২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লেবাননের পথে মিসর, এর পর কে

লেবাননের পথে মিসর, এর পর কে। - ছবি : নয়া দিগন্ত

মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আলোচনা বিশ্ব গণমাধ্যমে সবসময় চলতে থাকে। নানা ইস্যু ছাড়িয়ে এবার আলোচনার কেন্দ্রে মিসর। এরই মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি ভারতে এসে আরেক আলোচিত নেতা নরেন্দ্র মোদির সাথে কোলাকুলি করে গেছেন। মোদি সিসির সামনে ঘোষণা করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম একটি দেশের সাথে ভারত কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণের ঘোষণা দিচ্ছে। মোদি সর্বশেষ আলোচনায় উঠে এসেছেন মোদি ও গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির ‘ইন্ডিয়া: দি মোদি কোয়েশ্চন’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি ঘিরে। গুজরাটের দাঙ্গাকালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের দিল্লি থেকে প্রেরিত এক গোপন প্রতিবেদন অবলম্বনে গুজরাটের দাঙ্গা আর এখনকার ভারতে মোদি জমানায় সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে সচিত্র রিপোর্ট স্থান পেয়েছে এই প্রামাণ্য চিত্রে।

এক দশকের শাসনে আল-সিসি নানা সময় আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন। আলোচনার প্রধান কারণ ছিল নির্মম ও সহিংসভাবে ভিন্নমত দমন। রাবা স্কোয়ারের গণহত্যা নিয়ে ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে কোনো গোপন প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে কিনা জানা যায় না। তবে পাঠানো হলে সেই প্রতিবেদনের সাথে বিবিসির মোদি প্রতিবেদনের বেশ মিল পাওয়া যেত।

মিসরের দুর্দশার কাহিনী
মিসরজুড়ে এবারের আলোচনার মূলে রয়েছে অর্থনীতির চরম দুর্দশা। ইকোনমিস্ট সাময়িকীর মতে, মিসরের দর্শনীয় ধ্বংসাবশেষের তালিকায়, এখন যোগ হয়েছে এর অর্থনীতি। মিসরীয় পাউন্ড গত বছর অর্ধেক মূল্য হারিয়েছে এবং ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ-কার্যকরি মুদ্রার স্থান পেয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি সরকার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তৃতীয়বারের জন্য এর অবমূল্যায়ন করেছে। দেশটির রাজস্বের প্রায় অর্ধেক এখন যায় ঋণ পরিশোধে, যা জিডিপির ৯০ শতাংশের সমান। মিসরের আনুষ্ঠানিক, মুদ্রাস্ফীতি ২১ শতাংশ। তবে বাস্তবে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো অনেক বেশি। বিশেষভাবে খাবারের দাম অস্বাভাবিক দ্রæত বাড়ছে। কায়রোবাসীরা বলছেন, ‘আমরা এখন কেনাকাটা করতে গিয়ে তিন কেজির পরিবর্তে, এক কেজি বা আধা কেজি কিনতে বাধ্য হই।’

সরকারি পরিসংখ্যানের সাথে মিসরের অর্থনৈতিক অধঃপতনের তালমিল খুব কমই পাওয়া যায়। দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ দৈনিক দুই ডলারও খরচ করার সামর্থ্য রাখে না। আর এক তৃতীয়াংশ তাদের সাথে যোগদানের দ্বারপ্রান্তে। মিসরের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং সরকারি অব্যবস্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সমস্যার ফল- যা সাম্প্রতিক বাহ্যিক সঙ্কট কোভিড-১৯ মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্বমন্দার হুমকির সাথে মিলিত হয়েছে। এই পরিস্থিতির মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। কোভিড মহামারী দেশটির অন্যতম অর্থ উপার্জনকারী পর্যটন শিল্প ধ্বংস করেছে। তারপর ইউক্রেনের যুদ্ধ বিশ্বের বৃহত্তম গম আমদানিকারক দেশটিতে গম সরবরাহ ব্যাহত করে।

২০১৪ সাল থেকে, রাষ্ট্রপতি সিসির নেতৃত্বে সরকার, ২৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম, চালকবিহীন মনোরেলসহ জাতীয় ‘মেগা-প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কথা প্রচার করেছে। আর ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কায়রোর কাছে নতুন প্রশাসনিক রাজধানী শহর তৈরি করছে। এগুলো দেশে কৃত্রিমভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। অনেক প্রকল্পে সেনাবাহিনীর বিশাল অর্থ উপার্জনের ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ককে যুক্ত করা হয়েছে।

এই জাতীয় নীতিগুলি, মিসরের রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দেয়, বেসরকারি খাতকে হতাশ করে, বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে এবং দেশটিকে বিদেশী ঋণের ওপর আরো নির্ভরশীল করে তোলে। এভাবে মিসরের বিদেশী পাওনা ১৫৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। আর জাতীয় আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সেই বিদেশী ঋণের দায় শোধে চলে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ রাবাহ আরেজকি গত ১৮ জানুয়ারি লিখেছেন, এই সব কারণ একত্রিত হয়ে সম্প্রতি মিসরকে ‘একটি আর্থিক ও অর্থনৈতিক অতল গহ্বরের দ্বারপ্রান্তে’ নিয়ে এসেছে। পরিস্থিতি এমন যে ডয়েচ ভ্যালের মতো গণমাধ্যমও প্রশ্ন তুলেছে, অর্থনৈতিক সঙ্কটে মিসর ‘নতুন লেবানন’ হতে যাচ্ছে কি না।

লেবানন সিনড্রম মিসরে
লেবাননের অনেক আলামত মিসরে দেখা দিতে শুরু করেছে। খাদ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে, বেতন অর্ধেক হয়েছে। আর ব্যাংকগুলো টাকা উত্তোলন সীমিত করে দিয়েছে। এখন লেবানিজদের মতো একই সমস্যার মুখে মিসরীয়রা। তবে ১০ কোটির বেশি মানুষের দেশে যদি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, তাহলে ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে পারে।
লেবাননে, হতাশ স্থানীয়রা কেবল তাদের নিজের সঞ্চয় তুলে নেয়ার জন্য ব্যাংক লুট পর্যন্ত চলে গেছে, শহরগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত, কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর মত জ্বালানি নেই। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ঋণের চক্রে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মিসরে পরিস্থিতি এখনো অতদূর যায়নি। কিন্তু কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করছে, মিসর কি শিগগিরই ‘নতুন লেবানন’ হয়ে উঠতে পারে? হ্যাঁ, দুই দেশের তুলনা হয় না, তবে মিসর এবং লেবাননের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মিসরীয় দারিদ্র্যের মাত্রা লেবাননের কাছাকাছি যেখানে মিসরীয়দের অন্তত ৬০% দারিদ্র্যসীমায় বা এর কাছাকাছি বাস করে।

কানাডার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক রবার্ট স্প্রিংবর্গ, লিখেছেন, ‘চরমভাবে ব্যর্থ লেবাননের অর্থনীতি এবং দুর্দশার সাথে লড়াইরত মিসরের অর্থনীতির মধ্যে এখন উল্লেখযোগ্য মিল সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘লেবাননে আত্মবিশ্বাসের কারণে পতনের পরিণতিগুলো ধ্বংসাত্মক হয়েছে, তবে মিসরীয় স্কেলে এর পুনরাবৃত্তি হলে সেটিও প্রায় তুচ্ছ হয়ে যাবে।’

মিসরের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ এবং মধ্যপ্রাচ্য নীতির জন্য তাহরির ইনস্টিটিউটের পলিসি ফেলো টিমোথি কালদাস বলেছেন, ‘দুই দেশের রাজনৈতিক অভিজাতদের রাষ্ট্র এবং জনসাধারণের টাকায় নিজেদের সমৃদ্ধ করার ইচ্ছা আছে। এটি অবশ্যই এমন কিছু যা দুটি দেশ ভাগ করে নেয়।’

কার্নেগি ইনস্টিটিউটের ইয়েজিদ সাইঘ বলেছেন, ‘কিছু মিল থাকা সত্ত্বে ও দারিদ্র্য এবং দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো অনেক আরব দেশে অভিন্ন, তাই আপনি সহজ তুলনা টানতে পারবেন না। এ ছাড়াও, মিসরীয় সরকার লেবাননের মতো একইভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তার সব সমস্যার পরও, মিসর মৌলিকভাবে লেবাননের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল রয়েছে। এটি লেবাননের মতো পুরোপুরি পতনের দ্বারপ্রান্তে নয়।’

কালদাস উল্লেখ করেছেন, ‘ সুয়েজ খাল, পর্যটন শিল্প এবং বিভিন্ন রফতানি শিল্পের জন্য, মিসরের অর্থনীতিতে লেবাননের তুলনায় নগদ অর্থের বেশি সম্ভাব্য উৎস রয়েছে। লেবানন বিদেশী নগদ অর্থের জন্য তার প্রবাসী সম্প্রদায় থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল; বর্তমান সঙ্কটের আগে, এটি লেবাননের জাতীয় আয়ের এক-চতুর্থাংশের সমান ছিল।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘তবে সম্ভবত মিসর এবং লেবাননের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো যে মিসরকে সাধারণত ‘ব্যর্থ হওয়ার জন্য খুব বড়’ হিসেবে দেখা হয়। প্রায় ১০.৭ কোটি বাসিন্দা নিয়ে এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনবহুল জাতি। এর সাথে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। যা মিসরকে ভাগ্যবান করে তোলে তা হলো যে যতই খারাপভাবে পরিচালিত হোক না কেন বাইরের সমর্থকরা রাষ্ট্রের কার্যকারিতাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেয় ।’

আইএমএফের খড়গ
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মিসরের জন্য ৩-বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করে। এটি ২০১৬ সাল থেকে আইএমএফের সাথে দেশের তৃতীয় এ ধরনের ব্যবস্থা। আর এটি মিসরকে বিদেশ থেকে আরো বিনিয়োগের পাশাপাশি আরো আর্থিক সহায়তা আকর্ষণ করতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চুক্তিটি সম্পন্ন করতে মিসরীয় সরকারকে আইএমএফের কাছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দিতে হয়েছে। এর একটি হলো, বৈদেশিক মুদ্রার হারকে আরো নমনীয় করা যা মিসরীয় পাউন্ডের রেকর্ড-ব্রেকিং অবমূল্যায়নের দিকে পরিচালিত করে। আইএমএফের আরেকটি চাহিদা এই মাসের শেষের মধ্যে ৫০ লাখ হতদরিদ্র মিসরীয় পরিবারে সরাসরি নগদ স্থানান্তর পাঠানোর প্রতিশ্রতি বন্ধের সাথে জড়িত। কায়রোর আরো একটি প্রতিশ্রুতি ছিল মিসরীয় সামরিক বাহিনীর বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের লাগাম টেনে ধরা। অনেকের মতে, ‘এটি হতে পারে, শ্বাসরুদ্ধকর। কিন্তু, এটি বিশুদ্ধ মেক-বিলিভও হতে পারে।’

গত অক্টোবরে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলার লক্ষ্যে আয়োজিত এক অর্থনৈতিক সম্মেলনে আল-সিসি অঙ্গীকার করেন যে, জাতীয় প্রকল্পগুলো অব্যাহত থাকবে এবং সামরিক বাহিনী তাতে সক্রিয় থাকবে। তার এ বিবৃতি ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত আইএমএফের রিপোর্টের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক, যেখানে বলা হয়, মিসর সরকারি বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা সীমিত করতে সম্মত হয়েছে।

কালদাস বলেছিলেন, ‘নতুন আইএমএফ বেলআউট মিসরকে আবারো দুর্দশার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে তবে এটি নাগরিকদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সত্যিকারের স্বস্তি দিতে পারে কি না বলা কঠিন। মিসরের পরবর্তী লেবানন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে দুর্দশাগ্রস্ত অনেক মিসরীয় আগামী বছরে আরো দরিদ্র হতে চলেছে। অনাগত বছরে মিসরীয়দের জন্য ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কষ্ট রোধ করতে কিছুই হবে না।’

মিসরের এখনকার বাস্তবতা হলো, অনেক আমদানী করা পণ্য আর পাওয়া যাচ্ছে না। কায়রোর একটি জনপ্রিয় স্ট্রিট ক্যাফেতে একজন গ্রাহক বলেছেন, ‘দেশটি মুক্ত পতনের মধ্যে রয়েছে।’ সঙ্কটের জন্য দায়ী হিসেবে অনেক মিসরীয় রাষ্ট্রপতি আল-সিসির দিকে আঙুল তুলছেন। আল-সিসি অবশ্য অর্থনীতির সমস্যার জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন।

মিসরীয় ইনিশিয়েটিভ ফর পার্সোনাল রাইটসের অর্থনীতিবিদ ওয়ায়েল গামাল জাতীয় প্রকল্পগুলোকে বর্ণনা করেছেন ‘শ্বেতহস্তি’ হিসেবে। তারা টাকা খায়, কিন্তু তাদের প্রকৃত মূল্য নেই। তারা মহিমান্বিত দেখায়, কিন্তু ভেতর থেকে ধ্বংস করে।’ গামালের মতে, ‘জাতীয় প্রকল্পগুলো যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। এসব নেয়ার পেছনে খুব দুর্বল অর্থনৈতিক যুক্তি আছে এবং টেকসই চাকরি এসবে তৈরি হয় না।’

সরকার অবশ্য বলছে, মেগাপ্রকল্পগুলো মিসরের উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক, আল-সিসি গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ব্যাপারে তার আপত্তি প্রকাশ করেন, কারণ তা প্রকল্পের গতি বাধাগ্রস্ত করবে। এই মাসের শুরুর দিকে, তিনি স্বীকার করেন যে, মিসর একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিসরীয়দের তিনি সতর্কও করে দেন যে, তারা শুধু অর্থনীতির বিষয়ে কথা শুনবে এবং রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়েছে এমন ‘অসত্য’ কথায় বিশ্বাস করতে পারবে না।

সিসির বৈধতার একটি বড় অংশ মেগাপ্রকল্পগুলোর ‘ওয়াও ফ্যাক্টর’ থেকে উদ্ভূত। অর্থনীতিবিদ রবার্ট স্প্রিংবর্গ গত বছর এক নিবন্ধে বর্ণনা করেছেন, মেগাপ্রকল্পগুলো জনগণকে বিশ্বাস করাবে যে আল-সিসি একটি নতুন, সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী মিসর তৈরি করছেন।

প্রশ্ন হলো, মিসর যদি আইএমএফ-নির্ধারিত সংস্কারগুলো অনুসরণ না করে এবং সামরিক কোম্পানিগুলো সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে মেগা প্রকল্পগুলোতে অর্থ ঢালতে থাকে তাহলে কী ঘটবে? সালেম বিশ্বাস করেন, আইএমএফের শর্তগুলো তত্ত্বগতভাবে ভালো, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য নয়, কারণ সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায় না। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কিভাবে নিশ্চিত করতে পারেন যে সামরিক বাহিনী অর্থনীতির বাইরে চলে যাবে? বাস্তবে আইএমএফের সেই ক্ষমতা কি আছে? অন্য দিকে কালদাস বিশ্বাস করেন যে আইএমএফের লিভারেজ আছে। তার মতে, ‘মিসরকে উপসাগরীয় এবং আইএমএফ থেকে অর্থায়নের ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে আইএমএফকে সত্যিকার অর্থেই জোর দিতে হবে।’

কায়রোর পথে ঢাকা!
লেবাননের সাথে অনেকে মিসরের তুলনা করেছেন। এখন মিসরের সাথে কি বাংলাদেশের তুলনা করা যাবে? অনেক ক্ষেত্রে যাবে, কিছু ক্ষেত্রে যাবে না। মিসরের মতোই বাংলাদেশে একের পর এক মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এটি করতে গিয়ে মিসরে ১০ বছরে বিদেশী ঋণ চার গুণ হয়েছে, বাংলাদেশে হয়েছে তিন গুণ। সিসির মেগা প্রকল্পে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, প্রকৃত অর্থনীতি বা কর্মসংস্থানের কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাষ্ট্রের অবকাঠামো বিক্রি বা বন্ধক রেখে বিদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সিসি উন্নয়ন দেখিয়েছেন জাতিকে। কায়রোর তাহরির স্কয়ারের কাছে, রাস্তার ধারে আল-সিসির প্রতিকৃতিসহ অসংখ্য সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় থাকা বছরগুলোকে উল্লেখ করে তাতে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘আট বছরের অর্জন : নতুন সেতু, রাস্তা, রেলপথ এবং শহর।’ ঢাকার সাথে এর অনেক ক্ষেত্রে হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। সিসি তার শক্তিধর সেনা বাহিনীকে নিরাপত্তা রক্ষার মূল কাজ থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বাণিজ্যে আরো বেশিভাবে টেনে এনেছেন। অনেকে বাংলাদেশে একই প্রবণতা দেখতে পান। আইএমএফ মিসরে এ ধরনের সম্পৃক্ততা বন্ধের শর্ত দিয়েছে। তবে বাংলাদেশে এটি ঘটেছে বলে জানা যায় না।

মিসরে লেবাননের মতো ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা উত্তোলনে সিলিং করে দেয়া শুরু হয়েছে। সেখানে ব্যাংকে গ্রাহকরা আমানতের টাকা প্রয়োজনে তুলতে পারছেন না। বাংলাদেশেও অনেকে একই অবস্থা সৃষ্টির আলামত দেখতে পাচ্ছেন। মিসরে আইএমএফের চাপে বিনিময় হার মুক্ত করতে গিয়ে পাউন্ডের দাম ডলারের বিপরীতে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে আইএমএফ আসার আগেই টাকার মান ২১ ভাগ কমেছে। অদূরভবিষ্যতে ডলারের দাম এ হারের দুই বা তিন গুণ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইএমএফের পরামর্শে ভর্তুকি তুলে দিতে গিয়ে তিন রুটির দামে এক রুটি নিয়ে ঘরে ফিরতে হচ্ছে মিসরীয়দের। শিল্পে গ্যাসের দাম পৌনে ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর এবং বিদ্যুতের দাম মাসের এভাগে ওভাগে বৃদ্ধি শুরু করার পর সেই পরিস্থিতি ঢাকার লোকজনও দেখতে শুরু করতে পারেন শিগগিরই। সিসি কায়রোর অদূরে নতুন রাজধানী নির্মাণ করছেন, আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ করছেন। খরচ জোগান দিতে সৌদিদের কাছে দ্বীপের মালিকানা ছেড়ে দিয়েছেন। ঢাকার অদূরে পদ্মার এপার বা ওপারে নতুন একটি শহর নির্মাণের পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। সেটি নতুন রাজধানী বা প্রশাসনিক রাজধানী হবে কি না জানা যায়নি।

সবশেষে একটি চুটকির কথা মনে পড়ল, ‘এক ডাকাত একজন সুসজ্জিত লোককে ধরে তার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে চিৎকার করে বলছিল, ‘তোমার সব টাকা আমাকে দাও!’ লোকটি উত্তর দিলো, ‘তুমি কি জানো না আমি কে? আমি একজন এমপি!’ ডাকাত জবাব দিলো, ‘তাহলে আমার সব টাকা আমাকে দাও!’

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement