১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

মাদকের বিরুদ্ধে ‘নতুন যুদ্ধ’

লেখক : ড. মাহবুব হাসান -

আমি কী মাদকে আসক্ত? নিজেকেই প্রশ্ন করি। কারণ আমি তো জানিই না আমি বা আমরা আসক্ত কিনা মাদকে? মাদক হিসেবে যেগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো আমার চারপাশেই তো আছে। মাদকে আসক্তি না থাকলেও আমাদের অনেকেই দলান্ধ রাজনীতিতে আসক্তি আছে, যা অন্ধত্ব বরণের অন্যতম কারণ। মদ আর গাঁজাকেই মাদক হিসেবে জানতাম অতীতে। এখন ওই দু’টি পণ্য ছাড়াও ছিল ওষুধ উৎপাদনের উপাদানের গাছ অপিয়াম বা পপি। পপি প্রসেস করে হেরোইন পাউডার তৈরি করা হয়।

সেই পাউডার পৃথিবীর সব থেকে ভয়ঙ্কর মাদকদ্রব্য। আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার কোকো বা কোকেন পাউডারও একই রকম ভয়ঙ্কর মাদক। আমাদের দেশে গাঁজা আর আমেরিকার মারিয়ুয়ানা বা মারিজুয়ানা একই জিনিস। মূলত এগুলোই ড্রাগ বা মাদক। কিন্তু ওষুধ হিসেবে আসা অনেক প্রডাক্টই আজ মাদক। ফেনসিডিল, ম্যানড্রেক্স ইত্যাদি তাদের দু’টি। ইদানীং মানে তাও প্রায় ১০-১৫ বছর হতে চলল ইয়াবা নামের ট্যাবলেট মাদক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে উচ্চমাত্রায়। এসব মাদকের থাবায় লাখ লাখ মানুষ, তাদের বেশির ভাগই যুবক, আসক্ত হয়ে মারাত্মকভাবে শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) বলেছে, সারা দেশে ৭০ লাখ মাদকাসক্ত থাকলেও তাদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এক লাখ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদেরই প্রথমে কার্যক্রমের আওতায় আনছে ডিএনসি। বাকি ৬৯ লাখই আপাতত কার্যক্রমের বাইরে থাকছে। মাদকের বিরুদ্ধে এই নতুন যুদ্ধের সূচনা একটি নৈতিক ও মানবিক উদ্যোগ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই উদ্যোগ যদি ৭০ লাখের বিপরীতে এক লাখ সংশোধন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্য হয়, তাহলে এই কার্যক্রমকে কি বাহবা দেয়া যায়? নাকি এই সূচনাকে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা’ও ভালো- এই লোকজ বোধনের দৃষ্টিতে দেখলে তাকে ভালো উদ্যোগ বলেই মার্ক করা যায়। মাদকের করাল থাবায় দেশটি রাতারাতিই এমনটি হয়নি।

স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখে আসছি মাদকের উত্তরোত্তর ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়টি। মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ কী তা খুঁজে বের করতে পারবেন এই বিষয়ের গবেষকরা। তবে, সাদা দৃষ্টিতে আমরা বুঝি যে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের হাত ধরে সমাজে যে অনৈতিক কাজের প্রসার ঘটেছে তারই সুতো ধরে নেমে আসে এই অমানবিক বিপর্যয়। ’৭২ সালেই আমরা লক্ষ করি নানা বয়সী তরুণ, বিশেষকরে ছাত্র ও দরিদ্র মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। কাউকে কাউকে দেখেছি আমরা চোলাই, দেশী মদ, গাঁজা, ম্যানড্রেক্সসহ আরো কিছু মাদক ব্যবহারের ছড়াছড়ি।

সত্তরের দশকে কাশির লিকুইড ওষুধ ফেনসিডিল পরবর্তী দশকে তা নেশার উপকরণে পরিণত হয়। পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তলগ্ন এলাকায় হাজার হাজার ফেনসিডিলের কারখানা গড়ে উঠেছে এবং সে সবই চোরাইপথে বাংলাদেশে ঢুকছে। অতীতে কম থাকলেও বর্তমানে মিয়ানমারের মাদক হেরোইন পাচারের আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার সীমান্ত ব্যবহার হয়ে আসছে। সেই মাদকের একটি অংশ তো সারা দেশেই কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে।

আজকে সেই সীমান্তপথে আসছে কেমিক্যালাইজড মাদক আইস, ইয়াবাসহ আরো নানান নামের ভয়ঙ্কর মাদকপণ্য। সেই সাথে আসছে হেরোইন আর অস্ত্র। মাদকের প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য এতটাই যে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসন ও সামাজিক এবং রাজনৈতিক নেতারা। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যার পেছনেও ছিল মাদক ও অস্ত্রপাচারকারী চক্রের সশস্ত্র সদস্য। হাজার হাজার কোটি টাকার এই চোরাই মাদক ব্যবসার পেছনে সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের মদদ আছে, সে কথা গোয়েন্দারা যেমন বলেছে, তেমনি সংবাদপত্রের পাতায়ও রিপোর্ট এসেছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা মানুষ। মেজর সিনহা হত্যার পেছনেও আছে পুলিশের মাদক বাণিজ্যের অনৈতিক বিষয়। কারণ, মেজর সিনহা মানবাধিকার ও নারী উন্নয়নের কাজে ওই এলাকায় গিয়েছিলেন। আবার এই স্থানীয় ঘটনার পেছনে আছে অলিখিতভাবে সরকারি দলের আঞ্চলিক নেতাদের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য মদদ।

ডিএনসি মাদকাসক্তদের নিরাময়ের অনন্য-সাধারণ উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সীমান্ত এলাকার রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতাদের মাদক পাচারের সাথে জড়িয়ে পড়াটাও যে মারাত্মক আসক্তির অন্তর্ভুক্ত, সেটি কিন্তু সরকারি তরফ থেকে কখনোই চিহ্নিত করা হয়নি। মাদকপাচারে এমন আসক্তিই আমাদের মাদকবিরোধী কার্যক্রমকে সফল হতে দিচ্ছে না। সেই সাথে পুলিশ ও বিজিবির সীমান্তরক্ষককে নিরাময়ের ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব কে নেবে?

২.
ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, কমপ্র্রিহেন্সিভ অ্যাকশন প্লানের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ড্যাম-অ্যামস (অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড মোটিভেশনাল অ্যাক্টিভিটি মনিটরিং সিস্টেম) নামে বিশেষ অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে সব শ্রেণিপেশার মানুষ দেখতে পারবে, মাদক নিয়ন্ত্রণে কোন জেলায় ও উপজেলায় কী ধরনের সচেতনতামূলক কর্মশালা করা হয়েছে। সেই সাথে ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষ জানতে পারবে, তার এলাকায় কী ধরনের কর্মশালা করা উচিত। অধিদফতরও অ্যাপের মাধ্যমে কর্মশালা বাস্তবায়নের তথ্য নিতে পারবে। এ ছাড়া সারা দেশের মাদক কারবারিদের নাম ঠিকানা, কোথায় মাদক মজুদ আছে এবং কোথায় কোথায় মাদক কারবার চলছে- সে বিষয়ে তথ্য দেয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে তথ্য সরবরাহকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে। তথ্য পাওয়ার পর ডিএনসির আভিযানিক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে।

ডিএনসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু ধরপাকড় নয়, মাদকবিরোধী নতুন এ অভিযানে মাদকের সাপ্লাই, চাহিদা ও নিরাময় নিয়ে কাজ করা হবে। যারা এরই মধ্যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের সুপথে আনতে নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সারা দেশে ৭০ লাখ মাদকাসক্ত থাকলেও কার্যক্রম শুরুর জন্য এক লাখ মাদকাসক্তের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের আওতায় আসবে অন্যরাও। এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় কমিউনিটি, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কমিউনিটি পর্যায়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীরাই মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেবেন, কমিউনিটি পর্যায়ে সম্ভব না হলে প্রাইমারি পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হবে। তাতেও না হলে সেকেন্ডারি অর্থাৎ জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে পাঠানো হবে। যদি জেলাতেও না হয়, তাহলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে অথবা পাবনার মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হবে। এ কার্যক্রমের সাথে যে চিকিৎসক ও নার্সরা সম্পৃক্ত থাকবেন, তাদেরও বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবে ডিএনসি। ফলে যখন কোনো মাদকাসক্ত চিকিৎসা নিতে যাবে, সে আসক্তির কোন পর্যায়ে আছে, সহজেই বুঝতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পনা আছে- প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাদক নিরাময়ের জন্য আলাদা ওয়ার্ড খোলারও। (ভোরের কাগজ, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩)

ডিএনসি কর্তাদের এই কমপ্রিহেনসিভ অ্যাকশন প্লান নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের একটি ভালো পদক্ষেপ। যারা, অর্থাৎ ৭০ লাখ মানুষকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা ও পুনর্বাসনের জন্য কত বছর লাগবে, তার কোনো পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রোডম্যাপও বলা হয়নি। তাহলে কি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনন্তকাল ব্যয় করব আমরা? আনলিমিটেড সময়ের যুদ্ধের ফল ভালো হয় না।

ধরা যাক, ৭০ লাখ মানুষকে সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ১৫-২০ বছর লাগবে। কিংবা ধরা যাক পাঁচ-সাত বছর লাগবে। কিংবা দুই-তিন বছর লাগবে। এই সময়েও কি নতুন আসক্তের সংখ্যা বাড়বে না? যদি বলেন বাড়বে না, তাহলে কেন ও কিভাবে বাড়বে না, বা তা প্রতিরোধ করা হবে, কিভাবে সেই প্রতিরোধযুদ্ধটি চালানো হবে, তার রোডম্যাপ ও কার্যক্রম কোথায়? যদি বলেন আসক্ত বাড়বে, তাহলে সেই বাড়ার মূল কারণ কী? মূল কারণ অবশ্যই মাদকের সীমান্ত পেরিয়ে আসাই প্রধান। মাদকের তো আর হাত-পা নেই যে, চোরাইপথে হেঁটে আসবে। মানুষই তা বহন করে আনবে। সেই মানুষ মিয়ানমারের বা ভারতের আর তাদের সেই চোরাই মাদকপণ্য বা দ্রব্য এ পারে বহন করবে, সেই তারা কে বা কারা? আর বাংলাদেশ অংশে যারা মাদকপাচারে সংঘবদ্ধ তারা বা তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সীমান্তরক্ষীসহ স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের কাউন্সিলর বা আইন প্রয়োগের কাজে নিয়োজিত পুলিশ প্রভৃতির অপকর্মকে নস্যাৎ করতে অবশ্যই সরকার ও সামাজিক নেতাদের সহযোগ প্রয়োজন। এমনকি এক শ্রেণীর খুচরো ব্যবসায়ীও আছে, যারা কাঁচা-শাকসবজিসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্য পরিবহনের আড়ালে আইসসহ নানা নামের মাদক দেশের ভেতরে সরবরাহের কাজটি করে থাকে। এই যে চেইন অব ড্রাগ ট্রাফিটিং বা চলাচল, এই চলাচল কেন বন্ধ হয়নি? কেন সীমান্ত সিল করার কথা না বলে মাদকের বিস্তার ও ব্যবহারকারীদের নিরাময়ের কথা বা নিরাময়ের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে চান? এই উদ্যোগ ও আয়োজন অবশ্যই ভালো পদক্ষেপ, কিন্তু তার পাশে অবশ্যই সীমান্ত সিল করে দিতে হবে, যাতে একটি মাদক চালানও আসতে না পারে। এ ব্যবস্থা না নিলে মাদকের থাবা থেকে গরিব জনজীবন মাদকমুক্ত করা ও রাখা যাবে না।

না, মাদকের চোরাচালান বন্ধের কোনো রোডম্যাপ দেয়নি ডিএনসি। আসল কাজটি করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ডিএনসি। রোগের উৎপত্তি যেখানে তার গোড়া কেটে দেয়ার কোনো উদ্যোগ আয়োজন নেই, সারা গায়ে মলম লাগালেই কি রোগ নিরাময় হবে? এ বিষয়টি ভেবে দেখবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মাদকের চোরাই যাতায়াত সীমান্তেই বন্ধ করতে হবে। এই দায় সরকারের সীমান্তরক্ষীদের। তারা যদি ব্যর্থ হয়, সেই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নিতে হবে সরকারকে এবং দেশ ও জনগণকে জানাতে হবে তারা আর কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে মাদকের চোরাই যাতায়াত বন্ধে।

লোক বাংলায় কথাটি চালু আছে ‘যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়াবেন, সেই সরিষায় যদি ভূতের বাস হয় তা হলে ভূত তাড়াবেন কেমন করে? অর্থাৎ সীমান্তরক্ষক ও মাদক চোরাচালানিদের গলায় গলায় ভাব। তারই ফলে দেশজুড়ে মাদকাসক্ত মানুষ। এই মাদকের একটি রাজনৈতিক অভিঘাত আছে। রাজনীতিকদের একটি অংশ এই মাদকের মাধ্যমে উঠতি ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী এবং যুবশক্তিকে তাদের শিক্ষা ও আদর্শ থেকে চ্যুত করতে চায়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে জাতির মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিয়ে জাতিকে দুর্বল ও ডিরেইলড করে সাংস্কৃতিকভাবে পরাধীন করতেই এই মাদক সন্ত্রাসের অভিঘাত চলে কি চলে না?

ভেবে দেখুন, আমাদের রাজনীতিক ও সমাজ নেতারা কত বড় দেশপ্রেমিক। তারা কত বড় মানবসেবী। তাদের সেবা ও যত্নেই তো সমাজে আজ ৭০ লাখ মাদকাসক্ত। এর বাইরেও আছে। তবে তারা সরাসরি মাদকাসক্ত নয়। তারা অর্থাসক্ত। বৈধ কিংবা অবৈধ, যে পথেই আসুক না কেন, অর্থই তাদের কাছে দেশপ্রেমের মাপকাঠি।


আরো সংবাদ



premium cement