২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অপার্থিব তুলির আঁচড়

অপার্থিব তুলির আঁচড়। - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বাস মানুষের দেহ-মনে প্রশান্তির বারিধারা বইয়ে দেয়। মানবাত্মাকে দান করে অসামান্য দৃঢ়তা। দান করে অবিচল ও আলোকিত প্রত্যয়। সেই অবিনশ্বর পরশ পাথর জীবনকে করে তোলে মহিমান্বিত। পরম সত্যের গরিমায় হৃদয় লাভ করে বরাভয়। সেখানে ফোটে কল্যাণের হাজারো পুষ্প, সৌরভ ছড়ায় সবরের চামেলি, সন্তোষের গন্ধরাজ, খোদার প্রতি ভরসার সুগন্ধি গোলাপ...

মুমিনজীবনে খোদাবিশ্বাসের ভূমিকা কতটা ব্যাপক ও সুতীব্র, তার অসংখ্য নজির ছড়িয়ে আছে কালের পৃষ্ঠাজুড়ে। বিশ্বাসের দৃঢ়তা মুমিনজীবনকে কী অমেয় আলোকধারায় প্লাবিত করে, তার অজস্র উদাহরণ বিশ্বাসের প্রতি তাদেরকেও শ্রদ্ধাশীল করে, যারা বিশ্বাসী হতে পারেননি। ভলতেয়ারকেও তাই বলতে হয়, যদি খোদা নাও থাকেন, তবুও ভরসার জন্য একজন খোদাকে তৈরি করতে হবে। কিন্তু খোদার অস্তিত্বে, একত্বে ও গুণাবলিতে মুমীনের বিশ্বাস কোনো যদি বা কিন্তুর বহু ঊর্ধ্বে। সেই বিশ্বাস জীবনকে কী বিভূতি দেয়, তার একটি নজির লক্ষ্য করা যেতে পারে ব্রিটেনের লেডি ব্রান্সের ইসলাম গ্রহণের ইতিবৃত্তে।

উচ্চশিক্ষিতা শিল্পপতি এই ব্রিটিশ মহিলার স্বামী ছিলেন এক নওমুসলিম ইংরেজ সেনা অফিসার। আল্লামা ইকবাল বলেন, কোনো এক মামলায় লেডি ব্রান্স ও তার স্বামী আমার শরণাপন্ন হলেন। তাদের ওপর দায়ের করা মামলাটি ছিল ভিত্তিহীন, ফলে সহজেই তারা এ থেকে নিষ্কৃতি পেলেন। আদালত তাদের সম্মানজনকভাবে মুক্ত করে দিলেন।
আমি যেহেতু তাদের নিযুক্ত আইনজীবী ছিলাম, তাই কিছু দিন পরে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে লেডি ব্রান্স হঠাৎ দেখি লাহোর চলে এসেছেন। আমি তাকে অভিনন্দন জানালাম এবং প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করলাম, বোন, কোন জিনিসটি আপনাকে ইসলামের দিকে নিয়ে এলো? কোন সুন্দরের আকর্ষণে আপনি আজ মুসলমান?

লেডি বলেন, মুসলমানদের ঈমানের মজবুতি, মুসলমানদের সুদৃঢ় প্রত্যয়ই আমাকে মুমিন বানিয়েছে। আমার ধর্মান্তরের মূলে আছে এক বৈপ্লবিক ঘটনা। এক অবিশ্বাস্য দাস্তান, যা আমার হৃদয়কে অভিষিক্ত করেছিল জীবনের নতুন তাৎপর্যে।

ড. সাহেব! আমি ছিলাম এক হোটেলের মালিক। সত্তর বছর বয়সী এক মুসলিম সেই হোটেলে কর্মচারী ছিলেন। বৃদ্ধের ছিল অনিন্দ্য সুন্দর এক সন্তান। খোদা যেন অন্যদের চেয়ে আলাদা করেই তাকে বানিয়েছেন। কাজকর্মে সে ছিল পরিপাটি, আচার-আচরণে চৌকস। সবার নজর কাড়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার প্রকৃতিতে। তাকে ভালো না বেসে পারাই যেত না। ছেলেটা টগবগে তারুণ্যে উজ্জীবিত। হঠাৎ একদিন রোগে সে মারা গেল। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার হৃদয় কেঁপে উঠল। অসম্ভব এক দুঃখের দহনে পুড়তে লাগল মন। তার বাবার কথা ভেবে আমি পেরেশান হয়ে উঠলাম। সান্ত্বনা দিতে একদিন তার বাড়ি গেলাম। প্রকাশ করলাম আমার মনোবেদনা ও সহানুভ‚তি। বড় আন্তরিকতার সাথে তাকে আমি বোঝালাম, যে বেদনা তোমাকে ছুঁয়েছে আমিও তাতে ব্যথাহত। তাকে বললাম দুঃখ করো না এবং ভাগ্যকে মেনে নাও। বৃদ্ধ প্রভাবমুক্ত চেহারা ও শীতল গাম্ভীর্য নিয়ে আমার কথা শুনলেন।

আমি যখন থামলাম, তিনি অত্যন্ত কৃতজ্ঞভঙ্গিতে আকাশের দিকে তর্জনী ওঠালেন। শান্ত-উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, মেম সাহেবা! আমি দুঃখিত নই, এ তো খোদারই ফরমান। তিনি যে আমানত আমাকে দিয়েছিলেন তা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন, এতে আমার কষ্ট পাওয়ার কী আছে? আমার তো সর্বাবস্থায় খোদাতায়ালার শুকরগোজার করা কর্তব্য।

ড. সাহেব, সেই ঘটনা আমাকে কতটা নাড়িয়ে দিলো, বলা সহজ নয়। আকাশের দিকে উত্তোলিত বৃদ্ধের তর্জনি বারবার দুলতে লাগল আমার মানসলোকে। তার চেহারার কান্তি ও দৃষ্টির কৃতজ্ঞ ভাষা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তার ব্যক্তিত্বের অটলতা আমাকে বিমুগ্ধ করল। আমি বিস্ময় বোধ করলাম এমন ধৈর্যশীল, সুস্থির ও দৃঢ়চেতা লোকও আছে বুঝি পৃথিবীতে। বৃদ্ধের হৃদয় এই বলিষ্ঠতা পেলো কোথায়? আমি এক জিজ্ঞাসার ঘোরে পড়ে গেলাম।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মৃত ছেলেটির পরিবার-পরিজন আছে কি? বৃদ্ধ বললেন, জি স্ত্রী আছেন আর এক শিশুপুত্র। আমার বিস্ময় কিছুটা কমলো। ভাবলাম, পুত্রবধূ আর কচি নাতিটিকে ঘিরেই নিজের আদর ও প্রশান্তির ডেরা গাড়বেন- এই ভরসাই বোধহয় বৃদ্ধকে এতটা নিরুদ্বিগ্ন করে রেখেছে। নতুবা একজন মানুষ এত বড় বিপর্যয়ের পরও কিীভাবে এত স্বাভাবিক বৈঠা বেয়ে উজাতে পারে পরিস্থিতির স্রোত? প্রতিকূল ঝড়ের ওপর নিরুদ্বেগ সন্তুষ্টির আর তো কারণ আমি দেখি না! হ্যাঁ, বৃদ্ধকে স্বাভাবিকতা দিয়েছে এই বিধবা মহিলা আর এতিম নাতিটি। তাদের চেহারায় তিনি জিন্দেগির প্রতিচ্ছবি দেখছেন। কিন্তু তবুও বৃদ্ধের সন্তুষ্টি ও স্বাভাবিকতা বিস্ময়চিহ্ন হয়ে আমার মনের নীলিমায় ঝুলে রইল। এরপর বেশি দিন যায়নি। এতিম শিশুটির মা রোগাক্রান্ত হলেন। অসুখ ছিল খুবই তীব্র, ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেলেন।

আমি তা শুনেই ভেঙে পড়লাম। এক পাথরচাপা দুঃখবোধ আমাকে যেন কাতর করে তুলল। বৃদ্ধকে সমবেদনা জানাতে আবারো ছুটলাম গ্রামের দিকে। আমার হৃদয়ে ভেসে উঠছে দুঃখের চিত্রকল্প। মনে মনে ভাবলাম, এবার বৃদ্ধের অবস্থা কী হবে, খোদাই জানেন। এতিম বাচ্চাটির চিন্তা তো এমনিতেই তাকে বিষণ্ন করে ফেলবে। তার সাহসের পাঁজর ভেঙে দেবে শোকের আঘাত। সে একে কিভাবে সামলাবে?...

ভাবতে ভাবতে চলে গেলাম বৃদ্ধের বাড়ি। গিয়ে দেখি লোকের ভিড়ের মাঝখানে মাথা নুইয়ে বসে আছেন তিনি। আমি আফসোস করলাম। তাজা জখমে সান্ত্বনার মলম লাগাতে চাইলাম। সহমর্মিতার নিশ্চয়তা দিতে চাইলাম। বৃদ্ধ আমার আবেগপূর্ণ কথা ধীরস্থিরভাবে শুনলেন। আমি থামলে তিনি আকাশের দিকে তর্জনী উঠিয়ে বললেন, মেম সাহেব! খোদার ইচ্ছার বাইরে কারো নিঃশ্বাস ফেলার ক্ষমতাও নেই, যা ঘটেছে, তারই হুকুমে ঘটেছে। আমাদের এতে ভেঙে পড়ার কী আছে? আমাদের তো সর্বাবস্থায় তার ইচ্ছার ওপর খুশি থাকা কর্তব্য।

বৃদ্ধ থামলেন। দেখলাম তার অবস্থা স্বাভাবিক। হাহাকারের কোনো কম্পন টের পাওয়া যাচ্ছে না। আহ! শব্দটিও উচ্চারিত হচ্ছে না। চোখে নেই অশ্রু। কথাবার্তাও অকম্পিত, শান্ত, সুস্থির। বৃদ্ধ তো পুত্রবধূকে মাটির নিচে দাফন করে নিজের আশ্রয় হারালেন। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি যেন দায়িত্ব আদায় করেছেন। ভারমুক্ত হয়েছেন।
কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে চলে এলাম। রাস্তায় শুধু ভাবছিলাম যে, কীভাবে ঈমান এতটা দৃঢ় হতে পারে? সারা জীবনের স্বপ্ন ও সংসার বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও একজন মানুষ কিভাবে বেদনায় কাতর না হয়ে পারে? এত বড় শোক কিভাবে সে চাপা দিয়ে রাখে বুকের ভেতর? কোনো শক্তির বলে সে সবরের ওপর এতটা অবিচল? কোথায় পেল সে এমন প্রশ্নহীন কৃতজ্ঞতা?

বৃদ্ধের অবস্থা নিয়ে প্রায়ই চিন্তা করতাম। ইতোমধ্যে একদিন খবর পেলাম বৃদ্ধের মাতৃহারা নাতিটিও মারা গেছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ছুটে গেলাম বৃদ্ধের কাছে। পথে ভাবছিলাম, এবার নিশ্চয় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। এখন তো তিনি একেবারে নিঃসঙ্গ। জীবনের শেষ খড়কুটো হারিয়ে নিয়তির ঘূর্ণির ওপর ভাসমান ধূলিকণা। হতাশাই এখন তার ভবিষ্যৎ। সে এখন সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে মধ্যসমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিক, সামনে তার দুঃস্বপ্নের মাতাল তরঙ্গ... আহা! কী করবে বৃদ্ধটি... ভাবতে ভাবতে চলে এলাম সেই পুরনো বাড়িতে।

যে দুঃখবোধ কালো মেঘের মতো আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তা যেন সহসা বিস্ময়ে রূপান্তরিত হলো। কেননা তিনি এখনো ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার চাতালেই দাঁড়িয়ে আছেন! আমি বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে করুণ কণ্ঠে হামদর্দি প্রকাশ করলাম। আসলে এ পরিস্থিতিতে একজন মানুষের হৃদয়জগৎকে সুস্থির করতে পারে, এমন কিছুই আমার জানা ছিল না। আমি শুধু এক পাহাড় বেদনাকে এক তরঙ্গ আবেগ দিয়ে ব্যক্ত করতে চাচ্ছিলাম। যদিও এ বেদনা বৃদ্ধেরই জন্য, কিন্তু লোকটির সামনে হাজির হয়ে তা আমার ব্যক্তিগত মনে হচ্ছে। কারণ লোকটি আবেগের অস্থিরতা ও মানসিক দুর্বলতার সীমা থেকে মুক্ত হয়ে অন্য কোনো অনুভবের উপত্যকায় যেন তাঁবু গেড়েছে। বৃদ্ধ মাথা ঝোকালেন। আমার কথা শুনলেন। তার প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকাচ্ছিলাম। আমি কি কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছি? হ্যাঁ, এই বৃদ্ধ পাথরের মানুষ নয়। আবেগ তারও আছে। যন্ত্রণার একটি করুণ কান্না মনে হলো তার হৃদয়ে বাজছে, কিন্তু মুহূর্তেই মিলিয়ে যাচ্ছে অলৌকিক এক হাওয়ার হিন্দোলে।

টের পেলাম বৃদ্ধের বুক ভেদ করে একটি দীর্ঘশ্বাস নিঃশব্দে এগিয়ে এসে কোথায় যেন গলে যাচ্ছে। একটি আচ্ছন্নতা যেন কাত হয়ে আছে চেহারায়। একে না ধরা যাচ্ছে, না অস্বীকার করা যাচ্ছে। বৃদ্ধ আমার দিকে তাকালেন। কণ্ঠ ধীর উদাত্ত। দেখলাম তার অকম্পিত তর্জনী আকাশের দিকে উঠল। বললেন, মেম সাহেবা! যা হয়েছে এতে আমাদের হাত নেই, যিনি সব কিছুর মালিক, তিনি তার আমানত নিয়ে গেছেন। এতে আমাদের অখুশি হওয়ার কী আছে? কেন আমরা মালিকের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে নিজের আত্মাকে কলুষিত করব?

লেডি ব্রান্সের আওয়াজ ভারী হয়ে এলো। তিনি তার ডান হাত ওপরে ওঠালেন, বিগলিত আওয়াজে বললেন, ড. সাহেব। বৃদ্ধের এই জবাব আমার কলজে ভেদ করে দিলো। তার তর্জনী আকাশের দিকেই উঠেছিল। কিন্তু তা যেন আমূল বিদ্ধ হয়ে গেলো আমার হৃৎপিণ্ডে। হৃৎপিণ্ড থেকে অবিরাম রক্ত ঝরতে লাগল আর আমার অবিশ্বাসী মন বিশ্বাসী হতে থাকল। খোদা থেকে পলায়নপর আত্মা প্রকৃত ঠিকানার দিকে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল। লোকটি যদিও বৃদ্ধ, শরীরে তেজ নেই, শিরা-উপশিরায় রোগের বাসা, হাড়গোড় দুর্বল, কিন্তু তার বিশ্বাসের তেজস্বিতা বিদ্যুতের মতো চমকালো বিস্ময়কর নিপুণতায়। তার ঈমানের পাথরসমান দৃঢ়তার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। যেন নতুন কোনো সত্যের অতল গহিনে নিমজ্জিত হওয়ার জন্য বেকারার হয়ে উঠলাম।

বুঝলাম, বৃদ্ধকে ছাড়লে আমার চলবে না। এখন গ্রামে তাকে টেনে রাখার তো কেউ নেই। আমি তাকে প্রস্তাব করলাম, ‘চলে এসো আমার হোটেলে।’ তিনি রাজি হলেন। হোটেলে তিনি ছিলেন এক অনন্য মানুষ। সারা দিন কাজ করতেন, সারা রাত তার প্রভুর ইবাদতে ডুবে থাকতেন। জীবনকে কিভাবে যত্ন করতে হয় তার জানা ছিল। সময় তার পুঁজি, একে সুনিপুণভাবে অর্থপূর্ণ প্রক্রিয়ায় কাজে লাগানোর প্রজ্ঞা তার ছিল। একবার তিনি স্বজনের কবরস্থান জিয়ারত করতে চাইলেন। অনুসন্ধিৎসু মন আমাকে তার সঙ্গী বানিয়ে নিলো। মন বলল, এবার দেখব কিভাবে প্রকাশিত হয় তার আবেগ?

কবরস্থানে তিনি বিধ্বস্ত কবরগুলো মেরামত করতে লাগলেন। মাটি খুঁড়ে নিয়ে এসে কবরে ঢাললেন। এরপর পানি এনে কবরে ছিটালেন। শরীর থেকে ধুলো ঝাড়লেন। এরপর দেখলাম ওযু করছেন। অত্যন্ত যত্ন সহকারে ওজু আদায় করে কবরবাসীর জন্য ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা করলেন কিছুক্ষণ। আমি দেখলাম তার প্রতিটি কাজ থেকে ঈমানের আলো ঠিকরে পড়ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে প্রকাশিত হচ্ছে প্রশান্ত সৌন্দর্য।

এই প্রশান্তি আর সৌন্দর্যের ঝিলিক আমার ভেতরে জাগিয়ে তুলল সেই আগুন, যা এতদিন ছাইচাপা পড়েছিল সত্তার গহীনে। এতদিন সে আগুন সহসা উঁকিঝুঁকি দিতো, এবার লেলিহান হয়ে জ্বলে উঠল। আমি আমার অস্থিরতার ভাষা পাঠ করতে লাগলাম। বুঝলাম, বৃদ্ধের মধ্যে যে ঈমান দেখেছি, আমার হৃদয়ে তারই পিপাসা। আত্মার এমন প্রকান্তি ও সন্তুষ্টির সরোবরে আমাকে সাঁতরাতে হবে। এটাই হয়ে উঠল সব ধ্যানের সারাৎসার। যখন তখন এই ধ্যান অশান্ত রূপ নিত, আমিও অস্থির হয়ে যেতাম।

আমি বৃদ্ধের অবস্থা নিয়ে যতই ভাবলাম, ততই বুঝতে পারলাম, এই ঈমান ও এই তাওয়াক্কুল বৃদ্ধের ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এ তার ধর্মেরই উপহার। ধর্ম তার তুলি দিয়ে যে ছবি অঙ্কন করেছে বৃদ্ধের আত্মায়, এ কেবল তারই প্রতিফলন। এই সিদ্ধান্তে যেইমাত্র পৌঁছালাম, আমার হৃদয় আপনিই মুসলমান হয়ে গেল। বাকি রইল শুধু প্রকাশ্য ঘোষণা। হোটেলে পৌঁছে কোনো মুসলমান মহিলাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য বৃদ্ধকে বললাম। তিনি সাথে সাথে এক আলেমের কন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন। ‘আমাকে তিনি মুসলমান হওয়ার জন্য উৎসাহ দিলেন। কোনো বিলম্ব না করেই আমি তার কাছ থেকে ঈমানের ঘোষণা দিলাম।

মুসলমান হয়ে আমি ডুব দিতে চাইলাম ঈমানের গভীরতর প্রদেশে। একান্তভাবেই খোদার প্রতি সমর্পিত হতে চাইলাম এবং হৃদয়ের সব ঔদার্য দিয়ে তাকেই কামনা করলাম। আমার জীবন নিবদ্ধ হতে লাগল তার দিকে। আজ আমি খুশি। যে ঐশ্বর্য দেখেছিলাম বৃদ্ধের মধ্যে, আমি সেই অনাবিল পবিত্রতায় গোসল করতে পেরেছি। আমার জীবনে ভেসে উঠেছে আশা, ভরসা ও প্রশান্তির অনাবিল স্বর্ণদ্বীপ।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement