়েছিলাম হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়ার জন্য। তারা আমাকে সাড়ে সাত লাখের ওপরে ট্যাক্স নোটিশ সার্ভ করেছে। একটি ছয়তলা বিল্ডিংয়ের জন্য এই টাকা অনেক বেশি। ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ওই পরিমাণ টাকা পে করতে হবে। তবে আপনি যদি হোল্ডিং ট্যাক্স কমাতে চান, তাহলে আপনাকে ব্যয় করতে হবে। দেখলাম, ওই অফিসের প্রত্যেকেই এই ঘুষ বাণিজ্যের সাথে জড়িত। ২৫% কমিয়ে দিয়ে রিসিট এনে দিলে তাকে ১০ হাজার টাকা দিতে হলো। তারপর জানালো আপিল করলে আরো ২৫ পার্সেন্ট কমে আসবে। তাতে গুনতে হবে আরো ২৫ হাজার টাকা। ঘুষের এই খেলাটা চলে প্রকাশ্যে, সবারই সামনে।

এই যে ৫০% কমানো হলো, বা কমানো হবে, সেই টাকাটা কি প্রকৃত হোল্ডিং ট্যাক্স থেকে কমানো হবে বা হলো? নাকি সিটি অফিসের কর্তারা অতিরিক্ত ট্যাক্স ধরে দিয়ে রাজধানীর ঘরে ঘরে ঘুষ বাণিজ্যের দরজা ওপেন করেছে? নাকি সিটির আয়কে কমানোর এক মহাপরিকল্পনার উৎস বানানো হয়েছে? সরকারের সেবামূলক প্রতিটি অফিসেই এইরকম ঘুষ বাণিজ্যের রমরমা। আমরা এ জন্য সিস্টেম নামক এক অদৃশ্য সেনাপতির অধীনে বাস করছি। সিস্টেমের দোহাই দিয়ে চলছে এই বাণিজ্যের তরণী।

আমরা প্রায়ই বলি, আমাদের দুর্নীতির উৎস হচ্ছে ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত প্রশাসনিক স্ট্রাকচারের আউটফল। ঘুষ দেয়া ও নেয়ার এই নদ-নদী, শাখা প্রশাখা আমাদের দৈনন্দিন চিন্তাবৃত্তের ভেতরে কেমন সহজে কাজ করছে। অতীতে, সাম্প্রতিক অতীতে নাকি সুদূর অতীতে, আজ আর তা স্পষ্ট করার প্রয়োজন নেই... এই ঘুষপ্রবাহ বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি ইউনিটে/বাড়িতে শুরু হয়। মিটার রিডাররা এই কাজে এতটাই দক্ষ যে, ভোক্তাকে রাজি করিয়ে, মিটারে কারুকাজ করে। এখন এই পদ্ধতি অনেকটাই কমেছে। প্রিপেইড ও পোস্টপেইড উভয়ক্ষেত্রেই। কিন্তু বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি চালু আছে কি না। বিদ্যুৎ যারা ব্যবহার করেন, তাদের ইউনিট হিসার কি কমপিউটারাইজড? সেন্ট্রালি সেই হিসাব লিপিবদ্ধ হয়? নাকি ম্যানুয়ালি তা করেন? মিটার রিডাররা রিডিং তথ্য নিয়ে গেলেই তা কমপিউটারে তোলা হয়? যদি এমনটা করার নিয়ম চালু থাকে, তাহলে ঘুষবাণিজ্য অব্যাহত থাকারই কথা। বাণিজ্যিক ও শিল্প সেক্টরে চোরাই লাইন ও রিডারদের বিল কমিয়ে দেয়ার গল্প আমরা জানি। আশাকরি, সেসব পদ্ধতি এখন আর নেই। কিন্তু পাওয়ার সেক্টরের মধু কোথায়, তা বুঝতে হলে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার নীতিই প্রমাণ করে যে, সরকারের তরফেই গলদভরা মনোভাব আছে। ব্যবসা করার জন্য যারা টাকা ইনভেস্ট করবেন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য, তাদের সেই বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার জন্যই চার্জ দিতে হবে। আবার সেই বেসরকারি কেন্দ্রটি যদি সারা মাস থেকে ইউনিট বিদ্যুৎও উৎপাদন ও সরবরাহ না করে তারপরও, তাকে ক্যাপাসিটিসহ প্রাক্কলিত বিদ্যুতের জন্য পিডিবি পে করতে বাধ্য। কারণ, চুক্তিতে এটাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ও না করেও যদি একই রকম টাকা আয় করা যায়, তাহলে সেই কেন্দ্রগুলোর মালিকেরা কেন এই লুটেরা পদ্ধতি বহাল রাখতে সরকারের দায়িত্বশীলদের সাথে দহরম-মহরম করবে না? রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মাণের পারমিশন দেয়া হয়েছিল আপৎকালীন সময় পার করার জন্য, মাত্র তিন বছরের জন্য। এটাই আমরা পত্রিকার পাতায় পড়েছি। আজ ১৫ বছর ধরে চলছে, তারাও বাড়িয়ে চলেছে চুক্তির মেয়াদ। বিপিডিবির নাকি বেসরকারি বিদ্যুৎ না হলে চলে না। এমনকি বিপিডিবির বিদেশী বিদ্যুৎও লাগে। তাই ভারতের আদানি গ্রæপের সাথে চুক্তি করেছে ২০১৭ সালে। আদানি পাওয়ার তাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, আর সেই পণ্য বিক্রি করবে বাংলাদেশের কাছে। তারা যে উৎপাদন করবে, তার জন্য যে যে ব্যয় হবে তার জন্য প্রতি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে বাংলাদেশ। যে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তার দাম ধরেছে টন প্রতি ৪৫০ ডলারেরও বেশি। অথচ ভারতের অর্থে তৈরি সুন্দরবনের পাশে রামপালে যে পাওয়ার প্লান্ট করেছে, সেখানে কয়লার দাম বাংলাদেশ দেয় ২৫০ ডলার করে। এই যে কায়লার দামে আকাশ-পাতাল পার্থক্য তৈরি করে আদানিকে দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের বিপিডিবি, জনগণের সেই টাকাটা কেন খোলামকুচির মতো ব্যয় করছেন? এ যেন আদানিকে লাভবান, সুপার লাভবান করার তলিকা। আসলে এর পেছনের উদ্দেশ্য তো আর আমরা জানি না। ওই বাড়তি টাকাটা কে পাচ্ছে বা কার জন্য দিচ্ছে সরকার, আল্লাহ মালুম।

এটা হচ্ছে সরকারের দেশপ্রেম। দেশের মানুষকে বিদ্যুতে ভাসিয়ে দেবেন তারা। অথচ সরকারের নিজেরই ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে, দেশের প্রয়োজন মোটে ১৪ থেকে ১৫/১৬ হাজার মেগাওয়াট। তারপরও ২০১৭ সালে চুক্তি করেছে। কি বাহাদুর পরিকল্পনা সরকারের বিপিডিবির। সরকারের মন্ত্রীরা সে অন্যায় চুক্তির পক্ষে সীমাহীন কুযুক্তি উপস্থাপন করছেন, যাতে বোঝা যায় জনগণ বিদ্যুৎ ছাড়া আর কিছুই খায় না। এতকাল শুনে আসছি, তার রেকর্ডেড বাংলাদেশ খাদ্যে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’। এখন বলছেন, ডলার রক্ষা করছেন সরকার খাদ্য কেনার জন্য। আগে বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, মনে পড়ায় সেই তথ্য জানালেন তারা।

বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কোথায় যায়, তা এবার বুঝে নিন।
এই যে ৫% দাম বাড়ালেন সরকার, তা যেন খুবই স্বাভাবিক। এক মাসে দুইবার ৫% করে দাম বাড়ানোর পর এবারও বাড়ালেন আরো ৫ শতাংশ। মন্ত্রী বললেন, এই পর্যায়ক্রমে দাম বাড়ানোর ফলে ভোক্তাদের তা সহ্য হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, সবই সহ্য হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই কারণেই একটি পরিবার ঢাকা থেকে বাক্স-পেটরা নিয়ে খুলনায় চলে গেলো সংবাদপত্র তো একজনের কথা বলেছেন, যা আসলে প্রতীকী হিসেবে এলো নিউজে। আরো যারা চলে গেছে, তাদের খবর তো সরকারের তথ্যপঞ্জিতে থাকবার কথা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন দুর্যোগ আসছে। আপনারা প্রস্তুত থাকুন। জনগণ তো দুর্যোগে সব সময়ই প্রস্তুত। সরকার প্রস্তুত কি না, সেটাই আমাদের জিজ্ঞাসা। জনগণের জীবনরক্ষায় সরকারের প্রস্তুতি খুবই জরুরি। কারণ, সরকারই তো জনগণের অভিভাবক। সেই অভিভাবককে সজাগ হতে হবে। কেবল বিরোধী রাজনীতিকদের দাবড়ানি দেয়াটা সরকারের কাজ না।

জনগণ ও বিরোধী রাজনীতিকরা সরকারের সমালোচনা করে এই জন্য যে, যাতে সরকার আগে ভাগেই প্রস্তুতি নিতে পারে। কিন্তু সরকারের হাব-ভাব বলে দিচ্ছে তারা জনগণের প্রতি মনোযোগী নয়, তার লক্ষ্য অন্যখানে, অন্য কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement