২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঢাকা এসেছিলেন টিকা বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট

বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত ‘লিট ফেস্টে’ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য ও দর্শক-শ্রোতার কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দেন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার উদ্ভাবক ব্রিটিশ টিকা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডেম সারা গিলবার্ট - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী চলছে গত তিন বছর ধরে। এই মহামারীর লাগাম টেনে ধরেছে কোভিড ভ্যাক্সিন বা টিকা। বিশ্বে প্রায় ৩০০ ধরনের টিকা নিয়ে গবেষণা চললেও দেড় ডজন টিকা সাফল্যের মুখ দেখেছে। এর মধ্যে তিনটি টিকা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এগুলো হলো- ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।

বিশ্বে এ প্রথম এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে ফাইজার ও মডার্নার টিকা। অন্য দিকে অক্সফোর্ডের টিকাটি তৈরি হয়েছে প্রচলিত ডিএনএভিত্তিক ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তিতে। এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১৩ বিলিয়ন ডোজ (এক বিলিয়নে ১০০ কোটি) টিকাদান করা হয়েছে। এত টিকা এর আগে কোনো মহামারী বা রোগের জন্য দেয়া হয়নি।

আলোচিত তিনটি টিকার একটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকা। এ টিকা প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক ডেম সারা গিলবার্ট। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউটের টিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক। নতুন টিকা উদ্ভাবন ও উৎকর্ষ সাধনে তার রয়েছে ২৫ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা।

মহামারীর ভীতিকর সময়ে অধ্যাপক সারা গিলবার্ট ও তার সহযোগী ক্যাথেরিন গ্রিন মিলে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উদ্ভাবন করেন।

বিশ্বের সাড়া জাগানো এ টিকা বিজ্ঞানী অধ্যাপক সারা গিলবার্ট ঢাকা ঘুরে গেলেন। বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত `ঢাকা লিট ফেস্ট` বা সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন তিনি। শুক্র ও শনিবার লিট ফেস্ট অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ এ টিকা বিজ্ঞানী বক্তৃতা করেন এবং শ্রোতাদের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দেন। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমিতে এটি দশম লিট ফেস্ট। করোনা মহামারীর কারণে গত তিন বছর এই লিট ফেস্ট আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।

স্বাভাবিকভাবে কোভিড টিকার বিষয়টি ছিল এবারের লিট ফেস্টে আকর্ষণীয় আলোচনা। সারা গিলবার্ট বলেন, করোনার ভিন্ন ভিন্ন ধরন বা ভ্যারিয়েন্টের জন্য একই ভ্যাকসিন বা টিকা নিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী নন।

তিনি বলেন, আমরা যে টিকাটি উদ্ভাবন করেছি সেটি নির্দিষ্ট স্পাইক প্রোটিনে কাজ করে। এটি অ্যান্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করে যা ভাইরাসকে অবরুদ্ধ করে। স্পাইক প্রোটিন বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টে বদলায়। সব ভ্যারিয়েন্টের জন্য একই ভ্যাকসিন তৈরি করতে গেলে হয় তো আমাদের ভাইরাসের মূলে যেতে হবে। আমার কাছে এটি অসম্ভব মনে হয়। তাই এ মুহূর্তে ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দেয়া উচিত।

শুক্রবার লিট ফেস্টের `সায়েন্স ভেক্সার্স` শীর্ষক অধিবেশনটির সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশের তরুণ জিন বিজ্ঞানী ড. সেজুতি সাহা। এতে মধ্যমণি হিসেবে ছিলেন যুক্তরাজ্যের টিকা বিজ্ঞানী ড. সারা গিলবার্ট। আরো অংশ নেন বাংলাদেশে পাটের জিন আবিষ্কারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসিনা খান ও গবেষক অধ্যাপক ইয়াসমিন হক।

ব্রিটিশ টিকা বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট করোনা মহামারীর দুঃসহ সময়ে কীভাবে তারা টিকাটি আবিষ্কার করেন এবং টিকা উৎপাদনের পেছনের গল্পটা কী তা শোনান শ্রোতাদের। গল্পটি শুনিয়ে তিনি বলেন, `আরো মহামারী হওয়ার ঝুঁকি আছে। আপনাদের দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্য দুঃখিত। কিন্তু এটি ঠিক, সব সময়ই আরেকটি মহামারী হতে পারে। এ জন্য রাষ্ট্রগুলোকে এবং বিজ্ঞানীদের সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে আমি এ কথা বলতে পারি, আগামী মহামারীতে খুব কম সময়ে টিকা উদ্ভাবিত হবে।`

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি বিশ্বের সম্পদ উল্লেখ করে ড. সারা গিলবার্ট বলেন, `বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমরা চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠান। টিকা থেকে আমরা টাকা উপার্জন করতে পারি না। এ কারণে আমরা চেয়েছি এটিকে যতটুকু বিস্তৃত পরিসরে পৌঁছানো যায়। তাই সব সময়ই বলেছি- এ টিকা বিশ্বের জন্য, এটি শুধু যুক্তরাজ্যের কিংবা ইউরোপের টিকা নয়। এটি বিশ্বের টিকা। অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো উৎপাদকের সাথে সংযুক্তি হয়েছি বিস্তৃত পরিসরে টিকা উৎপাদনের জন্য।`

তিনি জানান, ২০২২ সালের শুরুতে এসে আমাদের এই টিকা ৩০০ কোটি ডোজ উৎপাদিত হয়েছে। এখনো উৎপাদন চলছে। বিপুল এই টিকা ব্রাজিলে গেছে। আপনাদের এখানেও এসেছে। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও গেছে।
করোনার টিকার এখন কোনো ঘাটতি নেই বলেও জানান ড. সারা গিলবার্ট।

তিনি বলেন, `আমাদের টিকা ছাড়াও অনেকগুলো ভালো টিকার উৎপাদন চলছে। এখন চতুর্থ, পঞ্চম ডোজ বা বুস্টার ডোজ টিকা দেয়া হচ্ছে। বলা যায়, অনেক মানুষ টিকা পেয়েছে। বিশ্বের অনেক মানুষ এখন টিকার আওতায়। তবে বাকিদেরও টিকার আওতায় আনতে হবে।`

করোনাভাইরাস ল্যাবে তৈরি এমন অভিযোগ সম্পর্কে সারা গিলবার্ট বলেন, `না, এটি আমি বিশ্বাস করি না।` তিনি শুধু বলেন, `সুরক্ষার জন্য টিকার বিরাট মজুদ গড়ে তোলা দরকার। ভয়ের কারণ নেই, নতুন কোনো ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটলে কিংবা নতুন মহামারীর পূর্বাভাস পেলে আমরা আরো কম সময়ে নতুন টিকা তৈরি করতে পারব। কারণ করোনা মহামারী থেকে সারা বিশ্ব শিক্ষা নিয়েছে, বিজ্ঞানীরা শিক্ষা নিয়েছেন। টিকা বিজ্ঞানীদেরও অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।`

মহামারীর শেষের দিকে এসে চীনে করোনা সংক্রমণ এত বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? সহকর্মী সাংবাদিক শিশির মোড়লকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. সারা গিলবার্ট বলেন, `একটি বড় কারণ হতে পারে এই যে, চীনের টিকাগুলো তুলনামূলকভাবে কম কার্যকর। নতুন যে উপধরনে চীনের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে সেই উপধরনের বিরুদ্ধে চীনে ব্যবহৃত টিকা কম কার্যকর।`

এর আগে স্কাই নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে সারা গিলবার্ট মহামারীর অবসান সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, `পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস একেবারে নির্মূল না হলেও ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস আগামী বছরের মধ্যে সাধারণ সর্দি-জ্বরে রূপ নেবে।`

ঢাকা লিট ফেস্টে দর্শক-শ্রোতাদের অন্যতম আকর্ষণ টিকা বিজ্ঞানী সারা গিলবার্ট নিজের বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্পও শোনান। তিনি বলেন, `বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে দরকার ইচ্ছা।` তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, `জীবনে যখন যেটার প্রতি আগ্রহ থাকবে, সেটার জন্য কঠিন সাধনা করার ইচ্ছা থাকতে হবে। এটি থাকলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া এখন অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- আগে টেস্ট কিট ছিল না, এখন আছে। পরীক্ষার সময় কমে এসেছে। অ্যানালাইসিস করার জন্য অনেক সময় পাই। আগে পরীক্ষায় শুধু অনেক সময় চলে যেত। বিনিয়োগ আছে। আগে অর্থায়ন পাওয়া যেত না।`

চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর অতিক্ষুদ্র অদৃশ্য এ ভাইরাস সারা বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। তিন বছর ধরে চলছে এর দাপট। ইতোমধ্যে ২৩০টি দেশ ও অঞ্চলে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬৬ কোটি ৮১ লাখ ৫৮ হাজার ২৯ জন। করোনাভাইরাসে এ সময়ে বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে ৬৭ লাখ ১০ হাজার ৫০৪ জনের। আক্রান্তের শীর্ষে পাঁচটি দেশ হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রাজিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ১০ কোটি ৩০ লাখ, মারা গেছে ১১ লাখ ২১ হাজার। ভারতে আক্রান্ত সাড়ে চার কোটি, মারা গেছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার। ফ্রান্সে আক্রান্ত তিন কোটি ৯৩ লাখ, মারা গেছে এক লাখ ৬২ হাজার। জার্মানিতে আক্রান্ত তিন কোটি ৭৫ লাখ, মারা গেছে এক লাখ ৬২ হাজার। মারা গেছে ছয় লাখ ৯৪ হাজার।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
abdal62@gmail.com.


আরো সংবাদ



premium cement