১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

এবারের গ্রীষ্মে ঘাম বেশি ঝরতে পারে

এবারের গ্রীষ্মে ঘাম বেশি ঝরতে পারে। - ছবি : সংগৃহীত

এখন শীতের সময়। নানারকম পেরেশানি থাকলেও মানুষের শরীর ঘামছে না। বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেছে। ঘরে ফ্যান, এসি চালাতে হচ্ছে না। তবে শীতকাল আকাশের রঙধনুর মতোই ক্ষণস্থায়ী। জানুয়ারি ফুরালেই কাঁথাকম্বল ফেলে শীতের বুড়ি বলবে যাই যাই। রাজধানীতে সবার আগে, তার পর গ্রামে। এবারের শীত গেলে দেশের মানুষকে মনে হয় একটু বেশিই ঘামতে হতে পারে। গ্রীষ্মে খুব গরম পড়বে বলেই শুধু না, আরো কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, যা জনজীবনে উত্তাপ ছড়াবে বলে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে।

হ্যাঁ, প্রথম কারণ অবশ্যই বিদ্যুৎ। সরবরাহ পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতির সম্ভাবনা কম। গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে গড়ে উৎপাদন আট হাজার মেগাওয়াটের মতো। গ্রীষ্মে চাহিদার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ বাড়বে, মনে হয় না। মার্চ-এপ্রিলের গরমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবে না মানুষ। কারণ দেশে গ্যাসের অভাব আছে। কয়লারও অভাব আছে। গ্যাসের অভাবে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বেশ কিছু দিন থেকেই বন্ধ। কয়লার অভাবে বন্ধ রামপাল কেন্দ্রের উৎপাদন। একই কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হতে পারে। রামপালের কয়লার মজুদ প্রান্তিক অবস্থানে। বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সঙ্কটে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির কর্তৃপক্ষ কয়লা আমদানির জন্য লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে পারছে না। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দাম বকেয়া আছে ১২ মাসের। আগামী গ্রীষ্মে লোডশেডিং মোকাবেলা করতে সরকার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন চালু রাখার পরিকল্পনা করেছিল। তার মধ্যে পায়রা ও রামপাল কেন্দ্রও ছিল। এ দু’টিতে উৎপাদন ব্যাহত হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। তাতে লোডশেডিং চরমে উঠতে পারে। তাতে শরীরে ঘাম একটু বেশি হতেই পারে।

শুধু বিদ্যুৎ পরিস্থিতিই আপনাকে ঘামিয়ে তুলবে, এমন ভাববেন না। শীতের পরই আসছে পবিত্র রমজান মাস। রোজার এ মাস স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি খরচের। ইফতার-সাহরির জন্য সবাইকেই কিছুটা হলেও বাড়তি ব্যয় করতে হয়। এবার সেটি কতটা বাড়বে, এখনই বলা মুশকিল। তবে লক্ষণ সুবিধার নয়। রোজা শুরু হবে মার্চের শেষ সপ্তাহে। এ সময় যেসব পণ্য বেশি বেশি কিনতে হয় সেগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে মাস চারেক আগে থেকে উদ্যোগ আয়োজন শুরু করা হয়। এবার নানা কারণে সেটি করতে পারেনি সরকার।

রোজার মাত্র দুই মাস আগে চলতি জানুয়ারিতে ব্যবসায়ীদের রোজার পণ্য আমদানির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ডলার সঙ্কটে তারা এলসি খুলতে পারছে না। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও রোজায় ব্যবহৃত ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর আমদানির ঋণপত্র (এলসি) না খুলেই আমদানির সুযোগ দিয়েছে। এই সুবিধা ৩১ মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকবে। বড় ব্যবসায়ীরা সুযোগটা নিতে পারছেন। অনেকে পারছেন না। ফলে আমদানিতে স্বাভাবিক গতি নেই। এর প্রভাব পড়বে রমজানে। এসব কারণে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রবণতাও এবার বেশি হবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

রোজা পালন শারীরিক দিক থেকে কষ্টের। দিন শেষে মানুষ অনেকটাই ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ে। তার ওপর আছে শ্রমসাধ্য তারাবিহ নামাজ। ধর্মপ্রাণ মানুষের বাড়তি ইবাদত-বন্দেগির মাস এটি। রাত জেগে অনেকেই ইবাদতে মশগুল থাকেন। সুতরাং রমজানে রোজাদারদের যেকোনো দিক থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি এবং বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে সব সরকার- যাতে মানুষের পেরেশানি কিছুটা হলেও লাঘব করা যায়। এবারে সঙ্গতকারণেই তাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। কারণ সব কিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে এমন বলার সুযোগ কমই। নেই বললেই চলে। শীতের সময় রাজধানীতে গ্যাসের সরবরাহ প্রতি বছরই কিছুটা ব্যাহত হয় কারিগরি কারণে। এবার তা তীব্র হয়েছে। রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় দিনে গ্যাস থাকে না। কোথাও গ্যাস থাকলেও চাপ এত কম যে, রান্না করা যায় না। রাত ১টা-২টার সময় গ্যাস এলে গৃহিণীদের রান্না করে রাখতে হয়। অনেকে বাধ্য হয়ে পকেটের টাকা খরচ করে বাইরে খেয়ে নেন। রোজার সময় এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে মনে করার কোনো কারণ নেই। যদিও গত সোমবার ভোলায় বিপুল গ্যাস প্রাপ্তির খবর প্রচার করা হয়েছে; কিন্তু সে গ্যাস সহসাই জাতীয় গ্রিডে আসবে না। ওই গ্যাস এলএনজি করে সরবরাহ করা হবে। তেমনই প্রস্তুতি নাকি চলছে।
পণ্যমূল্য এরই মধ্যে সাধারণের নাগালের বাইরে। রমজানে তা আরেক দফা বাড়বে, সন্দেহ নেই। সেটি মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন কেউ কেউ। খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, রোজায় আমদানি করা পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়বে। গত সোমবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের আয়োজনে এক মতবিনিময় সভায় তিনি ওই মন্তব্য করেন। সভায় কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা তাদের বক্তৃতায় বলেন, ‘আমদানি না হওয়ায় আদা-রসুনের দাম বাড়ছে। ভারত থেকে রসুন আমদানি বন্ধ ছিল। চীন থেকেও আমদানি হচ্ছে না। আদা-রসুন আমদানিতে এলসি স্বাভাবিক না হলে দাম আরো বাড়বে। ডলারের মূল্য অনেক বেড়েছে। ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। অনেক জটিল হয়ে গেছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এখন থেকে যদি পণ্য আমদানি করা না যায়, তাহলে রমজানে দাম বাড়বে’ (যুগান্তর, ২৪ জানুয়ারি-২০২৩)

সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ভোজ্যতেল, চিনি, ডালের দাম। বিদ্যুৎ গ্যাসেরও দাম। চাল, আটা, সয়াবিন, শিশুখাদ্যসহ প্রায় সব পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জ্বালানির দাম বাড়ায় বেড়েছে যাতায়াত ব্যয়ও। ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। দেশে এখনো পণ্যের ঘাটতি নেই, তার পরও পণ্যমূল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে। রমজানে বা আগামী গ্রীষ্মে বাজার পরিস্থিতি কোনোভাবেই সহজ হবে না; বরং অভিজ্ঞতা ও বাস্তব অবস্থা থেকে বলা যায়, অবনতির আশঙ্কাই বেশি।

এর বাইরে কৃষিজীবীদের জন্যও আছে খারাপ খবর। চৈত্র-বৈশাখ মাসে শুরু হবে আমনের মৌসুম। এবার এ মৌসুমে ইউরিয়ার অভাব দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে দেশে ইউরিয়ার সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা আছে। ইউরিয়া উৎপাদনের ছয়টি কারখানার মধ্যে দুটি আগে থেকে বন্ধ। গত সোমবার বৃহৎ কারখানা যমুনাতেও দুর্ঘটনার কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি তিনটিও আর্থিক লোকসানের পর্যায়ে সঙ্কটজনক অবস্থায়। কারখানাগুলোর উৎপাদনসক্ষমতা আগের মতো নেই। অর্থের অভাবে নিয়মিত ওভারহলিং, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারায় পুরোমাত্রায় উৎপাদন করা যায় না।

বিপুল ভর্তুকির অর্থ না পাওয়ায় ইউরিয়া কারখানা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন-বিসিআইসি বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়ার দাম বেড়েছে। দেশে ডলারের ঘাটতি চরমে। এলসি খোলার মতো ডলারের জোগানও দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে ইউরিয়া আমদানি করে সঙ্কট সমাধান কতটা করা সম্ভব তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, সরবরাহে ঘাটতি- এগুলোও সঙ্কটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

দেশে প্রতি বছর ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৬ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে ১০ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদন হয়। উল্লিখিত সমস্যার মুখে এ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কতটা পূরণ করা যাবে, বলা মুশকিল। লক্ষ্যমাত্রা যদি পূরণ হয়ও সেটি কৃষকের নাগালের মধ্যে থাকবে কি না তাতেও সংশয়। গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়ায় ইউরিয়ার উৎপাদন ব্যয় বর্তমানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২১ লাখ টন ইউরিয়া আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে আমদানি কঠিন হবে, সন্দেহ নেই। ইউরিয়া বা সারের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ওপর খাদ্যশস্য উৎপাদনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সার না পেলে কৃষক উৎপাদন করতে পারবে না। ফলন মার খাবে। একই অবস্থা ডিজেলের সরবরাহ নিয়েও। ডিজেল না পেলে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সেচ দেয়া যাবে না। বিদ্যুতের ঘাটতিও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। এ বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করতে না পারলে খাদ্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। এর ফলে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। সরকার বিদেশী সংস্থার কাছ থেকে ঋণ সহায়তার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। তবে সেই অর্থ পেতে এপ্রিল পেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এত কিছুর চাপ আপামর মানুষের ঘাড়ে চাপবে স্বস্তির শীতকালটা পেরোলেই। তাই এবারের গ্রীষ্মে যদি আপনার শরীর একটু বেশিই ঘামে, অবাক হবেন না। অবাক হওয়ার কিছু নেই; বরং মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলে গরম কিছুটা হলেও কম লাগবে এটি নিশ্চিত। সুতরাং মানসিক প্রস্তুতি নিন। এটি খুব জরুরি।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement