১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্বাধীন চিন্তাচর্চা, মতপ্রকাশের দায়িত্ব ও কর্তব্য

স্বাধীন চিন্তাচর্চা, মতপ্রকাশের দায়িত্ব ও কর্তব্য। - ছবি : নয়া দিগন্ত

স্বাধীন চিন্তাচর্চার অধিকার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মতামত প্রকাশের অধিকার, এখতিয়ার ও দায়িত্ব কর্তব্য প্রায় সব ধর্ম, মত ও পথে স্বীকৃত। ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের আর্টিকেল-১৯-এ স্বাধীন চিন্তাচর্চা ও মতপ্রকাশের অধিকার স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (৬৮২-৭২০) এবং আল মামুনের (৭৮৬-৮৩৩) রাজত্বকালে রাষ্ট্রীয় পদাধিকারের বৈধতার প্রশ্নের বিতর্ক করার অধিকার ছিল সব নাগরিকের- এমনকি খলিফার সামনে।

নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধানের ওপর জোর দিতে গিয়ে সত্য ভাষণে সক্রেটিস অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এর ওপর সমালোচনা প্রতিবাদ, যুক্তি তর্কানুমোদিত বাণী প্রচার করে গেছেন পরবর্তীকালের প্রাজ্ঞজনরা। তারা বলে গেছেন, জনগণের নির্বাচিত প্রশাসক শাসনকার্য চালানোর ক্ষেত্রে জনমতের প্রতি থাকবেন শ্রদ্ধাশীল। নির্দিষ্ট বিধান বহির্ভূতভাবে শাসনকাজ পরিচালিত হলে নাগরিকদের তার প্রতিবিধান প্রার্থনার অধিকারের স্বীকৃতি আছে ইসলামেও। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর জনগণের উদ্দেশে প্রদত্ত প্রথম বক্তৃতাতে বলেছিলেন- ‘লোক সব! আমি আপনাদের প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছি যদিও আমি আপনাদের মধ্যে খুব বেশি উপযুক্ত নই। যদি আপনারা আমাকে সঠিক ও সত্যপথে প্রশাসনকার্য চালাতে দেখেন তাহলে আমাকে সহায়তা করবেন। আর যদি বিপথগামী হতে দেখেন তাহলে আমাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনবেন। যতক্ষণ আমি সত্য ও সঠিক পথে থাকব ততক্ষণ আমাকে মান্য করবেন। বিপথগামী হলে আপনাদের প্রশাসনে আমার অধিকার থাকবে না ইসলামে নেতার নির্দেশ মান্য ও অনুসরণের উপরও তাগিদ রয়েছে। ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ সা: বলেছেন, নেতার আদেশ শোনা ও পালন করা অবশ্য কর্তব্য। চাই তা পছন্দ মতো হোক বা না হোক। তবে তা যেন নাফরমানি কাজের জন্য না হয়। যখন নাফরমানিমূলক কোনো কাজের আদেশ দেয়া হয় তখন তা পালন করা যাবে না।

বিদায় হজের ভাষণে নবী বলেছিলেন, ‘কোনো কাফির ক্রীতদাসকেও যদি তোমাদের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় এবং সে যদি কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক তোমাদের পরিচালনা করে তাহলে অবশ্যই তোমরা তাকে মান্য করবে।’ বস্তুত কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত প্রশাসনব্যবস্থা অনুসরণের নির্দেশনায় কল্যাণ নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি ইসলাম ও গণতন্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্কে তাৎপর্যকে তুলে ধরে। কুরআনে আল্লাহ ঈমানদারদের বলেছেন তারা কোনো বিবাদ-বিসংবাদে আপতিত হলে কুরআনের আলোকে বিচার করবে। এ ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসী। যা পূর্ণতা লাভের এটিই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। ফয়সালার অধিকারী (উলু আল আমর মিনকুম) বলতে তাদের বোঝায় যারা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানবেত্তার জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ এবং প্রশাসন ক্ষমতায় দক্ষ। হজরত উমর রা: জনগণকে একদা বলেছিলেন, আপনারা যদি বিপথগামী হতে দেখেন তাহলে আমাকে সোজা পথে আনবেন। এক আরব এ সময় দাঁড়িয়ে বললেন, যদি আমরা আপনাকে পথভ্রষ্ট হতে দেখি তাহলে তলোয়ার দিয়ে আপনাকে পথে আনব। এ কথা শুনে উমর রা: বলেছিলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমি এমন লোকদের প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছি যারা পথভ্রষ্ট উমরের মতো লোকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে জানে।’

বস্তুত ইসলামই আধুনিক গণতন্ত্রের মূল দর্শন, নিয়ামকের মূল্যবোধ ও প্রেরণার উৎস। পরিতাপের বিষয়, ইসলামকে পাশ্চাত্য বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ বানানোর প্রয়াস চলছে। ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তি, শিক্ষা ও আদর্শের অধ্যয়ন, চর্চা ও এর তাৎপর্যগত দিক তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই।
এ ব্যাপারে অধিকতর চিন্তা-চেতনা ও উপলব্ধির জন্য মানুষের স্বাভাব চরিত্রের পরিবর্তন প্রসঙ্গে আমাদের নবী সূরা ইয়াসিনকে কালব উল কুরআন বা কুরআনের হৃৎপিণ্ড আখ্যা দিয়েছেন। সূরাটির ১২ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- ‘আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্মকাণ্ড কীর্তিগুলো লিপিবদ্ধ করি যা তারা পূর্বাহ্নে প্রেরণ করে।’ মৃতদের জীবিত করার কথা বলার পরপরই পূর্বাহ্নে প্রেরিত কর্ম ও কীর্তিগুলো লিপিবদ্ধ করার কথা উল্লেøখের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট করা হয়েছে, মানুষ দুনিয়াতে যত সব ভালো-মন্দ কাজ করে তা এখানেই শেষ হয়ে যায় না; বরং এগুলো তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সম্বল হয়ে তাদের পর জীবনে সাক্ষাৎ ঘটবে। এটি সৎকর্ম হলে তারা বেহেশতবাসী হবে আর অসৎকর্ম হলে দোজখে বসবাস সাব্যস্ত হবে। কর্ম ও কীর্তিগুলো লিপিবদ্ধ করার আসল উদ্দেশ্য হলো সংরক্ষণ করা, এটি একটি অন্যতম উপায় এ জন্য যে, এর ফলে ভুল-ভ্রান্তির ও কম-বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
কর্মগুলোর মতো কর্মের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও হিসাবে আনা হয় বলে আয়াতটিতে স্পষ্ট করা হয়েছে। যেকোনো কর্মের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তথা ফলাফল যা পরবর্তীকালে প্রকাশ পায় কিংবা টিকে থাকে তাও হিসাবায়িত হবে। তাফসিরকাররা ব্যাখ্যা করেছেন, মানুষের যেকোনো কর্মকাণ্ড জনহিতকর কিংবা অকল্যাণকর তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যত দিন চলতে থাকবে তত দিন পর্যন্ত তার আমলনামায় তার সওয়াব বা গোনাহ অথবা এর ফলাফল তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। কেউ যদি শিক্ষাদান, বিধিবিধান প্রণয়ন কিংবা পুস্তক প্রণয়ন করে মানুষের মূল্যবোধের উত্তম বিকাশের সহায়তা করে, তার জনহিতকর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানবতা উপকৃত হয়, তা হলে তার ক্রমপুঞ্জীভ‚ত কল্যাণ তার প্রাপ্য হবে আবার কেউ যদি নিপীড়নমূলক আইন-কানুন প্রবর্তন করে কিংবা এমন কোনো প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে যা মানুষের আমল-আখলাককে ধ্বংস করে দেয়, তবে এই মন্দকর্মের ফলাফল ও প্রভাব যতদিন এটি বলবৎ থাকবে ততদিন এটি তার আমলনামায় লিখিত হতে থাকবে।

নবীজী নিজে এই আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য- যে ব্যক্তি কোনো উত্তম প্রথা প্রবর্তন করে, তার জন্য রয়েছে এর সওয়াব এবং যত মানুষ এই প্রথার ওপর আমল করবে তাদের সওয়াব, অথচ আমলকারীদের সওয়াব মোটেও হ্রাস করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কোনো কুপ্রথা প্রবর্তন করে, সে তার গোনাহ ভোগ করবে এবং যত মানুষ এই কুপ্রথা পালন করতে থাকবে, তাদের গোনাহও তার আমলনামায় লিখিত হবে অথবা পালনকারীদের গোনাহ হ্রাস করা হবে না।

আমরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়কে সীমিত ও খণ্ডিত অর্থে উপলব্ধি করি। কে কিভাবে কোন বিষয়কে গ্রহণ করবে কিংবা মূল্যায়ন করবে তা অনেকখানি নির্ভর করে তার নিজের শিক্ষা, পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার ওপর। সে কারণে উপযুক্ত শিক্ষা, উন্নত পরিবেশ ও মুক্তবুদ্ধির বিকাশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জীবন যাপনে বিভিন্ন মূল্যবোধের প্রয়োগ ও প্রকাশে। কুরআনের কয়েকটি সূরা নামাজে পাঠ করা হয় সেগুলোসহ কুরআনের সব বাণীই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু নামাজে সেগুলো পাঠের সময় কিংবা অন্যান্য সময় সেগুলোর আবৃত্তি উচ্চারণের সময় সাধারণ শব্দগত অর্থটি মনে আসে এবং মনের ভাব সেভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু এ গুলোর যে গুরুত্ব ও তাত্ত্বিক ব্যাপক অর্থ এবং প্রতিক্রিয়া রয়েছে তা মালুম হয় না সব সময়। কখনো কখনো হয় বিশেষ পরিস্থিতির কারণে। আল্লাহর বাণীর অন্তর্নিহিত অর্থ, তাৎপর্য এবং মানব মন ও শরীর জগতে জীবনের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবকে সীমিত দৃষ্টিতে দেখার কারণেই আমরা একে অনেক সময় শুধু পাঠ করার দরকার তাই যেন পাঠ করি।

কোনো কোনো কথা বা বাক্য উচ্চারণের উদ্দেশ্য শুধু উচ্চারণ হলে চলে না। তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও ব্যাপ্তিকে যথাযথ মূল্যায়ন দিতেই তা করা উচিত। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং মোহাম্মদ সা: তাঁর প্রেরিত রাসূল। এটি কালেমা। একটি কথা হরহামেশা আওড়াই আমরা কিন্তু এর তাৎপর্য যদি সত্যিই আমরা হৃদয়ঙ্গম করি তাহলে আমাদের সব কাজ ও পদক্ষেপে তার প্রতিফলন হওয়া উচিত। আমরা যখন এ বাক্য পাঠ করি তখন হয়তো আল্লাহর ওপর পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস রাখি, চেষ্টা করি মনোনিবেশে। আবার অন্য চিন্তায়ও মশগুল থাকছি। আমরা অনেক সময় অনেককে বলছি ‘হ্যাঁ ভালো আছি’ খোদার ফজলে, এটি যেন স্বগতোক্তি হয়ে যাচ্ছে, শুধু বলেই যাচ্ছি, অথচ মনে মনে পোষণ করছি অনেক কথা। কাউকে হয়তো বলছি হ্যাঁ তোমার ভালো হোক কিন্তু মনে থেকে যাচ্ছে হয়তো অন্য ইচ্ছা। কাউকে যখন কোনো কথা দিচ্ছি তখন এক ধরনের হালকা ভাবার্থ হিসেবে দিচ্ছি। এটি যথার্থ নয় কোনো অবস্থাতেই। চলনে ও বলনে অবশ্যই সামঞ্জস্য থাকতে হবে। উপলব্ধি করেই কথা বলতে হবে। যা বলা হবে তার অর্থ থাকা উচিত। আর তা হলে কথার মূল্য বাড়বে, কথার তাৎপর্য বোঝা যাবে। চিন্তা স্বচ্ছ হবে। সুদৃঢ় হবে পদক্ষেপ। স্বচ্ছ হবে দ্বীন।

আমরা মুনাজাতে বলছি, ‘হে আল্লাহ! আমাদের আত্মার ওপর আমরা অনেক জুলুম করেছি, তুমি আমাদেরকে না দেখলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো, তুমিই তো শ্রেষ্ঠ তওবা কবুলকারী রাহমানুর রাহিম’। এ মুনাজাত নিত্যদিনে সেরা মুনাজাত। কিন্তু সাথে সাথে এটি বোঝার চেষ্টা করছি যে, কেন কিভাবে আত্মাকে কলুষিত করছি এবং ভবিষ্যতে আত্মা যাতে কলুষিত না হয় সে চেষ্টায় প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা কি করছি? যদি না করি তা হলে এ প্রার্থনা তো অন্তঃসারশূন্য হয়ে গেল। এটা তো হয়ে গেল বেখেয়াল কপটতার শামিল। আমি ভুল করেছি আর করব না কথাটি শুধু কথার কথা হলে এ উচ্চারণে কোনো ফায়দা হবে না। ভুল যাতে আর না হয় সে জন্য সচেতন প্রতিজ্ঞা থাকা চাই। প্রতিজ্ঞা নিজের কাছে আর তা অর্জনে আত্মার সাহায্য প্রার্থনা। সাহায্য তখনই যথাযথভাবে পাওয়া যেতে পারে যখন সে প্রার্থনায় আন্তরিকতা থাকে। সুতরাং স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশসহ সব কথায় এবং কাজে আন্তরিকতা থাকতে হবে, যথাযথা উপলব্ধি থাকতে হবে।

লেখক : সমকালীন আর্থসামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement