আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি
- ড. মাহবুব হাসান
- ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:১৩

নিচে উদ্ধৃত করছি একটি রিপোর্টের একাংশ। এটুকু পাঠ করলে সামান্য হলেও বোঝা যাবে বিশ্বের তুলনায় আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে বেশ আগেই। তখন ওই নামে ডাকা না হলেও এখন আমরা বেশ স্মার্টভঙ্গিতে নিজেদের শার্টের কলার নাচিয়ে বলি বাংলাদেশ ডিজিটালি এগিয়ে চলেছে। এ কথার ভেতরে সত্য ও মিথ্যার ভাগ বাটোয়ারা না করলে সত্য উভয়পক্ষেই আছে। আর এই ডিজিটালের সুতো ধরেই এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা এসেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে। এই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে ভিশনারি উদ্যোগ তাকে কি হেলা করা যায়?
না, আমরা সরকারের কোনো উদ্যোগকেই হেলা করি না। বরং ভাবি, সরকারের দৃষ্টি দূরে, সুদূরে, যা স্বপ্নময়। যা স্বপ্নের পরিকল্পনায় আছে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেই তা বাস্তব হয়ে উঠবে। যে রিপোর্টের খণ্ডাংশ তুলে দিচ্ছে, তা এবার পাঠ করা যাক।
১৭৬০ সালের দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় প্রথম শিল্পবিপ্লব। বস্ত্র, খনিজ, কৃষি বিভিন্ন খাতে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিত। ১৮৭১ সাল থেকে শুরু হয় প্রযুক্তিগত দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। রেলপথ, টেলিফোন ও বিদ্যুতের আবিষ্কার সে বিপ্লবের সময় কারখানাগুলোকে দেয় নতুন গতি, অর্থনীতিকে দেয় অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ইলেকট্রনিকস এবং তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে ঘটে যাওয়া সেই বিপ্লব ডিজিটাল বিপ্লব নামেও পরিচিত। আসে কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার।
বর্তমানে বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন ধরনের সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমের (কম্পিউটারভিত্তিক অ্যালগরিদম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নিরীক্ষিত) উদ্ভবের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে চলছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভেতর দিয়ে। এই বিপ্লবের চালিকাশক্তি নানা ধরনের বিকাশমান প্রযুক্তির সংমিশ্রণ। এর মধ্যে যেমন আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংক, রোবোটিকস, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং; তেমন আবার আছে জিন প্রকৌশল, ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো বিভিন্ন প্রযুক্তি।
পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম পার্থক্য হলো, এটি আগের বিপ্লবগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতগতিতে পরিবর্তনশীল, প্রতিটি দেশের প্রায় প্রতিটি শিল্পকে এটি প্রভাবিত করছে। উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, পরিষেবা কিংবা পরিচালনা সব কিছুর রূপান্তরের ইঙ্গিত নিয়ে এসেছে এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময়ে সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি আবার তৈরি হয়েছে যন্ত্রের কাছে চাকরি হারানোর ভয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘ফিউচার অব জব সার্ভে ২০২০’ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে আট কোটি চাকরি গায়েব হয়ে যাবে। তবে, নতুনভাবে উদ্ভব হবে আরো সাড়ে ৯ কোটি চাকরির। যেসব চাকরির চাহিদা বাড়বে, সে তালিকার প্রথম পাঁচটি হলো ডেটা বিশ্লেষক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, বিগ ডেটা বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কৌশল বিশেষজ্ঞ, প্রসেস অটোমেশন বিশেষজ্ঞ। আর যে চাকরির চাহিদা কমবে, সে তালিকার প্রথম পাঁচটি হলো ডেটা এন্ট্রি ক্লার্ক, প্রশাসনিক ও নির্বাহী সচিব, অ্যাকাউন্টিং, বুককিপিং এবং পে’রোল ক্লার্ক, হিসাবরক্ষক এবং নিরীক্ষক, উৎপাদন কারখানার শ্রমিক। (প্রথম আলো/৩১/১২/২২)
দিন কয়েক আগে, মনে হয় বছর শেষের একদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে। শুনে আমার ভালো লাগল এ জন্য যে, তিনি যেসব কথা বললেন, তাতে আগামী প্রজন্মের শিশুদের গড়ে তোলার জন্য একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তা গৃহীত হবে। বিশেষ করে কারিকুলাম সাজাতে গিয়ে জব মার্কেটের প্রয়োজন, বিশ্ববাজারে কারিগরি শিক্ষার শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত লোকবল গড়ে তোলার কথাও তিনি বলেছেন। তার মানে আমরা প্রস্তুত হচ্ছি আগামী পৃথিবীর চাহিদা সামনে রেখে। এই পদক্ষেপকে আমি অ্যাপ্রিসিয়েট করছি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ওপর যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তাকে যদি অনুসরণ করি তাহলে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তিবিদ্যার আমাদের পাল্লা দিতে হবে। কেননা, আমরা যদি লিস্ট ডেভেলপ কান্ট্রি থেকে ডেভেলপিং কান্ট্রিংতে পা রাখতে চাই, তাহলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে। নিজেদের তৈরি করা মানে সব সাংবিধানিক অধিকারী মানুষকে তার প্রাপ্য শিক্ষা দিতে উদ্যোগ নেয়া। তার মানে হচ্ছে, প্রতিটি গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের শিশুর জন্য শিক্ষাকে দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। তার জন্য কেবল অবকাঠামো দিলেই হবে না, প্রয়োজনীয় শিক্ষক শিক্ষা উপকরণও দিতে হবে। সরকারের এ খাতে বিনিয়োগ অনেকটাই বাড়াতে হবে। জাতির মেরুদণ্ড শক্তপোক্ত ও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে এই উদ্যোগের ব্যতিক্রম করা যাবে না।
আমাদের রয়েছে বিপুল পরিমাণ যুবজনশক্তি, তাদের বৃহদাংশই অদক্ষ ও নিরক্ষর। ওই নিরক্ষর ও অদক্ষদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে কারিগরি বিদ্যায়। টেকনোলজির এই যুগে তারাই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস হবে, যা আমরা স্বপ্ন দেখি।
ফ্রিল্যান্স করে যে সব তরুণ স্বাবলম্বী আজ, তাদের নতুন স্বপ্নের বাগানে দক্ষ কর্মীতে রূপান্তর করা সম্ভব। আর যারা এর মধ্যেই আইট নিয়ে পড়াশোনো করেছেন এবং যারা কম্পিউটার সাইন্সের শিক্ষার্থী তাদের সামনে আছে অনেক সুযোগ যদি সত্যই তারা চাহিদার তালিকায় থাকেন।
যেসব চাকরির চাহিদা বাড়বে, সে তালিকার প্রথম পাঁচটি হলো, ডেটা বিশ্লেষক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, বিগ ডেটা বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কৌশল বিশেষজ্ঞ, প্রসেস অটোমেশন বিশেষজ্ঞ।
তবে, রাতারাতি চাহিদার শীর্ষে থাকা চাকরিতে বাংলাদেশীদের ঢুকে পড়া সহজ হবে না। কেননা, আমরা এখনো অনেকটাই পিছিয়ে আছি। আইট সেক্টরে, সিএসইতে যেসব শিক্ষা কারিকুলাম আছে, সেগুলো আপডেট করতে হবে। বিশ্ববাজারের চাহিদাকে সামনে রেখে সেই কারিকুলাম সাজাতে হবে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। পাশাপাশি দেশের ভেতরে ও বাইরে এই সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো গতিশীল করে তুলতে হবে।
এর জন্য প্রথম পদক্ষেপ যেমন তৃণমূলের শিশু কিশোরদের শিক্ষা, একই সাথে তাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক করিকুলামে কম্পিউটার বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্তকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে তোলা। কলেজ লেভেল থেকেই কম্পিউটারমনস্ক করে তোলা জরুরি। এই উদ্যোগের সাথে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে বিদ্যুৎ, কম্পিউটার উপকরণ, ইন্টারনেট। বিদ্যুতে আমাদের যে ঘাটতি তা ভারত থেকে আমদানি করে পোষানো যাবে না। কোনো কিছুই আমদানিনির্ভরতা ভালো নয়। এ-কথাটি যদি সরকার উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে দেশেই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ ও আয়োজন ভালো পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। স্বয়ম্ভরতা অর্জনের বিকল্প নেই কোনো সেক্টরেই। বিদ্যুৎ সেখানে শিক্ষার মতোই সবচেয়ে জরুরি উপাদান। সরকার কী করে, কোন বিবেচনায় ভারতের আদানির কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করেছে ২০১৭ সালে? গত পাঁচ বছরের ওই মাপের বিদ্যুৎকেন্দ্র তো দেশেই স্থাপন করা যেত। আমরা জানি সরকারের অর্থ সঙ্কট আছে। কিন্তু সেটা স্বীকার করেন না সরকার। অথচ প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে আদানির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে গিয়ে। এভাবে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না।
আমরা কি নিজেদের স্বাবলম্বনকে প্রণোদিত করব না?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা